আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রের উচ্চ শিক্ষা' by শামা মাহজাবীন

ব্রিটেন উচ্চ শিক্ষার ব্যয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার ফলে দেশটির হাজার হাজার শিক্ষার্থী ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। শিক্ষার্থীরা দেশটির নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে সরকারের নেওয়া সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই মেনে নিবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন-ফী বৃদ্ধিতে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন ছাত্র আন্দোলন ব্রিটিশ বুনিয়াদি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মূলে আঘাত হেনেছে।
দরিদ্রদের ছেটে ফেলার কৌশলপত্র
বর্তমান বিশ্বে পুঁজির চরিত্র অনুযায়ী পুঁজি সব জায়গা থেকে মুনাফা করার প্রবণতার দিকে ধাবিত হয়েছে। ফলে যেসব খাতগুলো আগে মুনাফা তৈরির মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত হতো না, সে খাতগুলোও আজকের অর্থনৈতিক-ব্যবস্থায় মুনাফায় অঙ্গীভূত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সেবাখাতসমূহ। শিক্ষাকে মানব পুঁজি তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ মনে করা হতো। কিন্তু পুঁজির চরিত্রের কারণে সেই মানব পুঁজিই আজকে মুনাফা তৈরির মেশিন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যে কারণে উচ্চ শিক্ষা চলে যাচ্ছে সমাজের ধনী পরিবারের সন্তানের জন্য। সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও দেখা গেছে এ প্রবণতা। এ প্রবণতা শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্যই নয়, খোদ পুঁজিবাদের ভিত্তিভূমি পরিচিত ব্রিটেনেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। ব্রিটেনে দফায় দফায় বাড়ছে বেতন ফি। শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছেন সরকারের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধাচরণ করে।
উচ্চশিক্ষার অর্থায়ন সংক্রান্ত লর্ড ব্রাউনের 'হাইয়ার এডুকেশন ফান্ডিং অ্যান্ড স্টুুডেন্ট ফাইন্যান্স' শীর্ষক প্রতিবেদনে সীমাহীন বেতন ফি বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। আগে যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি কোর্সের জন্য প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৩,২৯০ পাউন্ড দিতে হয়, বর্তমানের সুপারিশ অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থীকে ১২,০০০ পাউন্ড গুনতে হবে। স্বভাবতই লর্ড ব্রাউনের প্রস্তাবিত সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির শিক্ষার্থর্র্রর্্ী ও শিক্ষাবিদরা। ব্রিটেনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জাতীয় সংস্থা ইউ সি ইউ ব্রাউনের সুপারিশকে 'উচ্চশিক্ষার কফিনে চূড়ান্ত 'পেরেক ঠোকা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। দেশটির শিক্ষার্থীদের সংগঠন এন ইউ এস ব্রাউনের সুপারিশকে 'মূর্খ, আত্ম-সন্তুষ্ট ও বিপজ্জনক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ইপসস মৌরি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, রক্ষণশীল লিবডেম জোট সরকারের প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র পরিবারের উচ্চ শিক্ষাকাঙ্ক্ষী তরুণ-তরুণী। ফি দিতে অপারগ হওয়ার কারণে তারা উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে দরিদ্রদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
ইপসস মৌরির ওই জরিপে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে তাদের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩,২৯০ পাউন্ড থেকে টিউশন ফি বাড়িয়ে ৫,০০০ পাউন্ড করলে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা উচ্চ শিক্ষাকাঙ্ক্ষী শিশুদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার আশা ত্যাগ করবে। যদি টিউশন ফি বাড়িয়ে ৭,০০০ পাউন্ডে স্থির করা হয়, তাহলে দরিদ্র পরিবারের সন্তান-সন্ততিদের প্রায় দু-তৃতীয়াংশ উচ্চ শিক্ষা থেকে বাদ পড়ে যাবে, যারা অন্যথায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। এ জরিপের আওতায় দুই হাজার সাতশ শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যার মধ্যে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্র্থীর মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগ ৫,০০০ পাউন্ডের ফি দিয়ে উচ্চ শিক্ষায় যেতে রাজি আছে, কিন্তু ৭,০০০ পাউন্ড হলে তার পরিমাণ মাত্র ৩৫ ভাগে নেমে আসে।
এর আগে বিগত ব্লেয়ার সরকারের আমলে শিক্ষার্থীদের মা-বাবার আয় সাপেক্ষে ১,০০০ পাউন্ড টিউশন ফি প্রবর্তনের আইন করা হয়, লিবারেল ডেমক্র্যাটিক পার্টি নীতিগতভাবে তার বিরোধিতা করে। দলটির ঘোষণা ছিল, ক্ষমতায় গেলে তারা টিউশন ফির বিধান সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করবে।
কর্তৃপক্ষ কাদের
ইরাক-আফগান যুদ্ধে মার্কিনিদের দোশর হিসেবে কোটি কোটি পাউন্ড খরচ করে বাস্তবে সেখান থেকে কী পেয়েছে এখনও স্পষ্ট নয় ব্রিটিশ জনগণের কাছে। গত এক দশক স্থায়ী এ যুদ্ধে শত শত ব্রিটিশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে অসংখ্য। সেখানে সরকারের ঘোষিত উচ্চ শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি সংকটে ফেলে দিয়েছে শাসক দলকে। দৃশ্যত এ আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছে তা কোনোভাবেই অহিংস পদ্ধতিতে নয়। ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে পুলিশের সঙ্গে ইট পাটকেল ছোড়াছুড়িতে নেমেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্রিটেনের বিভিন্ন বামপন্থি কমিউনিস্ট ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে তাও অজানা নয়। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ এতোই যে তারা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেছে। বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যে এ আন্দোলনকে ১৯৬৮ সালের সর্বাত্মক ছাত্র আন্দোলনের অনুপ্রেরণদায়ী আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিক্ষোভে রয়েল হলোওয়ে, প্লাইমাউথ, বার্মিংহাম, লন্ডন সাউথ ব্যাংক, ইউসিএল এসেঙ্, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, শেফিল্ড, ব্রিস্টল, সাউদাম্পটন, অঙ্ফোর্ড, ক্যামব্রিজ, লিডস, নিউক্যাসল, বোর্নমাউথ, কার্ডিফ, গ্ল্যাসগো ও এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। উইনচেস্টার, ক্যামব্রিজ, লিডস এবং লন্ডনেও স্কুলশিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের সমর্থনে তাদের ক্লাস বর্জন করেছে।
পৃথিবীজুড়ে উদার পুঁজি মুনাফা সর্বোচ্চকরণের যে প্রবণতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে এর পরিণামে এসব ছাত্র আন্দোলন। বিশ্লেষকরা বলছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন যা সাম্প্রতিক ব্রিটিশ ইতিহাসে একদমই বেমানান। শত শত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করছেন। শুধু ৩০ ডিসেম্বরই গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫৩ শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারীরা বেতন ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রচারযন্ত্র হিসেবে ইন্টারনেটকে বেছে নিয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সাইটে আন্দোলনকারীরা তাদের বক্তব্য প্রচার করছে। ফলে বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের ঢল নামছে। ব্রিটিশ পুলিশ বিক্ষোভ দমাতে দমন নিপিড়নকে বেছে নিলেও আন্দোলনকারীদের পিছপা হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষোভ যদি সরকার নেভাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে হয়তো খোদ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকেই এর জন্য দায়ী করবে আন্দোলনকারীরা; যার পরিণাম হবে আরো জটিল এবং ব্যাপক।
==============================
বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি  আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক'  আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন  গল্পালোচনা- 'আসি আসি করে আশিতে আসবে!'  রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ সবুজ মাঠ পেরিয়ে  স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে'  স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'  আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি'  গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...’  আন্তর্জাতিক- উইকিলিকসঃ হাটে হাঁড়ি ভাঙা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  গল্পসল্প- ওরা ধান কুড়ানির দল  শিক্ষা- আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই  জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অর্থের মূল উৎস সৌদি আরব  রাজনৈতিক আলোচনা- এমন বন্ধু থাকলে...  শিল্প-অর্থনীতি শেয়ারবাজারের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব  সাক্ষাৎকার- খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বিকল্প উপায় খুঁজতা হবে  খবর, প্রথম আলোর-  দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখবেন না  মার্কিন কূটনীতিকদের গোপন তারবার্তাঃ পাকিস্তানে জঙ্গি নির্মূলে ১০-১৫ বছর লাগবে  অধ্যাপক ইউনূসের অর্থ স্থানান্তর : গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যা  শিল্প-অর্থনীতি 'সময় এসেছে মাথা তুলে দাঁড়াবার'  প্রকৃতি- 'কিয়োটো প্রটোকল ভেস্তে যাচ্ছে, কানকুনে কী হবে?  আলোচনা- 'মেয়েদের লাঞ্ছনা বন্ধ করতে কঠোর হতে হবে'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আগ্নেয়গিরির ওপরে পিকনিক'  আলোচনা- 'হিমালয়ের কোলে এক টুকরো দক্ষিণ এশিয়া'  স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন'


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যর
লেখকঃ শামা মাহজাবীন
তথ্য সূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান ও ইউকেবেঙ্গলি


এই অলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.