শেয়ারবাজারের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব

কোনো একটি দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও অবস্থা শেয়ারবাজারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উচ্চকর্মসংস্থান, নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাকার গুণ থাকলে শেয়ারবাজারও থাকে চাঙ্গা, স্থিতিশীল ও শক্তিশালী। অন্যদিকে, অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী হলে, বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে শেয়ারবাজারে পড়ে তার বিরূপ প্রভাব, নিস্তেজ ও অস্থির হয়ে ওঠে বাজার, দর পড়তে থাকে বিভিন্ন শেয়ারের। অবশ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ইতিবাচক সূচক না থাকলেও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়ে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। শেয়ারের সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নির্ভর করেও শেয়ারবাজার ওঠানামা করতে পারে। হঠাৎ করে অধিকসংখ্যক বিনিয়োগকারী বাজারে ঢুকে পড়লে এবং সে তুলনায় শেয়ারের পর্যাপ্ততা না থাকলে বাজার দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে চড়ে যায়। এ রকম চড়ে যাওয়া বাজার যেকোনো সংগত কিংবা অসংগত কারণে আবার দ্রুত পড়েও যায়। এ রকম সাময়িক ওঠানামার পর একসময় বাজার সংশোধিত হয়ে মূল্য স্থিতিশীল হয়। কিন্তু তত দিনে ঘটে যায় কারও পৌষ মাস আর কারও সর্বনাশ।
অনেকেরই ধারণা, কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়লে সেই প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, শেয়ারের দাম বাড়া বা কমার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির লাভ-লোকসানের সামান্যতম সম্পর্কও নেই। এতে কেবল প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষ তথা বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিফলন ঘটায়। মূলত শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হচ্ছে লাভের টাকা ঘরে তুলে বেশি দামে অন্য কাউকে সেটা গছিয়ে দেওয়া। এভাবে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী দর তুঙ্গে উঠে নিম্নমুখী হওয়ার সময় যাঁর হাতে শেয়ারগুলো থাকে, তাঁর হয় সর্বনাশ; বাকি যাঁরা দাম ওঠার সময় ছেড়ে মুনাফা ধরে নিয়েছেন, তাঁদের হয় পৌষ মাস। শেয়ারবাজারে মানুষের এই প্রবৃত্তিটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ও লেখক বার্টন জি ম্যালকিলের ‘আরও বড় নির্বোধ’ তত্ত্বে। তাঁর মতে, যেকোনো কারণেই হোক কোনো শেয়ারের দাম যৌক্তিক বা অযৌক্তিক হারে বাড়তে পারে এবং বাড়তে বাড়তে পৌঁছাতে পারে একটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে। এমন অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা আকাশছোঁয়া দামের অযৌক্তিকতা স্বীকার করেও সেটা কিনতে পারেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, ওই শেয়ারটি আরও বেশি দামে অন্য (অর্থাৎ তাঁর চেয়ে আরও বড় নির্বোধ) কারও কাছে বিক্রি করে দেওয়া যাবে। যদি সেটা সত্যিই ঘটে, তবে তাঁর পৌষ মাস। তাঁর ক্রেতাটি আর কারও কাছে বিক্রি করার আগেই আচমকা কোনো কারণে যখন শেয়ারটির মূল্যপতন শুরু হয়, তখন সেটি কেনার মতো আর কোনো বড় নির্বোধকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আতঙ্কিত মানুষের বিক্রির চাপে তখন দাম কমতে থাকে ওপর থেকে ছেড়ে দেওয়া পাথরখণ্ডের মতো। অনেক বেশি দামে শেয়ার কিনে ক্রেতাটির তখন সর্বনাশ।
আমাদের বাজারে শেয়ারের পর্যাপ্ততার বিষয়টি সাম্প্রতিক কালে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ, সীমিতসংখ্যক শেয়ারের পেছনে ছুটছেন বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী। এতে করে শেয়ারবাজারে বিরাজ করছে মুদ্রাস্ফীতির মতো পরিবেশ। বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সরকারি তরফ থেকেও বাজারে নতুন শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের নতুন শেয়ার বাজারে আনার বিষয়টি সরকারের ইচ্ছাধীন নয় বলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগের কথা বিধৃত হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর তাগিদের মাধ্যমে। নতুন শেয়ার ছাড়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বাজারে কখন নতুন শেয়ার আসবে, সে কথা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তত দিনে স্রোতের মতো বাজারে ঢুকে পড়বেন আরও বহুসংখ্যক বিনিয়োগকারী। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে শেয়ারবাজারে যে বিশাল জোয়ার এসে একসময় সেটা পর্যবসিত হয়েছিল বিধ্বংসী ভাটায়, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন অগণিত অভিজ্ঞতাহীন নব্য বিনিয়োগকারী। সে সময় প্রস্তুতিহীন বাজার এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন বিনিয়োগকারীদের কার্যকলাপ নিয়ে বহু ধরনের সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছিল, কিন্তু ফলোদয় হয়নি তাতে। সে তুলনায় অবশ্য এখনকার বাজার আরও সংহত, প্রস্তুত ও গভীর। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি এবং তথ্যপ্রযুক্তির সমারোহও বিস্তৃত। ফলে দেড় দশক আগের দুঃস্বপ্ন এখন হয়তো আমাদের আর তাড়া করে বেড়ায় না। তবুও নতুন ও অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের বিবেচনাহীন আচরণে আশঙ্কা থেকেই যায়।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রধান পূর্বশর্তগুলো না মেনে, বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরণ না করে, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, ব্যবসায়িক ইতিহাসের তথ্য না জেনে, এমনকি বাজার কার্যক্রমে ব্যবহূত বিভিন্ন শব্দের অর্থ বা সংজ্ঞা না বুঝেও বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী শেয়ারে অর্থলগ্নি করে বসে আছেন। শেয়ার কেনার ব্যাপারে এঁদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে গুজবের ওপর, কিংবা অন্যকে অনুসরণ করার প্রবণতা থেকে। ঠিক এ রকম অবস্থাকেই বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ব্যাখ্যা করেছিলেন পত্রিকার সুন্দরী প্রতিযোগিতার উদাহরণ দিয়ে। এই তুলনার মাধ্যমে তিনি দেখান যে অধিকাংশ মানুষ বিনিয়োগ করার সময় কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা কিংবা মুনাফার পূর্বাভাস বিবেচনা করেন না, তাঁদের মূল বিবেচনা নির্ভর করে অন্য বিনিয়োগকারীদের আচরণের ওপর। কেইনস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ জেনারেল থিওরি অব এমপ্লয়মেন্ট ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানিতে শেয়ারবাজারের ওঠানামার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে এই ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। কেইনস লক্ষ করেন, শেয়ারবাজারে মানুষের বিনিয়োগের সহজাত প্রবণতা তখনকার সময়ে লন্ডনের একটা কাগজের জনপ্রিয় সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পাঠকদের মানসিকতার সঙ্গে মিলে যায়।
প্রতিযোগিতাটা ছিল এ রকম: কাগজে ছাপা হতো ১০০ জন সুন্দরীর ছবি, পাঠকদের তার মধ্য থেকে ছয়জন সেরা সুন্দরীকে নির্বাচন করে পাঠাতে হতো। সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া সুন্দরীকে যাঁরা নির্বাচন করতেন, তাঁদের দেওয়া হতো পুরস্কার। ফলে নির্বাচনকারী পাঠকেরা চেষ্টা করতেন বেশির ভাগ পাঠক যাঁদের ভোট দেন, সেসব সুন্দরীকে নির্বাচিত করতে। অথচ অংশগ্রহণকারী পাঠকদের জন্য স্বাভাবিক আচরণ ছিল নিজের বিচারে যে ছয়জনকে বাকিদের চেয়ে বেশি সুন্দরী বলে মনে হয় তাঁর পক্ষে ভোট দেওয়া, কিন্তু তাতে বেশির ভাগ মানুষের দলভুক্ত না হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সৌন্দর্য বিচারে পাঠকেরা নিজের বিবেচনাকে প্রাধান্য না দিয়ে বেশির ভাগ মানুষ যেদিকে ঝোঁকে, সেদিকে দলভুক্ত হতে চাইতেন।
কেইনস মনে করেন, বিনিয়োগকারীরাও সেই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মতো কোম্পানির মৌলিক আর্থিক সূচকসমূহ, যথা: প্রত্যাশিত আয়, লাভ ইত্যাদি বিবেচনা উপেক্ষা করে নজর রাখেন বাজার তথা বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী কোন দিকে যান, সেদিকে। ফলে বাজার হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। কারণ, বিনিয়োগের মূলনীতিগুলো তখন আর প্রাসঙ্গিক থাকে না। আর যাঁরা স্বল্প সময়ে খুব সফলতা লাভ করেন, তাঁরা বিবেচিত হন সৌভাগ্যবান হিসেবে এবং অধিকাংশ মানুষের মনস্তত্ত্ব সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা। কারণ, একটা শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন বহু বিনিয়োগকারী পাওয়া যায়, যাঁরা সেটা আরও বেশি দামে কিনতে প্রস্তুত থাকেন (আরও বড় নির্বোধ-তত্ত্ব অনুসারে)। বাজারে সাধারণত দুই ধরনের শেয়ার কেনা যায়: একটা হচ্ছে ক্রেতা যেটাকে সবচেয়ে ভালো মনে করেন, যেমন সঠিক মূল্যায়িত দামে অথবা খুব ভালো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার; আর অন্যটা হচ্ছে যেটাকে অন্যরা ভালো মনে করেন। কেইনস মনে করতেন, বেশির ভাগ মানুষ দ্বিতীয় ধরনের শেয়ার কিনতে চান, অর্থাৎ যেটিকে অন্যরা সুন্দর মনে করেন (সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব অনুসারে)। ফলে অধিকাংশ ক্রেতা যেদিকে ছোটেন, বাকিরা তাঁদের অনুসরণ করেন। এতে সেই শেয়ারের বাজার চড়ে যায়। বেশির ভাগ মানুষের এই প্রবণতাই কেইনসের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্বের মূলকথা।
তবে কেইনসের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ধারণা করা ঠিক হবে না যে তিনি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কিংবা ফাটকাবাজারির বিরোধী ছিলেন। ফাটকাবাজির যে ক্ষণস্থায়ী কিছু সুফল আছে, কেইনস সে কথা অস্বীকার করেননি। তিনি বলতেন, এই প্রবণতা যেন ব্যবসায়ী উদ্যোগকে অতিক্রম করে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সে বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী উদ্যোগের স্থিতিশীল ধারায় বুদ্বুদের মতো ফাটকাবাজদের আবির্ভাব হলে হয়তো কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কিন্তু ফাটকাবাজির ঘূর্ণাবর্তে যখন ব্যবসায়ী উদ্যোগ বুদ্বুদের মতো আবির্ভূত হয়, তখন অবস্থাটা হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক।’ দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োজিত সম্পদ ধরে রাখলে কোনো ব্যবসায়ের উৎপাদনশীলতা এবং মুনাফার সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হয়, কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ফাটকাবাজারিতে প্রকৃত মূলধন বৃদ্ধির তেমন কোনো সুযোগ থাকে না, বরং সেটা হয়ে পড়ে জুয়া খেলার মতো। কেইনস বলেছেন, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং শেয়ারবাজার যেন কোনোভাবেই জুয়ার আসরে পরিণত না হয়, সে ব্যাপারে সবিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, কেইনস নিজেও খুব সফল বিনিয়োগকারী ছিলেন। ১৯২৯ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর তাঁর প্রায় সব বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি সে ক্ষতি পুনরুদ্ধার করে নিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল বর্তমান বাজারে প্রায় এক কোটি পাউন্ডের ওপর।
অর্থনীতিবিদ কেইনসের ধারণা ও দক্ষতা হয়তো আমাদের অভিজ্ঞতাহীন বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারবেন না, কিন্তু তিনি সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্বের মাধ্যমে যে সহজ বার্তাটি আমাদের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন, আমরা অন্তত সেটা স্মরণে রাখতে পারি, অর্থাৎ অন্ধের মতো বাজারের অধিকাংশ বিনিয়োগকারীকে অনুসরণ করার চেষ্টা না করি এবং স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ যে তাঁর ভাষায় ‘পেশাদার বিনিয়োগের খেলা,’ সেটাকে জুয়া খেলায় পর্যবসিত না করি।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.