চা বেচা আর দাবা খেলা

কাকডাকা ভোরেই দোকানে যেতে হয়। চায়ের কেতলিতে পানি না ফোটালে যে পেটেও কিছু পড়বে না মোহাম্মদ সাগরের। চা বানায়, ক্রেতাদের পরিবেশন করায়। এর মধ্যেও সময় বের করে বসে যায় দাবা নিয়ে। মাগুরার কেশব মোড়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চেই চলে দাবা খেলা। খেলতে খেলতে জেলা শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে এসেছে জুনিয়র দাবার জাতীয় পর্যায়ে। গত পরশু শেষ হওয়া প্রতিযোগিতায় হয়েছে রানারআপ।
বাবা মোশারফ হোসেন ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটার হতে পারেনি সাগর। নিজেরও ছিল সেই স্বপ্ন। কিন্তু ক্রিকেট খেলতে হলে সারা দিন মাঠে থাকতে হবে। চায়ের দোকানের ঝাঁপ না উঠলে যে সংসার চলবে না। ক্রিকেটার আর হতে পারল না সাগর। ২০০০ সালে হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলেন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে। সংসারের হালটা ধরতে হলো সাগরকেই। মা আমেনা খাতুনও পৃথিবী ছেড়ে গেছেন গত বছর। বড় ভাই বিবাহিত, নিজের সংসার নিয়ে সে ব্যস্ত। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাই লেখাপড়াটা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারেনি। তিন-চার বছর বিরতির পর আবারও ভর্তি হয়েছে মাগুরা শ্রীখণ্ডী উচ্চবিদ্যালয়ে।
সাগরের দাবা খেলায় আসার গল্পটা মজার। মাগুরায় তখন ফুটবলার মেহেদি হাসান উজ্জ্বলের বেশ নাম। ঢাকা থেকে ফিরলেই আবাহনীর এই মিডফিল্ডারকে নিয়ে শোরগোল পড়ে যেত। হইচই পড়ত জাতীয় দলের দাবাড়ু মাহফুজুর রহমানকে (ইমন) নিয়েও। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, শ্যুটার শারমিন আক্তার রত্নাদের সাফল্য তাঁকে ভেতরে ভেতরে তাতিয়ে দিচ্ছিল। খেলোয়াড় তাকে হতেই হবে। একদিন সাগরই ইচ্ছাটা জানাল উজ্জ্বলকে, ‘ভাই, আমি ফুটবলার হব।’ দোকান ছেড়ে ফুটবলে সময় দিতে পারবে না বলে তাকে দাবা খেলার পরামর্শ দেন উজ্জ্বল, ‘আমি তোমাকে দাবা খেলতে দেখেছি, মন দিয়ে দাবাই খেলো।’ উজ্জ্বলই সাগরের প্রথম দাবার গুরু।
দাবায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। ১৭ বছর বয়সী সাগর বলল, ‘দাবা যে লিখে খেলতে হয়, জানতাম না। প্রথম জানলাম মহানগর টুর্নামেন্টে খেলার সময়। তখন ইমন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। উনি মাগুরায় গেলে আমাকে কিছু বই দেন। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে শুরু করি খেলা শেখা।’
সারা দিন দোকানদারি করেও রাতে ঘণ্টা চারেক দাবার অনুশীলন করে সাগর। এর পর পড়াশোনা করে ঘুমাতে যায়। মাগুরার ছোট-বড় টুর্নামেন্টে গত কয়েক বছরে ৪৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গত বছর স্কুল দাবায় হয়েছে রানারআপ। নিজের একটা ল্যাপটপ হবে, আধুনিক দাবার সব নিয়মকানুন শিখবে, এটা এখনো তার কাছে আকাশকুসুম কল্পনা, ‘চা বিক্রি করে কি ল্যাপটপ কেনা সম্ভব?’ জানাল, ‘মাগুরা জেলা সমাজসেবা কার্যালয় একবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ল্যাপটপ দেবে। কিন্তু এখনো পাইনি।’
বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে ফেডারেশনে দেখা হলেও কথা হয়নি কখনো। ইচ্ছা আছে, নিয়াজ মোরশেদের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার। নিয়াজকেও ছাড়িয়ে যেতে চায় সে একদিন। মফস্বলের চা-দোকানি হলেও ইচ্ছাটাকে আকাশের সীমানায় বাঁধতে দোষ কী?

No comments

Powered by Blogger.