প্রকৃতি- 'কিয়োটো প্রটোকল ভেস্তে যাচ্ছে, কানকুনে কী হবে' by মোস্তফা হোসেইন

'সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে...' প্রেমিকের কপালে ছোঁয়াবে বলে প্রেমিকার যে আকুতি, সে আকুতি ফুটে উঠেছে গানটিতে। এ গানে উঠে আসে সাগরের কোমলতা ও বিশালত্ব। আর আমাদের বলে দিতে হয় না এই সাগর যে আমাদেরই বঙ্গোপসাগর। কিংবা শচীন দেব বর্মণের সেই বিখ্যাত গান 'শোন গো দখিন হাওয়া...'।
শোনার পরও মনে হয় সুশীতল আরামের সেই হাওয়াও সুন্দর জলবায়ুরই প্রতিফলন। সেখানেও ভালোবাসা আর প্রকৃতির যোগসূত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাগরের সঙ্গে ভালোবাসার এ সহাবস্থান যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে সংগীতে-সাহিত্যে-শিল্পে। কিংবা শিল্পকে পাশ কাটিয়ে কেউ যখন তাকাবেন অর্থনৈতিক অবদানের দিকে; তিনি একবাক্যে বলে দেবেন, এ সাগর আমাদের সমৃদ্ধির সিঁড়ি। স্বপ্নের ভাষা নয়_বাস্তবেরই প্রমাণ। এ সাগর তাই বিশাল স্বপ্ন দেখানোর পাশাপাশি আমাদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে।
এবার যদি ওই সাগরপারের সুন্দরবনের দিকে তাকাই_ওহ! সন্দেহাতীতভাবে সেই সুন্দরবন আমাদের অহঙ্কারকেই শানিত করে। রয়েল বেঙ্গলের হুঙ্কার আসতে চাইবে অন্তত এই একটি ক্ষেত্রেও; কারণ বিশ্বের সেরা হওয়ার সুযোগ দিয়েছে এই সুন্দরবন। মনে করিয়ে দেবে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবে এ বনের নাম। নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, প্রকৃতি আমার দেশের বড় পরিচয়। আমিও প্রকৃতির প্রিয় সন্তান।
সাগরপারের জেলেপাড়া কিংবা সেন্টমার্টিনসের সুন্দর আর সুন্দর দেখা_সেও যে আমারই ভাগ্য বটে। কাঁকড়া-কাছিম, ঝিনুক-শামুক কোনটিকে বলুন বাদ দেব, সাগরপারের কথা এলে। একটু উজানে এসে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিতাস, গোমতী যখন সুতার মতো প্রাকৃতিক জাল বুনে আমার মাটিকে উর্বরতা দিয়েছে; তখনো তো আমাকে বলতেই হয়, শাবাশ বাংলাদেশ, সমৃদ্ধ তুমি প্রকৃতির গুণে।
জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা আমার দেশের সেই প্রকৃতির ওপর খৰ চালিয়েছে ভিনদেশি মানুষ। তাদেরই উদরপূর্তিতে আমার দেশের প্রকৃতি আজ বিপন্নপ্রায়। সেই যে সাগর যাকে নিয়ে গান হয়, সেই যে সুন্দরবন যাকে নিয়ে আমি অহঙ্কার করি; সবই আজ হুমকির মুখে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এমনকি স্বাভাবিক জোয়ারও ক্রমে বেশি করে গ্রাস করছে উপকূলীয় ভূমি। আর সাগর ক্রমেই আমাদের কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠছে। শচীন দেব যদি বেঁচে থাকতেন, না জানি কী বলতেন সাগরের এই উন্মত্ত রূপ দেখে।
বাংলাদেশের এক বিরাট এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটারের কম উচ্চতায়। সেই সমুদ্র যদি লাফিয়ে উঠতে থাকে ওপরের দিকে, তাহলে কী হবে দেশটির অবস্থা? ভবিষ্যতের ভয়ংকর চিত্র ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে জীববৈচিত্র্যে যে কুপ্রভাব পড়েছে, তা থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে মরিয়া হয়ে উঠতে হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে আঘাত হানার পাশাপাশি বসবাসের উপযোগিতাও হারাচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। যে কারণে ইতিমধ্যে উপকূলীয় মানুষ বাঁচার তাগিদে ধীরে ধীরে শহরের দিকে ঝুঁকছে। যার প্রভাব ঢাকায় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট থেকে শুরু করে বৃহত্তর বরিশালের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে বাঁচার জন্য বিকল্প পথ বের করতে গিয়ে ঢাকার ওপর চেপে বসতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে তাপমাত্রা পরিবর্তনের যে তথ্য পাওয়া গেছে তাও যদি বিবেচনায় আসে, সত্যিই চিন্তিত না হয়ে পারা যায় না। গ্রীষ্ম মৌসুমে এ দেশে গড়ে বার্ষিক তাপমাত্রা বাড়ছে দশমিক শূন্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষণা থেকেই বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে অর্থাৎ ২০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাতেও দেখা দেবে বিপর্যয়কর অবস্থা। তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে এখানকার প্রাণিজগতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে গবাদিপশু কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে। ফসল উৎপাদন হ্রাস পাবে, ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ বাড়তে থাকবে। এমনও হতে পারে যে ওই সব কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসল রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্যনিরাপত্তাও নাজুক হয়ে পড়বে পৃথিবীজুড়ে_এমন আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এমনও বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা চলতে থাকলে আগামী অর্ধশতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর ১০০ কোটি মানুষ খাদ্যাভাবে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাটির জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রের বিস্তৃতি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতা, মরুকরণ, অস্থায়িত্বশীল কৃষির চর্চা প্রভৃতি কারণে জমি সংকোচন ও উৎপাদন হ্র্রাস পেয়ে খাদ্যসংকট প্রকটতর হচ্ছে দিনের পর দিন। আর বাংলাদেশ এমনই একটি দেশ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অদূর ভবিষ্যতে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়লে বাংলাদেশে খাদ্যাভাব প্রকট হবে। কারণ দেশের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে, খাদ্যের উৎপাদনও সেভাবে বাড়া প্রয়োজন। বাস্তবে হবে উল্টোটা।
দুর্ভাগ্যজনক যে এ দুর্ভোগের প্রধান কারণ হচ্ছে ধনী পশ্চিমা দেশগুলোর ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা। তাদের উন্নত জীবনমান আরো উন্নত করার প্রয়োজনে তারা ক্রমাগতভাবে কার্বন নির্গমন বাড়িয়েই চলেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে যে ৫০টি দেশ মিলিতভাবে ২ শতাংশ কার্বন নির্গমন করে। আর সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই নির্গমন করে ২১ শতাংশ। এই হিসাব থেকে বোঝা যায় যে পৃথিবীর এ কার্বন নির্গমনের কারণে যে জলবায়ুর পরিবর্তন সাধন হচ্ছে, তার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র। একই ভূমিকা পালন করছে শিল্পোন্নত অপরাপর দেশগুলো। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, 'মানবাধিকার রক্ষা করো-মানবতা বাঁচাও' বলে চিৎকার করে যেসব দেশ ছড়ি ঘোরায়, সেসব দেশই নিজেদের ভোগ-লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য বাকি দুনিয়াকে মৃত্যুর মুখে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যাতে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলো চরম বিপর্যয়ের মধ্যে না পড়ে সেদিকে ধনী দেশগুলোর দৃষ্টি দিতে হবে। এ দাবি কোপেনহেগেনের সম্মেলনে জানানো হয়েছিল। কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল উন্নত বিশ্বের উপস্থিতিতে এবং তাদের সম্মতিতেও। তারপর বলা হয়েছিল, ১০ বিলিয়ন ডলার তহবিল জোগাড় করতে হবে ক্ষতি পুষিয়ে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ব্যয় করার জন্য। মেঙ্েিকার কানকুনে চলতি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের আবেদন খুব একটা সাড়া দেয়নি উন্নত দেশগুলো। বাংলাদেশ যথার্থ উদ্যোগ নিয়ে কিয়োটো এবং কোপেনহেগেন সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েও কার্যকর ফল দেখতে পায়নি। কোপেনহেগেনে যেমন সম্মেলনস্থলের নিকটবর্তী এলাকাজুড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে মিছিল-সমাবেশ হয়েছিল, এবারও তেমনি হচ্ছে। কিন্তু এটাও দেখতে হচ্ছে_ধনী দেশগুলো গাধার মুলো দর্শনের মতো কেবল আশ্বাসবাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এত দিন পর্যন্ত কোনো অর্থই পায়নি বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মুখ উঁচিয়ে দাঁড়ানো দরকার। অন্তত বুক উঁচিয়ে বলা দরকার, 'আমার নদী, আমার সাগর নষ্ট করার তুমি কে হে শক্তিধর। আমার জীবনের বিনিময়ে নিশ্চয়ই তোমার ভোগের তরী বাইতে দিতে পারি না। তুমি যেই-ই হও এবার অন্তত ক্ষান্ত দাও, মানুষ হত্যার এই ক্ষতিকর কাজ থেকে।'
যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন যারাই আমার সাগরতীরের মিষ্টি হাওয়াকে দূষিত করছে, তাদেরই দায় বহন করতে হবে এই অপরাধের। আর উন্নত দেশগুলো লাখ লাখ মানুষের জীবন হুমকিতে ঠেলে দিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ রোজগার করছে, সেসব মানুষের জন্য কিছু অংশ কি ব্যয় করতে পারে না? এটা অনুদান নয়_এ যে জীবনের মূল্য।
=============================
আলোচনা- 'মেয়েদের লাঞ্ছনা বন্ধ করতে কঠোর হতে হবে'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আগ্নেয়গিরির ওপরে পিকনিক'  আলোচনা- 'হিমালয়ের কোলে এক টুকরো দক্ষিণ এশিয়া'  স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!'  আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'  স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি  গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোস্তফা হোসেইন


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.