আইএমএফ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসইসির চাপে টানা দরপতন

এক বছর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রথাগত ব্যাংকিং কার্যক্রমের বাইরে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের পূর্বাভাসের চেয়েও ভয়ংকর। অনেকগুলো বেসরকারি ব্যাংক তাদের মুনাফা ও অর্থ লগ্নির প্রধান উৎস করে ফেলেছে পুঁজিবাজার।
ব্যাংকগুলোকে অনুসরণ করে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তাও শিল্পঋণ নিয়ে সেই অর্থ পুঁজিবাজারে লগ্নি করে ফেলেছে। কিন্তু আর্থিক এই বিশৃঙ্খলাকে দ্রুত সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ পর্যবেক্ষণ দল। তারা ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে। আর্থিক খাতে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করার জন্য ৫০টি বিষয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছে তারা। এর মধ্যে একটি উল্লেখ্যযোগ্য হলো ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তার তথ্য। ধারণা করা হচ্ছে, এর প্রতিফলন গিয়ে পড়ছে দেশের শেয়ারবাজারেও। গতকাল মঙ্গলবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক নেমে গেছে ১৮৫ পয়েন্টে। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সূচক পড়েছে ৫০৩ পয়েন্ট।এর আগে অবশ্য ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুসারে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত নভেম্বরের মধ্যেই এসব অর্থ সমন্বয়ের নির্দেশ রয়েছে। জানা গেছে, যেসব ব্যাংক এখনো সীমার মধ্যে অর্থাৎ আমানতের ১০ শতাংশের মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নামিয়ে আনতে পারেনি, তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে যেসব বেসরকারি উদ্যোক্তা শিল্প ঋণসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে সেসব বিনিয়োগের অর্থ আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সমন্বয়ের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তার আগে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে তাদের এক কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণের টাকা প্রকৃত খাতে ব্যবহার হয়েছে কিনা সে তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে চড়া দামে কেনা শেয়ার বিক্রি করতে হচ্ছে কারও কারও। এই বিক্রির চাপেই বাজারে পরপর দুদিন অব্যাহত পতন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ‘বাংলাদেশ: ফাইনান্সিয়াল সিস্টেম স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এক বছর আগে বলেছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের ব্যাংকগুলো প্রথাগত ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের বাইরের কার্যক্রম দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। ব্যাংকগুলো ক্রমশই পুঁজিবাজারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা জোরদার করছে। আর একই কাজটি হচ্ছে, হয় সরাসরি অথবা সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। শেয়ারবাজারে পতন ঘটলে তা কোনো কোনো ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। অবশ্য সে পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতায়।বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ও অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বাজারে কোনো কিছু না বুঝেই ঢুকে পড়ছে। আর এ সুযোগের ফায়দা নিচ্ছে একটি চক্র। ব্যাংকসহ অন্যান্য বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই খেলায় জড়িয়ে পড়েছে। অনেকগুলো ব্যাংক বার বার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা সত্ত্বেও মোট আমানতের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে বসে আছে। অনেক বেসরকারি ব্যাংকের নজরদারির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ী-শিল্প উদ্যোক্তারাও ব্যাংক থেকে শিল্পঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে নেমে পড়েছে। এখন শৃঙ্খলার প্রশ্ন আসায় বাজারে তার চাপ বাড়ছে।এ ব্যাপারে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। এর আগে দেশের শেয়ারবাজার ছোট ও অনুন্নত থাকার ফলে অনেক নিয়মকানুন প্রয়োগের ব্যাপারে শৈথিল্য দেখানো হয়েছে। এখন তা আর চলতে দেওয়া হবে না। বিনিয়োগকারীদেরও শেয়ারের মান ও বাজার পরিস্থিতি বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে।জানা গেছে, নিয়মবর্হিভূত হলেও আগে অ্যাকাউন্ট-পেইয়ি বা ক্রস চেক ব্রোকারেজ হাউসে জমা দিয়ে শেয়ার কেনা যেত। কিন্তু গত ৬ ডিসেম্বর থেকে অ্যাকাউন্ট-পেইয়ি চেক দিয়ে শেয়ার কেনার সুবিধা বন্ধ করা ও এ নিয়ম প্রতিপালনে সবাইকে বাধ্য করা হচ্ছে।ফলে শেয়ারবাজারে হঠাৎ করে তারল্য প্রবাহ সাময়িকভাবে কিছুটা কমে গেছে। দুই দিন আগে যেখানে ডিএসইতে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে, গতকাল তা ছিল দুই হাজার ৫০ কোটি টাকা। আর সিএসইতে গতকাল সর্বমোট লেনদেন হয় ২৩০ কোটি টাকা, আগের দিনে তা ছিল ৩০৯ কোটি টাকা।এ ব্যাপারে সিএসইর ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ সাজিদ হুসাইন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসির শক্ত নির্দেশনার কারণে বাজারে ঋণের অর্থ সমন্বয় হচ্ছে। আইএমএফের প্রতিনিধিদল বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছে। তাদের আগমনে এই সমন্বয় দ্রুত করার জন্য চাপ আরও বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে সমন্বয়ের একটি চাপে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার।অ্যাসেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস অব বাংলাদেশের (এইমস) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াওয়ার সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে সব সময়ই দাতাদের চাপে সংস্কার ও শৃঙ্খলার বিষয়টি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নিজ উদ্যোগেই এসব পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে করে সংস্থাগুলোর ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়ে।’

No comments

Powered by Blogger.