গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন

শ্রাবণ মাসের আকাশ আজ ঝকঝকে তকতকে। মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। বিকেল হয়ে আসা রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। এরকম উজ্জ্বল দিনে মা মুখ কালো করে বসে আছেন বারান্দায়। দূর থেকে মাকে একবার দেখলো রাজু।

তারপর সামনে এসে দাঁড়াল। এখানে এভাবে বসে আছো?
মা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। ঘরে খুব গরম। দিনেরবেলা ইলেকট্রিসিটি আজকাল থাকেই না।
রাজু হাসলো। ঢাকা শহরেই ইলেকট্রিসিটি থাকে না, আর এ তো গ্রাম।
গ্রামে তো পলস্নীবিদু্যৎ। এটা না থাকার কী হলো?
একেবারেই থাকে না, মা?
থাকে। সন্ধ্যার দিকে দুতিন ঘণ্টার জন্য আসে তারপর সারারাত সারাদিন আর কোনও খবর নেই।
ওটা কোনও থাকা হলো?
মা কথা বললেন না। একটু যেন উদাস হলেন।
বারান্দায় বহুকালের পুরনো দুটো হাতলঅলা চেয়ার। একটাতে মা বসে আছেন, পাশের চেয়ারটিতে বসল রাজু। তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম মা।
মা রাজুর দিকে তাকালেন। কী কথা, বাবা?
নীলু আমার এত প্রিয়বন্ধু। এই প্রথম তাকে আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। মায়া আমাদের কোনও খোঁজখবরই করে না। কাল সন্ধ্যায় এলাম। আসার পর একবার শুধু আমার সঙ্গে দেখা হলো। কোনও রকমে বলল, কেমন আছো ভাইজান? তারপর আর কোনও খবরই নেই। সন্ধ্যা গেল, রাত গেল, আজকের দিনটা শেষ হয়ে বিকেল হয়ে গেল, একবারও দেখলাম না মায়াকে।
মেয়েটা দিন দিন আরও বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছে।
এবার রাজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হওয়ারই কথা। তুমি যে কী ভুলটা করলে মা?
মায়ের মুখ আবার কালো হলো। উঠোনের দিককার নিমগাছটির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। এসময় রাজু শুনতে পেল তার মাথার ওপর অতিমৃদু পিক পিক শব্দ হচ্ছে। একটানা শব্দ না, থেকে থেকে হচ্ছে। শব্দটা বোধহয় আগেও হচ্ছিল, রাজু খেয়াল করেনি। এবার মুখ তুলে ওপর দিকে তাকাল। তাকিয়ে অবাক। বাঁশের ছোট্ট খাঁচায় শুকনো পাতা দিয়ে পাখির বাসার মতো তৈরি করা হয়েছে। বাসার সামনে মাটির ছোট্ট দুটো খোরার একটিতে সামান্য পানি, অন্যটিতে খুদ আর কাউন মিশানো। ছাই রংয়ের ছোট্ট একটা পাখি জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। ঠোঁটের দুপাশে গোলাপি আভা। অর্থাৎ এখনও সাবালক হয়নি পাখিটি। ছানা। উড়তেও শেখেনি।
রাজু মায়ের দিকে তাকাল। কী পাখি মা?
বুলবুলির ছা।
এইটুকু ছা খাঁচায় আটকে রেখেছে কে?
মায়া।
পেলো কোথায়?
বাগানের ওদিককার বাবলা গাছে বাসা বেঁধেছিল বুলবুলি। সেদিন বৃষ্টির সঙ্গে বেদম দমকা হাওয়া। একটাই ছা ছিল বাসায়। দমকা হাওয়ায় ছিটকে পড়েছে গাছতলায়। বাগানের দিকে গিয়ে মায়া দেখেছে ঘাসের ওপরে পড়ে চিঁ চিঁ করছে। একটা কাক চেষ্টা করছে ধরতে। ধরতে পারলেই ঠুকরে খাবে। মায়া দুহাতের মুঠোয় করে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। খাঁচায় রেখে দিয়েছে।
কিন্তু এভাবে তো এটা বাঁচবে না। এখনও ঠুকরে ঠুকরে খেতে শিখেনি। না খেলে বাঁচবে কী করে?
খাওয়ার ব্যবস্থা মায়াই করে। দুতিন ঘণ্টা পর পর খাঁচা থেকে বের করে আস্তে করে ঠোঁট ফাঁক করে খুদ-কাউন দেয় মুখে। পানি দেয়।
পাখিটা ওভাবে খায়?
খায়। প্রথম দিন ভেবেছিলাম, এখনই মরবে। তারপর দেখি, না, ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে। এখন তো বেশ ভাল। মায়াকে দেখলেই যেন মাকে দেখছে এমন ভঙ্গিতে ডানা কাঁপাতে থাকে। পিক পিক করে ডাকে, নিজ থেকে হা করে।
আশ্চর্য।
হঁ্যা।
মায়া এটা পালবে?
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, না। বড় হলে, উড়তে শিখলে ছেড়ে দেব।
সে এখন কোথায়?
ওর ঘরেই আছে।
যাই, একটু কথা বলি মায়ার সঙ্গে।
মায়ার পরনে পাতা রংয়ের শাড়ি।
তার রুমের উত্তরদিকে জানালা। সেই জানালার গ্রিল ধরে দরজার দিকে পিছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়া। বাইরে নানা ধরনের গাছপালা, ফুলের ঝাড়। দুটো জামগাছ গলাগলি করে আছে। গাছ দুটোর ডালপালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছ আকাশের অনেকখানি। বিকেলবেলার রোদে আকাশ যেমন ঝকমক করছে, গাছপালাও তেমন। চারদিকে যেন আলোর বন্যা। দুটো শালিক পাখি ওড়াউড়ি করছে শিউলি ঝোপের ওদিকে।
মায়া এসবের কিছুই দেখছে না। সে আছে উদাস হয়ে, বিষণ্ন হয়ে।
নিঃশব্দে কে এসে তার কাঁধে হাত দিল। মায়া পিছন ফিরে তাকালো। রাজু দাঁড়িয়ে আছে। মায়া কথা বলবার আগেই রাজু মস্নান গলায় বলল, এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছিস কেন?
মায়া জানেই না কখন কাঁদতে শুরু করেছে। কখন নিজের অজান্তে চোখের জলে গাল ভাসছে তার।
রাজুর কথায় বুঝতে পারল। শাড়ির অাঁচলে চোখ মুছল।
পরিবেশ বদলে দেয়ার জন্য রাজু বলল, কী রে, আমরা বাড়িতে এলাম, তুই দেখি আমাদের সামনেই আসিস না?
মায়া কোনও রকমে বলল, আমার ভালো লাগে না।
ভাই, ভাইয়ের বন্ধু, তাদেরকে ভালো না লাগার কী আছে?
আমার কিছুই ভালো লাগে না।
রাজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি তোর মন খারাপের কারণটা বুঝি।
সত্যি বোঝ?
কী আশ্চর্য কথা! বুঝবো না?
তাহলে বলছো কী করে, ভালো না লাগার কী আছে?
না মানে আমি বলতে চাইছি, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এই নিয়ে আরঃ
কান্নাভেজা চোখে রাজুর দিকে তাকালো মায়া। দুঃখি গলায় বলল, এই নিয়ে আমি কোনও অভিযোগ করিনি ভাইজান।
সব অভিযোগ করতে হয় না। বোঝা যায়।
আমি তোমাকে বোঝাতেও চাইনি।
এই যে কাঁদছিস, এতেই তো বোঝা যাচ্ছে।
তুমি এসময় আমার রুমে আসবে এটা আমি জানতাম না। জানলে কাঁদতাম না। আর আমি ঠিক বুঝতেও পারিনি কখন চোখে পানি এসেছে।
এটা হচ্ছে বিষণ্নতার লক্ষণ। বিষণ্নতা এক ধরনের রোগ।
মায়া কথা বলল না।
রাজু বলল, দিন দিন যে রকম বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছিস, পরে না বড় রকমের অসুখ-বিসুখ হয়ে যায়।
মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমাকে নিয়ে ভেবো না।
তোকে নিয়ে ভাববো না? কী বলছিস, মায়া?
ঠিকই বলছি। আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে ভেবো না।
কথা বলতে বলতে আবার চোখে পানি এসেছে মায়ার। নিজেকে সামলাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো সে। দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে, রাজু চট করে তার হাত ধরল। দাঁড়া।
মায়া বাধ্য হয়ে দাঁড়াল। মুখটা নিচু করে রাখল।
রাজু বলল, তুই আমার বোন। তোর মন খারাপ দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।
মায়া চোখ মুছল, রাজুর দিকে তাকাল। আসলেই কি আমি তোমার বোন?
রাজু হতভম্ব। কী বলছিস, মায়া?
ঠিকই বলছি। বোন হলে তুমি এটা মেনে নিয়েছিলে কেন?
তুই তো জানিসই কেন মেনে নিয়েছিলাম।
না আমি জানি না। পরিষ্কার করে বলো।
মা'র ওপর কথা বলবার ক্ষমতা ছিল না।
ঠিক বললে না।
অবশ্যই ঠিক বলেছি।
না। আমি যদি সত্যি তোমার আপনবোন হতাম, জবাবটা এমন দিতে না।
রাজু অসহায় গলায় বলল, কী যে বলছিস তুই?
ভাইজান, বারান্দার খাঁচায় যে বুলবুলির বাচ্চাটা আছে, নিজেকে আমার এখন ওই বাচ্চাটার মতো মনে হয়। দমকা হাওয়ায় বাসা থেকে পড়ে গেছে। উড়তে শেখেনি, নিজে নিজে খেতে শেখেনি। বাসায় মা বুলবুলি, বাবা বুলবুলি আগলে রেখেছিল। ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে ডানার আড়ালে রেখে বাঁচিয়ে ছিল। তারপরও ছিটকে পড়েছে মাটিতে। কাকপক্ষীতে ছিঁড়ে খাবে বলে আমি তুলে খাঁচায় রেখেছি। আমার জীবনটা ভাইজান ওই বুলবুলির বাচ্চাটির মতো। আগে কখনও আমার এমন মনে হয়নি। আজকাল মনে হয়। বাচ্চাটি খাঁচায় থেকে থেকে বড় হবে, নিজে নিজে খেতে শিখবে, উড়তে শিখবে, তারপর খাঁচার দরজা খুলে দেব আমি, পাখিটি যেদিকে ইচ্ছে উড়ে চলে যাবে। আমাকেও তোমরা সেভাবেই উড়িয়ে দিচ্ছো।
মায়ার চোখে আবারও পানি এলো। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
রাজু তখন পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজু বললঃ
মায়া উঠোন পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, মায়ের কথা শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। আমাকেও বলেছে।
মা খুশি হলেন। তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
হঁ্যা।
কোথায় দেখা হলো?
এত কথা বলবার দরকার নেই। বলো কী করতে হবে?
না মানেঃ
বলে ফেল। কোনও অসুবিধা নেই। তোমার সব কথাই তো শুনেছি। এটাও শুনবো।
মা এগিয়ে এলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তোর কথায় মনে হচ্ছে খুব বড় অন্যায় আমি করে ফেলেছি। আমার কাছে আসিস না, ঠিকমতো কথা বলিস না, এমন কী আমার দিকে ভালো করে তাকাসও না। মনে হয় আমার ওপর তোর অনেক রাগ, অনেক অভিমান। অভিযোগেরও যেন শেষ নেই।
না তোমাদের কারো ওপর আমার কোনও রাগ নেই। অভিমান অভিযোগ কিচ্ছু নেই।
আছে। তুই মুখে না বললেও আমি তা বুঝি।
মায়ার কাঁধে হাত রাখলেন মা। কোনও মা কি চায় তাঁর মেয়ের জীবন নষ্ট হোক?
চোখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাল মায়া। আমি কি সত্যি তোমার মেয়ে?
মা চমকালেন। কী বলছিস মায়া? এটা তুই কী বলছিস?
ভেবে দেখো কী বলছি।
ভাবার কিছু নেই।
অবশ্যই আছে।
না, নেই। আমি মনে করি, শুধু পেটে ধরলেই মা হওয়া যায় না। কোলে পিঠে করে, স্নেহ মমতায়, আদরে সোহাগে, শাসনে ভালোবাসায় যাঁরা বড় করেন তাঁরাই প্রকৃত মা।
সমস্যাটা এখানেই।
তোর কথা আমি বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। তুমি ভালোই বুঝেছ।
মা কঠিন গলায় বললেন, না বুঝিনি। তুই আমাকে বল।
শুনতে তোমার ভালো লাগবে না।
তাও আমি শুনবো।
তাহলে শোনো, গর্ভে ধরা মেয়েকে নিয়ে মায়েরা এক রকম ভাবে, গর্ভে না ধরাদের নিয়ে অন্যরকম ভাবে। তুমি আমাকে নিয়ে যেমন ভেবেছো।
ভুল কথা।
না এটাই সত্য কথা।
আমি তোর খারাপের জন্য কিছুই করিনি।
এরচে' খারাপ আর কী হতে পারে?
তুই ছেলেমানুষ। এখনও জীবন সম্পর্কে বুঝতে শিখিসনি। আমি জানি, আমি যা করেছি তাতে তুই ভালো থাকবি। খুব ভালো থাকবি।
মায়া উদাস গলায় বলল, শুধু আমিই জানি আমি কেমন থাকবো।
মায়া পুকুরঘাটের দিকে চলে গেল।
নীলুর পরনে গ্যাপের বস্নু জিনস আর সাদা টিশার্ট।
উঁচু পালঙ্কের মাথার দিকটায় হেলান দিয়ে বসে আছে সে। হাতে রবীন্দ নাথের সঞ্চয়িতা। আনমনে পাতা উল্টাচ্ছে। ঘরে ঢুকে রাজু যে আনমনা হয়ে বসে আছে জানালার ওদিককার চেয়ারটায়, অনেকক্ষণ খেয়ালই করেনি নীলু। হঠাৎই খেয়াল হলো। তীক্ষ্নচোখে বন্ধুকে কয়েক পালক দেখে বলল, মনটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে বন্ধু? ঘটনা কী?
রাজু নীলুর দিকে তাকাল। মায়ার সঙ্গে কথা বলে এলাম তোঃ
কথাটা বুঝেও না বোঝার ভান করল নীলু। কার সঙ্গে কথা বলে এলি?
মায়ার সঙ্গে।
মায়া যেন কে?
ফাজলামি করিস না।
না না ফাজলামো না। বল না, মায়া কে?
নীলুঃ
না না আমি শুনতে চাই, মায়া কে?
রাজু গলা উঁচিয়ে বলল, আমার বোন। একমাত্র বোন। বুঝেছো, শালা!
বুঝলাম তো, গালাগাল করছিস কেন?
পাছায় যে লাত্থি মারিনি এটাই বেশি।
পাছা বলো না বন্ধু। বলো পশ্চাৎদেশ। আমি কবিতা পড়া মানুষ, খারাপ শব্দ একদম সহ্য করতে পারি না। তবে আমার উচিত তোমার পশ্চাৎদেশে একখানা লাথি মারা।
কেন?
বোনের সঙ্গে কথা বললে যার মন খারাপ হয় তার পশ্চাৎদেশে লাথিই মারা উচিত। ওই ব্যাটা, ছোটবোনের চে' প্রিয়মানুষ আর কে হতে পারে রে? 'সে আমার ছোটবোন' বলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেন মান্না দে, আর তুই বলছিস ছোটবোনের সঙ্গে কথা বলে তোর মন খারাপ হয়েছে?
হলে বলবো না!
এ কথার ধার দিয়েও গেল না নীলু। বলল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনিস?
আগে চিনতাম না। তুই চিনিয়েছিস।
বলতো কে?
কবি।
শুধু কবি না, সব। রবীন্দ নাথের মতো সবকিছুই লেখেন। তাঁর জীবনের সবচাইতে বড় দুঃখ কি জানিস?
না জানি না। জানার আগ্রহও নেই।
আগ্রহ না থাকলেও জানতে হবে। শোন, সুনীলের জীবনের সবচাইতে বড় দুঃখ তিনি কন্যা সন্তানের পিতা হতে পারেননি।
তাতে কী হয়েছে?
ধুর ব্যাটা, তোর সঙ্গে এসব বলে লাভ নেই। যে পুরুষ কন্যা সন্তানের পিতা হননি পিতা হিসাবে তিনি অসম্পূর্ণ।
বুঝলাম, এসবের সঙ্গে মায়ার কী সম্পর্ক?
ঘুরিয়ে পঁ্যাচিয়ে সম্পর্ক একটা আছে।
বুঝিয়ে বল।
না বলবো না।
কেন?
তোর মতো গরুর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
তারপরও বল বাপ। আমি তোর বন্ধু না?
ঠিক আছে। এত করে যখন বলছিস, তাহলে বলি। কন্যা সন্তানের পিতা না হলে কোনও কোনও পুরুষ যেমন নিজেকে ব্যর্থ মনে করেন, ছোটবোনের ভাই না হলেও কোনও কোনও ভাই নিজেকে ব্যর্থ মনে করেন। এবার বুঝেছো চান্দু?
বুঝলাম। তোর জীবনের সবচাইতে বড় দুঃখ তোর কোনও ছোটবোন নাই।
ছোটবোন কী রে ব্যাটা, বড়বোনও নাই। বড় একটা ভাই আছে, সেটা তার বউ-বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় থাকে। আর আছে প্রায়বৃদ্ধ একটা বাপ, তিনি আছেন তাঁর ব্যবসা নিয়ে। তবে আমার ফাদারটির কোনও তুলনা হয় না। জিনিস একটা। তার মানে দাঁড়াল আমার ভাই আছে, বাপ আছে। ভাইয়ের বউটাকে বড়বোন ধরলে সেটাও আছে, শুধু ছোটবোনটাই নাই।
আমার আছে।
থেকে লাভ কী চান্দু? বোনের কাছ থেকে তো মন খারাপ করে এলি।
রাজু উঠল। বিকেল শেষ হয়ে এলো। চল বাজারের দিকে যাই।
কেন?
ঘুরে-টুরে মন ভালো করে আসি।
তুই যা। আমার বেরুতে ইচ্ছা করছে না।
এরকম একটা বিকেল ঘরে বসে কাটিয়ে দিবি?
না তোদের বাগানের দিকে যাবো, পুকুরঘাটের দিকে যাবো। সঙ্গে রবিবাবু থাকবেন। শ্রাবণ মাসের বিকেল শেষ হয়ে আসা আলোয় তাঁর কোনও কবিতা পড়বো। আকাশ দেখবো, গাছপালা দেখবো, বাঁধানো পুকুরের স্বচ্ছ জলে দেখবো নিজের ছায়াঃ। যা যা ভাগ। আমাকে একা থাকতে দে।
ঠিক আছে বাপ, একাই থাকো। বুয়াকে বলে যাই চা দিতে।
রাইট। এই না হলে বন্ধু। এখন একমগ চা লাগবেই।
এখানেই দিতে বলবো, নাকি বাইরে কোথাও গিয়ে বসবি?
এখানেই দিতে বল।
এই বাড়ির বুয়াটির নাম শুকতারা।
বয়স চলিস্নশের কাছাকাছি। গ্রাম এলাকার এই শ্রেণীর মানুষদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। শুকতারার হয়নি। ছোটখাটো গড়নের মানুষ। গায়ের রং কালো। তবে শরীরের বাঁধনটা ভালো। বয়স বোঝা যায় না। সময় মতো বিয়ে হয়নি বলে মেজাজ একটু খিটখিটে। ওই খিটখিটে মেজাজ নিয়েই সারাক্ষণ কাজ করছে। খানিক আগে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল রাতের রান্না করতে। রাজু এসে বলে গেল নীলুকে যেন একমগ চা দিয়ে আসে। শুকতারার স্বভাব হলো মানুষের মুখের ওপর কোনও কথা সে বলবে না, বলবে আড়ালে। রাজু চায়ের কথা বলতেই কেলানো হাসিটা হেসে বলেছে, আইচ্ছা ভাইজান, দিতাছি ভাইজান। অক্ষণই দিতাছি। কোনও অসুবিধা নাই। একমগ ক্যান, আপনে কইলে তিনমগ চা তারে আমি দিয়ামু। হে হে হেঃ
রাজু চোখের আড়াল হতেই বলল, তর বন্ধুরে না, তর গলা দিয়া পুরা একমগ চা আমি ঢাইলস্না দিমু। ফাজিলের ঘরের ফাজিল।
তারপর চা ঠিকই একমগ বানালো। চা খুবই ভালো বানায় সে। রান্নাবান্না ভালো, কাজকাম পরিচ্ছন্ন। খুঁত বলতে কিছুই নেই, ওই শুধু আড়ালে কথা বলা। তাও এত নিচু স্বরে বলে, নিজে ছাড়া অন্য কেউই শুনতে পায় না।
চায়ের মগ হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে শুকতারা, পুকুরঘাটের ওদিক থেকে মায়া এসে সামনে দাঁড়াল। শুকতারা নিঃশব্দে মুখটা কেলিয়ে দিল। হে হেঃ
মায়া বলল, একমগ চা নিচ্ছো কার জন্য?
ভাইজানে বাইরে গেল। যাওনের সময় বইলা গেলঃ
বুঝেছি।
কী বুজছেন, আফা? হে হেঃ
সেটা তোমার বুঝবার দরকার নেই। দাও, আমাকে দাও।
আপনে ভাইজানের বন্ধুর জন্য চা লইয়া যাইবেন?
মায়া বিরক্ত হলো। তাতে তোমার কোনও অসুবিধা আছে?
ওই দ্যাখো আফায় কয় কী! আমার কিয়ের অসুবিদা? আমার আরও সুবিদা। চা লইয়া অতদূর যাইতে হইল না। এই বাড়ির উঠান হইল তেপান্তরের মাঠের লাহান। পাড়ি দিতে সময় লাগে। হে হে, হে হে।
চায়ের মগ হাতে নিয়ে শুকতারাকে ছোটখাটো একটা ধমক দিল মায়া। তোমার এই বিশ্রি হাসিটা আমার সামনে হাসবে না। শুনলে গা জ্বলে যায়।
শুকতারা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আইচ্ছা হাসুম না। হে হেঃ
আবার?
না না ঠিক আছে। হেঃ
পুরো হাসিটা না হেসেই থেমে গেল শুকতারা। কিন্তু মায়া উঠোন পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই নিজের চরিত্রটা সে প্রকাশ করল। মুখ ভেংচে বলল, ইস, আমার হাসি বিচ্ছিরি! আর তর হাসি হইল সুচ্ছিরি! ফাজিলের ঘরের ফাজিল।
তোমার কাছে চাইনি কিছু, জানাই নি মোর নাম,
তুমি যখন বিদায় নিলে নীরব রহিলাম।
একলা ছিলেম কুয়ার ধারে নিমের ছায়াতলে,
কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে।
আমায় তারা ডেকে গেল, 'আয় গো বেলা যায়'।
কোন্ আলসে রইনু বসে কিসের ভাবনায় ।।
পদধ্বনি শুনি নাইকো কখন তুমি এলে।
কইলে কথা ক্লান্তকণ্ঠে করুণ চক্ষু মেলে-
'তৃষাকাতর পান্থ আমি।' শুনে চমকে উঠে
জলের ধারা দিলেম ঢেলে তোমার করপুটে।
মর্মরিয়া কাঁপে পাতা, কোকিল কোথা ডাকে-
বাবলা ফুলের গন্ধ উঠে পলস্নীপথের বাঁকে ।।
যখন তুমি শুধালে নাম পেলেম বড়ো লাজ-
তোমার মনে থাকার মতো করেছি কোন্ কাজ!
তোমায় দিতে পেরেছিলাম একটু তৃষার জল,
এই কথাটি আমার মনে রহিল সম্বল।
কবিতার দুটো লাইন বাকি আছে, সেই দুটো লাইন না পড়ে আনমনে দরজার দিকে তাকিয়েছে নীলু, দেখে ছবির মতো এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে দুঃখি রাজকুমারির মতো আলো, হাতে চায়ের মগ। পরনের পাতা রংয়ের শাড়িখানায় খুব মানিয়েছে তাকে! শাড়ি পরার ঢং অপূর্ব। কী যে মিষ্টি, মায়াবী মেয়েটি। তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। চোখ ফিরানোই যায় না।
তবু নিজের চোখকে শাসন করল নীলু। কবিতার শেষ দুটো লাইন পড়া বাকি, মনেই রইল না তার। হাতে ধরা সঞ্চয়িতা বিছানায় রেখে নামল সে। দেখেই বুঝেছি, তুমি মায়া। একদম টাইমলি চা নিয়ে এসেছো। এই কবিতার মতো। 'তৃষাকাতর পান্থ আমি।' আমি চায়ের তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছি। দাও, দাও।
মায়া সি্নগ্ধ গলায় বলল, না দেব না।
কেন?
ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
তাতে কোনও অসুবিধা নেই।
গরম করে আনছি।
আরে যেটুকু গরম আছে তাতেই চলবে। খুব বেশি গরম চা আমি খাই না। আমার স্বভাব মেয়েদের মতো। গরম চা খাই না। ঠোঁট পুড়ে যায়, গায়ের রং কালো হয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাহলে ঠিক আছে।
নীলুর দিকে চায়ের মগ বাড়িয়ে দিল মায়া।
মগ হাতে নিয়ে নীলু বলল, এই, আমি এত হাসির কথা বললাম, তারপরও তোমার মুখে হাসি নেই! তুমি এত গম্ভীর কেন?
মায়া মুহূর্তের জন্য নীলুর দিকে তাকালো। তারপর অন্যদিকে তাকয়ে বলল, আমি এরকমই।
নীলু সামান্য সময় কী ভাবলো, তারপর বলল, তোমাদের বাড়িতে কুয়া আছে?
মায়া অবাক। কী?
কুয়া, কুয়া।
না।
কেন?
আজকাল কোন বাড়িতে কুয়া থাকে না। আমাদের বাড়িতে চাপকল আছে, বাঁধানো পুকুর আছে। পানির কোনও অভাব নেই।
কিন্তু একটা কুয়ার বড় দরকার ছিল। ওই নিমগাছের তলায়।
কেন?
আমি চলে যাওয়ার পর তুমি সেই কুয়ার ধারে বসে থাকতে।
বসে কী করতাম?
আমার কথা ভাবতে।
মায়া বিরক্ত হলো। ভুরু কুঁচকে নীলুর দিকে তাকালো। আপনার কথা আমি কেন ভাববো?
না মানে এই কবিতার মতো আর কী! 'তৃষাকাতর পান্থ আমি।' চা দিয়ে আমার তৃষ্ণা তুমি মিটিয়ে ছিলে। আমি চলে যাওয়ার পর তোমার অবস্থা হবে রবীন্দ নাথের 'কুয়ার ধারে' কবিতার সেই মেয়েটির মতো।
কুয়ার ধারে দুপুরবেলা তেমনি ডাকে পাখি
তেমনি কাঁপে নিমের পাতা, আমি বসেই থাকি।
মায়া একটু রুক্ষ হলো। আপনার জন্য আমি কোন দিনও বসে থাকবো না। আমার এতো ঠেকা পড়েনি।
মায়া নীলুর দিকে আর তাকালো না, বেরিয়ে গেল।
তখনও চায়ে চুমুক দেয়নি নীলু। মায়া বেরিয়ে যেতেই পর পর দু'বার চুমুক দিল। চিন্তিত গলায় বিড়বিড় করে বলল, বেশি স্মার্ট হতে গিয়ে ভেজাল লাগিয়ে দিলাম নাকি!
রাতেরবেলা মা এসে মায়ার ঘরে ঢুকলেন।
মুখটা হাসি হাসি। দেখে বোঝা যায় বেশ একটা আনন্দ নিয়ে মেয়ের ঘরে এসেছেন তিনি। মুখে অবশ্য সেটা বললেনও। আমি খুব খুশি হয়েছি মা, খুব খুশি হয়েছি।
মায়া তার পড়ার টেবিলে বসে আছে। পড়াশোনা এখন আর সে করে না। টেবিলে সাজানো আছে বইখাতা। টেবিল ল্যাম্পটাও আছে। সেই ল্যাম্প জ্বালেনি সে। দেয়ালে টিউব লাইট জ্বলছে। মৃদু শব্দে ঘুরছে সিলিংফ্যান।
মায়ের কথায় মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকালো মায়া। কেন খুশি হয়েছো?
শুকতারা বলল, তুই নীলুর জন্য চা নিয়ে গেছিস।
হঁ্যা।
এজন্যই খুশি হয়েছি।
এতে খুশি হওয়ার কী আছে?
না মানে, রাজুর এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কোনওদিন আমাদের বাড়িতে আসেনি। এই প্রথম এলো। তার দেখাশোনাটা আমাদের ভালোভাবেই করা উচিত।
মায়া কথা বলল না।
মা বললেন, নীলুকে কেমন দেখলি?
দেখতে ভালো। তবে ফাজিল টাইপের।
মানে?
কথা বেশি বলে।
কথা বেশি বললেই কেউ ফাজিল টাইপ হয়ে যায়? কই আমার তো কখনও মনে হয়নি নীলু ফাজিল টাইপের ছেলে। রাজুও কখনও বলেনি। অনেক বড় ঘরের ছেলে। দেখতে রাজপুত্রের মতো। আমার সঙ্গে কী সুন্দর করে কথা বলল।
আমার ফাজিল টাইপ মনে হয়েছে। তবে একটা গুণ আছে।
কী গুণ?
কবিতা পড়ে খুব সুন্দর।
এটা রাজুও আমাকে বলেছে।
আমাকেও বলেছিল। আজ নিজ কানেই শুনলাম। দোষের মধ্যে দোষ হচ্ছে কথা বেশি বলে। ফাজিল টাইপ। আর গুণ হচ্ছে কবিতা পড়ে খুব ভালো।
মায়ার খাটে বসলেন মা। দোষে-গুণে মিলিয়েই মানুষ। পৃথিবীতে একশো ভাগ ভালো মানুষও নাই, একশো ভাগ খারাপ মানুষও নাই। ভালো মানুষেরও কিছু খারাপ থাকে, খারাপ মানুষেরও কিছু ভালো থাকে। মানুষের শুধু দোষটা বা খারাপটা দেখলেই হয় না। গুণটাও দেখতে হয়, ভালো দিকটাও দেখতে হয়।
মায়া গম্ভীর গলায় বলল, তোমার কথার অর্থ আমি বুঝেছি। তুমি যা বলতে চাও, তার সঙ্গে ভাইজানের বন্ধুর কোনও মিল নেই। আমার চে' বাইশ বছরের বড় একটা লোকঃ
কথা শেষ না করে মুখে দুনিয়ার বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল মায়া।
খানিক আগে পলস্নীবিদু্যৎ চলে গেছে।
রাজু নীলুর ঘরে এখন চার্জার জ্বলছে। সেই আলোয় পায়চারি করছে নীলু। রাজু এসে ঢুকল। রাজুকে দেখে একটু যেন ভরসা পেল নীলু। অস্থির গলায় বলল, এই রাজু, মায়ার সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে?
রাজু অবাক হলো। না তো!
দেখা হয়নি?
না। আমি বাজারের দিকটায় গিয়েছিলাম। এখনই ফিরলাম। ফিরে সোজা এই ঘরে।
বুঝলাম।
কী হয়েছে বল তো?
আমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।
কার সঙ্গে?
মায়ার সঙ্গে।
কী করেছিস?
না মানে তুই তো আমার নেচার জানিসই। কবিতা-টবিতা পড়িঃ
তো?
ইমোশানটা একটু বেশি।
রাজু তীক্ষ্নচোখে নীলুর দিকে তাকালো। ওই ব্যাটা, আমার পরির মতো বোনটাকে প্রেম নিবেদন করেছিস নাকি?
আরে না।
তাহলে?
কবিতা পড়ছিলাম, সে চা নিয়ে এলোঃ
মায়া চা নিয়ে এলো?
হঁ্যা।
চা তো আনার কথা শুকতারার। তাকেই আমি বলে গিয়েছিলাম।
শুকতারাটা কে?
আমাদের বুয়া।
শুকতারা নাকি নাম? হেভি তো।
মানে?
বুয়ার নাম শুকতারা? শুনলেই বহু পুরনো দিনের একটা গানের লাইন মনে আসে। 'শুকতারা আকাশের কোনে তে, সাথীহারা ব্যথা মোর মনে তে'।
এইসব খাজুইরা প্যাচাইল বাদ দিয়ে আসল কথা বল। মায়া চা নিয়ে আসার পর তুই কী করেছিস?
আরে ব্যাটা কিছুই করিনি।
বললি যে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস?
সেটা মনে হয় একটু করেছি।
কীভাবে?
কবিতা পড়ছিলাম তো! মায়া চা নিয়ে এলো। কবিতার সঙ্গে চা ইত্যাদি মিলিয়ে একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে, ধরা খেয়ে গেছি বন্ধু।
ধরাটা কী? কী করেছিস?
না ওটুকুই। আর কিছুই না।
রাজু গম্ভীর হলো। মায়া কিন্তু অন্যরকম। বেশি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করো না বন্ধু।
তারপরও তুই ওর সঙ্গে একটু কথা বল।
কী বলবো?
কথা বলে দেখ, মাইন্ড টাইন্ড করলো কী না!
আমি পারবো না।
কেন?
মায়ার সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারি না আমি।
কী বলিস?
হঁ্যা।
কেন?
কারণ আছে।
কারণটা বল।
পরে একসময়ে বলবো।
আচ্ছা ঠিক আছে। যখন ইচ্ছা বলিস, না ইচ্ছা হলে না বলিস। কিন্তু আমার এখন কী হবে? আমি তো অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছি। মায়া মাইন্ড করলো কী না বোঝা দরকার।
রাজুর হাত ধরল নীলু। এরকম অস্বস্তিতে ঘুম হবে না আমার। তুই এক্ষুণি যা। মায়ার সঙ্গে কথা বল।
রাজু সরল গলায় বলল, এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। মায়ার সঙ্গে আমি এসব নিয়ে কথা বলবো না। বলবি তুই।
কী?
হঁ্যা। আজকের রাতটা সময় নে। কাল একসময় নিজেই ওর সঙ্গে কথা বলবি। নিজেই জেনে নেয়ার চেষ্টা করবি, সে মাইন্ড করেছে কী না। নিজেরটা নিজেই সামলাও বন্ধু।
মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করে নীলু বলল, ভালো আজাবের মধ্যে পড়লাম!
আজকের বিকেলটিও গতকালকার মতো।
আকাশ ঝকঝকে নীল। তুলোর পাহাড়ের মতো সাদা মেঘ ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে। গুমোট গরমটা নেই। কমলা রংয়ের রোদ কাঁপিয়ে তুলতুলে হাওয়া বইছে। গাছের পাতা গাঢ় সবুজ হয়েছে কয়েকদিন আগের বৃষ্টিতে। কদম ফুলের গন্ধ আসছে পুকুরের ওপার থেকে। বাগানের দিকে পাখি ডাকছে।
কী পাখি! দোয়েল না শ্যামা! নাকি শালিক, বুলবুলি!
মায়া বসে আছে ঘাটলায়। আজ তার পরনে আকাশি রংয়ের শাড়ি। পিছন ফিরে বসে আছে বলে মুখটি দেখা যাচ্ছে না। বসার ভঙ্গি সুন্দর। এই সৌন্দর্যের মধ্যেও যেন মিশে আছে একটুখানি বিষাদ কিংবা বিষণ্নতা।
মায়ার পিছনে এসে দাঁড়াল নীলু। মায়া টের পেল না। পুকুরজলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে তো বসেই আছে। জগৎ সংসারের কোনও দিকেই যেন খেয়াল নেই।
এত মগ্ন হয়ে কী ভাবছে মায়া?
মৃদু শব্দে গলা খাঁকারি দিল নীলু। এই শব্দে চমকালো মায়া। পিছন ফিরে তাকাল। কিন্তু কথা বলল না।
নীলু বলল, গলা খাঁকারি দিলাম, চমকে পিছন ফিরে তাকালে, উঠে দাঁড়াবে না?
মায়া তবু উঠে দাঁড়াল না। নির্বিকার গলায় বলল, যা বলতে এসেছেন, বলুন।
কিছুই বলতে আসিনি।
তাহলে এসেছেন কেন?
কিছু বলতে।
আগে যে বললেন কিছু বলতে আসেননি?
এমনিতেই বলেছি।
বলুন কী বলতে চান?
নীলু আচমকা বলল, তুমি এত কাঠখোট্টা কেন?
মায়া ভুরু কুঁচকালো। কী?
এত সুন্দর একটা মেয়ে এরকম হবে কেন?
আমি আমার মতো।
তা জানি।
আপনার কোনও অসুবিধা আছে?
আছে। অনেক অসুবিধা আছে।
যেমন?
আমি তোমাদের এখানে বেড়াতে এসেছিঃ
তো?
তোমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা। সিনেমাতে যেমন হয় আর কী!
মানুষের জীবন সিনেমা না।
ঠিক, একদম ঠিক। মানুষের জীবন সিনেমা না। সিনেমা হচ্ছে গিয়ে শ্রাবণ দিনের বিকেলবেলা নীল শাড়ি পরে পুকুরঘাটে একা বসে থাকা মেয়েটির জীবন।
মায়া ঠোঁট কামড়াল। আপনার সম্পর্কে মাকে আমি ঠিকই বলেছি।
কী বলেছো?
আপনি একটু ফাজিল টাইপ।
নীলু সরল মুখ করে হাসল। খারাপ বলোনি।
খারাপ বলিনি? এটা ভালো বলা হলো?
ফাজিল শব্দটা খুব খারাপ না। যাহোক, আমার কবিতা আবৃত্তি কেমন লেগেছে?
বলবো না।
কেন?
বললে আপনি লাই পেয়ে যাবেন।
তার মানে আমাকে তুমি বানর ভেবেছো? লাই পেলে মাথায় উঠবো?
নিজেই তো নিজের চরিত্র ব্যাখ্যা করে দিচ্ছেন।
তা দিচ্ছি। কিন্তু আমার আবৃত্তি সম্পর্কে তুমি যা বলেছো তা আমি বুঝে গেছি।
আমি কিছুই বলিনি।
কিছু বলনি বলেই বুঝেছি। আরেকটা শোনাবো?
না। যা বলতে এসেছেন, বলে চলে যান।
এবার গম্ভীর হলো নীলু। কথার হালকা ধাঁচ কণ্ঠ থেকে উধাও হলো তার। বলল, মায়া, তুমি যা ভেবেছো আমি তেমন না। আমার স্বভাব হচ্ছে হালকা চালে কথা বলা, মজা করা। মানুষকে দ্রুত আপন করে নেয়া। তোমার সঙ্গেও তেমন করেই কথা বলেছি। তাতে আমাকে যদি তোমার ফাজিল মনে হয়ে থাকে, তাহলে আই য়্যাম সরি। এক্সট্রিমলি সরি। আমি ফাজিল না।
নীলু আর দাঁড়াল না। দ্রুত হেঁটে বাগানের দিকে চলে গেল।
মায়া তখন কী রকম চিন্তিত চোখে চলে যাওয়া নীলুকে দেখছে। পিছন থেকেও নীলুকে দেখতে খুব ভালো লাগে। ফেডেড জিন্স আর হালকা হলুদ টিশার্টে দুর্দান্ত লাগছে তাকে।
মায়ার সঙ্গে কথা বলেছিস?
বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে নীলু। রাত তেমন হয়নি। খানিক আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে দশ পনেরো মিনিট পুকুরঘাটের ওদিকটায় পায়চারি করেছে দুই বন্ধু। তারপর ঘরে এসে ঢুকেছে। কথাটা রাজু ওসময়েই জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল। নীলুর কারণেই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিল। আকাশে শ্রাবণ মাসের মাঝারি ধরনের চাঁদ। পুকুরজলে চাঁদের আলো পড়েছে। ওসব দেখে নীলু রবীন্দ নাথ নিয়ে কথা বলছিল, জীবনানন্দ নিয়ে কথা বলছিল। কবি কিংবা কবিতা নিয়ে কথা বলবার সময় গলার স্বর বদলে যায় নীলুর, মুখের ভঙ্গি বদলে যায়। যেন অন্য এক জগতে চলে যায় সে। সেই জগৎ থেকে রাজু তাকে ফিরাতে চায়নি।
এখন ঘরে এসে কথাটা জিজ্ঞেস করল।
নীলু বলল, হঁ্যা।
কখন দেখা হলো? কোথায়?
বিকেলবেলা। পুকুরঘাটে।
একটু থামলো নীলু। রাজুর দিকে চোখ তুলে তাকাল। তোর বোনটার সমস্যা কী রে?
রাজু থতমত খেল। কিসের সমস্যা?
এই বয়সি এত সুন্দর একটা মেয়ে, সে এরকম কেন?
কী রকম?
চুপচাপ থাকার সময় বিষণ্ন, উদাস। কথা বলবার সময় রুক্ষ্ম। তুই আমাকে বলেছিলি মায়া খুবই উচ্ছল-প্রাণবন্ত মেয়ে। সারাক্ষণ প্রজাপতির মতো উড়ছে, দোয়েল পাখির মতো লাফাচ্ছে। একাই মাথায় তুলে রাখছে বাড়ি। সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়, লেখাপড়ায়ও ভালো।
সবই ঠিক আছে। একটাও মিথ্যা বলিনি।
কিন্তু তোদের বাড়িতে এসে তো দেখছি অন্যরকম। তোর কথার সঙ্গে মায়ার চরিত্রের কোনই মিল নেই। একদম উল্টো।
ঘটনা আছে।
কী ঘটনা?
রাজু চিন্তিত হলো। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
নীলু বলল, প্রেমঘটিত? মানে সে কাউকে পছন্দ করে, তোরা করিস না, এরকম কিছু? সে পছন্দের ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাইছে, তোরা দিচ্ছিস না, এরকম কিছু?
না। পুরোটাই উল্টো।
অর্থাৎ মায়ার জন্য তোরা কাউকে পছন্দ করেছিস, সেখানে তার বিয়ে দিতে চাচ্ছিস, সে রাজি হচ্ছে না, এরকম?
তারচে'ও বেশি।
নীলু চট করে রেগে গেল। এই ব্যাটা, ঝেড়ে কাশ। পরিষ্কার করে বল, ঘটনা কী? এত ধানাই-পানাই করছিস কেন?
নীলুর ধমক খেয়ে চিন্তিত ভাব কেটে গেল রাজুর। মায়া সম্পর্কে আমি তোকে যা যা বলেছিলাম তার একটি বর্ণও মিথ্যা না নীলু। মায়া সত্যি প্রজাপতির মতো উড়তো সারাক্ষণ, হাঁটতো না, দোয়েল পাখির মতো নাচতো সারাক্ষণ। বাসু ওস্তাদের কাছে রবীন্দ সঙ্গীত শিখতো। গলা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার মতো। মায়ার হাসির শব্দ সত্যি সত্যি জলতরঙ্গের মতো। বিএ পড়তো। পড়াশুনায়ও খুব ভালো। মানুষের জন্য অপরিসীম মায়া।
সেই মেয়ে এরকম হয়ে গেছে কেন?
মায়ার এই অবস্থার জন্য আমার মা দায়ী।
কী?
হঁ্যা। তুই আমার এত প্রিয়বন্ধু, তারপরও আমাদের ফ্যামিলির অনেক কথাই তোকে আমি বলিনি।
প্রত্যেক ফ্যামিলিতেই লুকাবার মতো কিছু না কিছু থাকে। ওরকম কিছু থাকলে না বলাই ভালো।
আসলে ব্যাপারটা তোর কাছে লুকাবার মতো না।
তাহলে লুকিয়েছিস কেন?
বলতে কষ্ট হতো, এজন্য।
নীলু তীক্ষ্নচোখে রাজুর দিকে তাকালো। কী ব্যাপার রে?
মায়া আমার আপন বোন না।
নীলুর গায়ে যেন আগুনের ছ্যাকা লেগেছে এমন করে উঠে বসল সে। কী, কী বললি? মায়া তোর আপন বোন না?
না। আমার মামাতো বোন। ওই একটাই মামা ছিল আমার। অনু মামা। মা'র ছোটভাই। একটু রোগা, নরম ধরনের মানুষ ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটের পরে আর লেখাপড়া করেননি। প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন। নানার জায়গায় সম্পত্তি ছিল সামান্য। মায়ের ভাগেরটা নেননি মা, অনু মামাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। মামা বিয়ে করেছিলেন খুবই দরিদ্র একটা পরিবারে। পরিবারটির শিক্ষাদীক্ষা ছিল, রুচি ছিল, টাকা পয়সা ছিল না। মামী খুব সুন্দরী ছিলেন। মায়ার জন্মের আগে থেকেই অসুস্থ। ঢাকায় নিয়ে প্রায়ই চিকিৎসা করাতে হতো। মামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে যেটুকু জায়গা সম্পত্তি মামার ছিল, তা গেল। তারপরও মামীকে বাঁচানো গেল না। মায়ার জন্মের কয়েকদিন পরই সে মারা গেল। মামী মারা যাওয়ার পর ওইটুকু মায়াকে নিয়ে এমন বিপদে পড়লেন মামা! বাচ্চাটাকে কীভাবে বাঁচাবেন, নিজে কীভাবে বাঁচবেন, একেবারে দিশাহারা অবস্থা। মামার ততোদিনে ডায়াবেটিস হয়ে গেছে। একটা কিডনী ইফেকটেড, হার্টের অসুখ। শ্বশুরপক্ষে এমন কেউ নেই মায়ার প্রতিপালন করে বা মামাকে একটু সাহায্য করে। আমার মা বাবা মামার পাশে দাঁড়ালেন। নিজের বাড়িঘর বিক্রি করে মায়াকে বুকে নিয়ে মামা চলে এলেন আমাদের বাড়িতে। মায়াকে তুলে দিলেন মা'র কোলে। তারপর মাস ছয়েকও বাঁচলেন না মামা। হাইপো হয়ে গেল একদিন। বুঝতেই পারলেন না কী করতে হবে। হাইপো থেকে ডায়াবেটিক কোমায় চলে গেলেন। ওইভাবেই ঢাকা মেডিকেলে চবি্বশ দিন বেঁচে ছিলেন। তারপর থেকে মায়া আমাদের কাছে। ওই যে মা তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন, কোল থেকে আর নামাননি। আমার মাকেই মা ডাকতে শিখল মায়া। আমার বাবাকে বাবা। আমি হয়ে গেলাম ওর আপনভাই।
এইসব ঘটনা খুবই কষ্ট বেদনার। রাজুর মুখে মায়ার মা বাবার ঘটনা শুনতে শুনতে নীলুও পড়ে গিয়েছিলো এক কষ্ট বেদনার মধ্যে। রাজু থামতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কোনও রকমে বলল, মায়া এসব জানে?
সব জানে। কিন্তু এসব নিয়ে ওর কোনও দুঃখ বেদনা নেই। নিজের মা বাবার কথা ও কখনও ভাবেইনি। আসলে আমরা ওকে ভাবতে দেইনি। আমরা তিনজন মানুষ ওকে গভীরভাবে ভালোবেসেছি। মৃতু্যর বছরখানেক আগে বাবা উকিল ডেকে আমাদের যাবতীয় প্রপার্টির অর্ধেকের মালিক করে দিয়ে গেছেন মায়াকে। আমি অর্ধেক পাবো, মায়া অর্ধেক পাবে। সবকিছু মিলিয়ে খুবই সুখি একটা ফ্যামিলি আমাদের।
তাহলে সমস্যাটা হলো কোথায়?
বাবা মারা যাওয়ার পর মায়াকে নিয়ে হঠাৎই কেমন দিশাহারা হয়ে গেলেন মা।
কেন?
ভাবলেন বাবা বেঁচে থাকলে ভালো ঘরে, ভালো পাত্রে বিয়ে হতো মায়ার। এখন হয়তো তেমন ভালো ঘর, ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না।
এরকম মনোভাবের কারণ কী?
খুবই তুচ্ছ কারণ।
কেমন?
মায়া আমার আপন বোন না, এসব নিশ্চয় পাত্রপক্ষ জানবো। আমার বাবা মামুন চৌধুরীর মেয়ে না মায়া, তাঁর শ্যালকের মেয়ে এসব তো বিয়েশাদির সময় জানাজানি হবেই। বাবা বেঁচে থাকলে ব্যাপারটা যেভাবে সামাল দিতেন, মা তো আর সেভাবে সামাল দিতে পারবেন না। এরকম একটা অবস্থায় বড় রকমের একটা ভুল করে ফেললেন মা।
কী রকম?
আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়, বেশ অবস্থাপন্ন। ছেলেটির নাম বদরুল। বহু বছর ধরে ইতালিতে থাকে। রোমে থাকা বাঙালিদের মধ্যে তার অবস্থা সবচাইতে ভালো। ভালো বিজনেস করে সেখানে। দশ-বারোটা দোকানই আছে। লেখাপড়া তেমন করেনি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে চলে গিয়েছিল। বদরুল এবং তাদের পরিবার মায়াকে খুবই আদর করে। তবে মায়ার সঙ্গে বদরুলের বয়সের ব্যবধান হচ্ছে বাইশ বছরঃ
না না বয়সের এত ব্যবধান, বিদেশে থাকা ব্যবসায়ী ছেলে, ওইসব ছেলে খুবই ধুরন্ধর টাইপ হয়। আর মায়া এত সুন্দর একটা মেয়ে, তোদের পরিবারের মেয়ে। ওর কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড আর শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে ওই বদরুল না কী বললি ওসব লোকের মিলবে না।
রাজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না মিললে কী হবে, মায়ার তো বিয়ে হয়ে গেছে।
নীলু স্তব্ধ হয়ে রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলিস কী?
হঁ্যা।
এককাপ চা হবে?
মায়া উঠোনের নিমগাছটির দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। নীলুর কথা শুনে দাঁড়াল।
নীলু বলল, না মানে আজকাল আর কাপে চা দেয়া হয় না, দেয়া হয় মগে।
তো?
একমগ চা হবে?
কাল না বললেন আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না?
চা চাইলে কী ডিস্টার্ব করা হয়?
হয়।
তাহলে থাক। দরকার নেই।
মায়া কয়েক পলক নীলুর দিকে তাকিয়ে রইল। নীলুর পরনে ওই একই রকম পোশাক। জিন্স আর টিশার্ট। বস্নু জিনসের সঙ্গে সাদা টিশার্টে খুবই ভালো লাগে তাকে। পায়ে সুন্দর স্যান্ডেল সু। এখানে আসার পর বোধহয় আর শেভ করেনি। ফর্সা সুন্দর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল শাহরুখ খান ধরনের, ঝাঁকড়া, ঘন। কপালের পুরোটাই ঢাকা পড়েছে চুলে। বেশ লম্বা সে, কাছাকাছি এলেই গা থেকে ভেসে আসে পুরুষালি পারফিউমের গন্ধ।
এখনও গন্ধটা পেল মায়া। এই গন্ধে শরীরের অনেক ভিতরে কী রকম যেন একটা কাঁপন টের পেল। এ রকম কাঁপন আজকের আগে কখনও লাগেনি তার শরীরে। মায়া কোনও রকমে বলল, চা আনছি।
রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াবে, নীলু বলল, মায়া, শোনো।
মায়া দাঁড়াল, কিন্তু নীলুর দিকে তাকালো না।
চায়ের দরকার নেই।
এবার নীলুর দিকে তাকালো মায়া। রাগ করবারও দরকার নেই। বললাম তো, আনছি।
রাগ করিনি।
তাহলে?
সত্যি বলছি চায়ের দরকার নেই।
দরকার না থাকলে চাইলেন কেন?
নীলু নির্মল মুখ করে হাসল। আমি আসলে তোমার সঙ্গে ভাব করবার জন্য চা চেয়েছি।
মায়া ভুরু কুঁচকালো। ভাব করবার জন্য?
হঁ্যা।
আমার সম্পর্কে আপনি জানেন?
জানবো না কেন? সব জানি।
কী জানেন বলুন তো?
তুমি খুব সুন্দর রবীন্দ সঙ্গীত গাও। এখানকার কলেজ থেকে বিএ পাস করেছোঃ।
না, বিএ পর্যন্ত পড়েছি।
ওই তো পরীক্ষা দাওনি আর কী! বিএ পাস করোনি।
হঁ্যা।
ভাব করার জন্য বিএ পাস করতে হয় না।
এই প্রথম মায়ার মুখে একটুখানি হাসি দেখা গেল। ওইটুকু হাসিতেই কী যে ভালো দেখালো মেয়েটিকে। উঠোনে পড়ে থাকা নিমের ছায়ার ওপর যেন কোত্থেকে এসে পড়ল এক টুকরো দুর্দান্ত আলো।
মায়া বলল, আপনি চাইলেই যে আমি আপনার সঙ্গে ভাব করবো, এটা মনে হচ্ছে কেন?
নীলুও হাসল। তোমার মুখ দেখে মনে হয়েছে। তোমার মুখ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো।
মানুষের মুখ কবিতার মতো হয়?
হয়। শুনবে।
শোনাতে চান?
চাই।
শুনি তাহলে।
'মুখখানি যেন তার মতো, মুখখানি তবু কার মতো'।
মায়া সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ন হয়ে গেল। নিমগাছের মাথার ওপর স্থির হয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সুন্দর আবৃত্তি করেন।
তোমার ভালো লাগে?
ভালো লাগে কি না জানি না, মন অন্যরকম হয়ে যায়।
তাহলে ভাব করছো না কেন?
নীলুর চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া বলল,
নীলু সঙ্গে সঙ্গে বলল, যাবব্বা! ভাবের সঙ্গে বিয়ের কী সম্পর্ক? আমি কি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি নাকি? তোমার যে বিয়ে হয়ে গেছে এ তো আমি জানিই।
জানেন? ভাইজান আপনাকে বলেছে?
জানি? তোমার ভাইজান আমাকে বলেছে। শুধু বিয়ের কথা না, সব কথাই বলেছে।
আর কী বলেছে?
তুমি জানো আর কী বলতে পারে।
বুঝেছি।
মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মায়ার দিকে একটু ঝুঁকে এলো নীলু। এই, তোমার বর দেখতে কেমন? খুব হ্যান্ডসাম? শাহরুখ খান টাইপ?
মায়া কথা বলল না। মন খারাপ করা ভঙ্গিতে চলে যেতে চাইল।
নীলু বলল, আচ্ছা বরের কথা বাদ দাও। তোমার কথা শোনো।
মায়া তবু নীলুর দিকে তাকালো না। উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইল।
নীলু বলল, তুমি হচ্ছো রবীন্দ নাথের গানের মতো, জীবনানন্দের কবিতার মতো। 'যে কোমল বিষণ্নতা তোমাকে ঘিরে রাখে, তুমি ওটুকুই সুন্দর'। এটা কার কবিতার লাইন আমি জানি না। হঠাৎ মনে এলো, বলে ফেললাম। বলতে খুব ভালো লাগল।
মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে নীলুর দিকে তাকালো মায়া। সেই ফাঁকে নীলু দেখে মায়ার চোখ জলে ভরে গেছে। কিছু একটা বলবে সে, তার আগেই মায়া দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
তারপরও কিছুটাক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়ে রইল নীলু। মনে মনে বলল, আমি চাই মেয়েটিকে প্রাণবন্ত করতে, হয়ে যায় উল্টো!
বদরুল ফোন করেছিল।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাজু আর নীলু যাচ্ছে তাদের রুমের দিকে। শুকতারা রাজুকে বলল, আম্মায় আপনেরে ডাকে ভাইজান।
সঙ্গে কেলানো হাসি। হে হে।
রাজু বলল, নীলু, তুইও চল। মা'র সঙ্গে কথা বলে আসি।
নীলু বলল, না।
কেন?
খালাম্মা হয়তো কোনও পারিবারিক কথা বলবেন। সেখানে আমার না থাকাই ভালো। আমি বরং পুকুরঘাটের দিকে যাই। চাঁদ আরেকটু প্রখর হয়েছে আজ। চাঁদের আলোয় পুকুর পাড়ে বসে থাকি।
একা একা বসে থাকবি?
তো?
ভয় পাবি না?
কিসের ভয়?
ভূতের।
ভূতের?
হঁ্যা। গাছপালা ঘেরা বিশাল বাড়ি। ভূত দুচারটা থাকতেই পারে।
আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে?
কে?
ওই দুচারটা ভূত?
এক আধটা আসতে পারে।
আসলে খুবই ভালো হয়।
বলিস কী!
হঁ্যা। জীবনে কখনও ভূত দেখিনি। তোদের বাড়িতে যদি সেই জিনিসের সঙ্গেও দেখা হয়, তাহলে ষোলকলা পূর্ণ।
তাহলে পুকুরঘাটে যা। আমি যাই মা'র সঙ্গে কথা বলতে।
রাজু মায়ের ঘরে ঢুকেছে, সঙ্গে সঙ্গে বদরুলের ফোনের কথা বললেন না।
মায়ের ঘরে টেলিভিশন চলছে। রাজুকে কথাটা বলেই টেলিভিশন মিউট করে দিলেন মা। তিনি বসে আছেন পালঙ্কে। পিঠের তলায় দুটো বালিশ উঁচু করে রাখা। রাজু বসল তাঁর পায়ের কাছে। কী বলল?
আমাদের খোঁজখবর নিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করল। বললাম বাড়িতেই আছিস। নীলুর কথাও বলেছি।
মায়ার সঙ্গে কথা বলতে চায়নি?
চেয়েছে। মায়া ওর ফোনও ধরে না, কথাও বলে না। কী যে যন্ত্রণায় পড়েছি মেয়েটাকে নিয়ে।
এটা আসলেই সমস্যা হয়ে গেছে। বদরুলের সঙ্গে মায়ার বিয়েটাই ঠিক হয়নি। বয়সের ব্যবধানটা মাথায় রাখা উচিত ছিল।
ভুল যে আমার হয়েছে এটা আমি জানি। আমিই বা কী করবো, বল।
কী করবে মানে?
তোর বাবা মারা যাওয়ার পর মায়াকে নিয়ে আমি একটু বেশিই দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলাম।
কোনও কারণ ছিল না।
অবশ্যই কারণ ছিল। অনাথ এতিম মেয়ে। যতই নিজেদের পরিচয়ে আমরা বড় করে থাকি, পাত্রপক্ষ তো আর তা মেনে নিত না। বদরুলরা আত্মীয় বলে মেনে নিয়েছে। ভাবলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মায়ার বিয়েটা দিয়ে ফেলি। দায়িত্ব শেষ করি।
রাজু গম্ভীর গলায় বলল, দায়িত্ব শেষ করতে গিয়ে সর্বনাশ করে ফেললে।
মা কঠিন গলায় বললেন, কোনও সর্বনাশই করিনি।
তুমি যদি মনে করো সর্বনাশ করোনি, তাহলে করোনি।
আমি বদরুলকে বলেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মায়াকে ইতালিতে নিয়ে যেতে।
তাতে লাভ?
স্বামীর সংসারে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরকম কত ঘটনা ঘটে। কত মেয়ে প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারে না স্বামীকে। তারপর আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়।
রাজু মস্নান গলায় বলল, মায়ার ক্ষেত্রেও যদি ঠিক হয় , তাহলে ভালো।
তারপর একটু থেমে বলল, মা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কী?
মামী মামা মারা যাওয়ার পর এই যে মায়াকে তুমি তোমার মেয়ে হিসেবে বড় করলে, মায়ার জন্য ভালোবাসাটা কেমন তোমার?
মা একটু থতমত খেলেন। রাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কী মনে হয়?
আমি আসলে তোমার মুখ থেকেই জবাবটা শুনতে চাই।
নিজের পেটে ধরা মেয়েকে যেমন ভালোবাসতাম আমি, মায়াকেও তেমন ভালোবাসি।
মায়া এই বাড়ি থেকে চলে গেলে তুমি তাহলে কেমন করে থাকবে?
কষ্ট হবে বাবা, খুব কষ্ট হবে। তারপরও থাকতে হবে। সব মেয়েই কোনও না কোনওদিন মা-বাবার সংসার ছেড়ে চলে যায়। এটাই সংসারের নিয়ম। মা বাবাকে বুকে পাথর বেঁধে থাকতে হয়।
কিন্তু মায়া চলে যাবে বহুদূরের এক দেশে। দু'চার-পাঁচ বছর পর হয়তো একবার দেশে ফিরবে। ওর বিয়েটা যদি দেশে থাকা কোনও পাত্রের সঙ্গে হতো তাহলে ইচ্ছা করলেই যখন তখন তুমি তাকে দেখতে পারতে, সে আসতে পারতো তোমার কাছে। দুজনেই ভালো থাকতে তোমরা। তোমাকেও তেমন বেশিদিন মায়াকে ছেড়ে থাকতে হতো না, মায়ারও বেশিদিন থাকতে হতো না তোমাকে ছেড়ে।
এটা এখন আমারও মনে হয় বাবা। যখন ভাবি, মায়া এই বাড়িতে থাকবে না, আমার বুকটা ফেটে যায়। মায়াকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
মা অাঁচলে চোখ মুছলেন।
রাজু বলল, মায়া খুব অন্যরকম মেয়ে। তোমার কথা সে মেনে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বুক ভরা তার অভিমান। আমার মনে হয় ইতালিতে চলে গেলে সে আর কোনওদিন এই বাড়িতে ফিরে আসবে না। নিজের অভিমান নিয়ে দূরেই পড়ে থাকবে। ধীরে ধীরে ভুলে যাবে আমাদেরকে।
এসব কথা বলতে বলতে রাজুর গলাও ধরে এলো। আমরা চারজন মানুষ এই বাড়িতে কত আনন্দ বেদনা, সুখ-দুঃখ নিয়ে জীবন কাটাচ্ছিলাম। বাবা চলে গেলেন, একটা বড় জায়গা শূন্য হয়ে গেল। মায়া চলে যাবে দূরদেশে, আমি থাকবো ঢাকায়, তুমি পড়ে থাকবে গ্রামে, আমরা কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম মা। মায়ার ব্যাপারে ভুল শুধু তোমারই হয়নি মা, আমারও হয়েছে। আমি বড় হয়েছি, মায়ার এই বিয়ের ব্যাপারে আমি তোমাকে বুঝাতে পারতাম, বাধা দিতে পারতাম। আমি জোর দিয়ে বললে নিশ্চয় তুমি আমার কথা শুনতে। এসব ভেবে নিজেকে আমার অপরাধী মনে হয় মা, খুব বড় অপরাধী মনে হয়। আমার বোনের জীবনটা এলোমেলো করে দেয়ার পেছনে আমারও হাত আছে। আমিও অনেকখানি দায়ী।
রাজু শিশুর মতো হু হু করে কাঁদতে লাগল।
চাঁদের আলোয় কী যে সুন্দর হয়ে আছে পুকুরঘাট।
পুকুর জলে পড়েছে চাঁদের আলো, চারদিককার গাছপালা ফুল পাতাবাহারের ঝাড় আর ঘাসের বনে পড়েছে। সেই আলোয় গলা ছেড়ে ডাকছে ঝিঁঝিঁপোকা। বহুদূরের কোথায় যেন ডাকছে একটা রাতপাখি। শ্রাবণ রাতের হাওয়ায় ভাসছে কদম ফুলের গন্ধ।
এরকম পরিবেশে পুকুরঘাটে এসে মাথা প্রায় খারাপ হয়ে গেছে নীলুর। আনমনে পায়চারি করছে সে আর শঙ্খ ঘোষের কবিতা আবৃত্তি করছে।
যেন এই পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন
প্রেম ব'লে কোনো ঋণ রাখেনি কোথাও,
যেন কেউ কোনোদিন কিশোর শিশির
বুকে নিয়ে পুবসাগরের নীল পাড়ে
দেখেনি প্রথম নারী যেন কোনোদিন।
কবিতা আবৃত্তির সময় অদ্ভুত এক ঘোর তৈরি হয় নীলুর। এখনও তৈরি হয়েছে। এই ঘোরের ভেতর থেকেও সে টের পেল কে একজন এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে। এত নরম মৃদু পায়ে সে এসেছে, টের পাওয়ারই কথা না।
আপনা-আপনি থেমে গেল নীলুর কবিতা। গা একটু কাঁটা দিল। তাহলে কি রাজু যা বলেছে তাই ঘটতে যাচ্ছে? বাগানের দিক থেকে তেনাদের কেউ কি এসে দাঁড়িয়েছে নীলুর পিছনে?
চট করে পিছন ফিরল নীলু।
না তেনাদের কেউ না! এ তো মায়া।
নীলু হেসে ফেলল।
মায়া বলল, হাসছেন কেন?
হাসির কারণ আছে।
কী কারণ?
তুমি এত রাতে এখানে এভাবে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি।
জ্যোৎস্নারাতে আমি মাঝে মাঝেই এদিকটায় আসি।
আর আমি ভেবেছি তেনাদের কেউ এসেছেন।
তেনাটা কে?
তুমি বোঝনি?
না।
কী করে যে বুঝাই। রাতেরবেলা তাদের নামও নেয়া যায় না। এদিকটায় আসার আগে রাজু আমাকে বলেছিল বাগানের দিকে নাকি গভীররাতে, কখনও কখনও সন্ধ্যারাতে, মানে ম্যাট ম্যাটে জ্যোৎস্নায় কিংবা অন্ধকারেঃ
নীলুর কথা শেষ হওয়ার আগেই মায়া বলল, বুঝেছি। ভাইজান আপনাকে ভয় দেখাবার জন্য বলেছে। আমি কত রাত একা একা ঘুরে বেড়াই, কোনদিন ওরকম কিছু দেখিনি। তবে আমাকে আপনি পেতি্ন ভাবতে পারেন।
কেন?
আমার জীবন এখন পেতি্নর জীবন। মানুষের জীবন না।
ধুৎ এসব কথা বলো না তো? এত সুন্দর পরিবেশে এত সুন্দর একটি মেয়ের মুখে এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। অন্য কথা বলো।
মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাহলে তো আপনার কবিতার কথা বলতে হয়।
তাই বলো।
আপনার কবিতা শুনলে জীবনের সব দুঃখ বেদনা ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।
নীলু তার স্বভাব সুলভ দুষ্টুমিটা এবার করল। তাও তো ভাব করলে না।
কে বলেছে করিনি।
নীলু চমকালো। করেছো?
আপনার কি মনে হয়?
ঠিক বুঝতে পারছি না।
এত রাতে এভাবে আপনার কাছে চলে এলাম তারপরও বুঝতে পারছেন না?
তুমি কি আমার জন্য পুকুরঘাটে এসেছো?
হঁ্যা।
জানলে কী করে, আমি এখানে?
আপনি যখন এদিকটায় আসছেন আমি তখন মাত্র আমার ঘর থেকে বেরুচ্ছি, আপনাকে দেখতে পেয়েছি। তারপরও একটু অপেক্ষা করেছি।
কেন?
আসবো কি আসবো না ভেবেছি।
তারপর?
তারপর ভাবলাম আসবো। কেউ যদি কিছু ভাবে, ভাবুক গিয়ে। আমি কারও ভাবনা নিয়ে ভাববো না। আমি আমার ইচ্ছে মতো চলবো।
নীলু বুঝতে পারলো না একথার পর কী বলবে।
মায়া বলল, শুনান না আর একটা কবিতা। আমার মনটা একটু ভালো করে দিন না।
নীলু সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করতে লাগল।
সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকো তুমি
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো, সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালী আগুনভরা রাতে।
শুনে পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ বেদনা একত্রে গলায় এনে মায়া বলল, আমার ফিরতে ইচ্ছে করে, আমার খুব ফিরতে ইচ্ছে করে সেই আগের জীবনে। প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে। জ্যোৎস্নারাতে পুকুরঘাটে বসে গাইতে ইচ্ছে করে, 'আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে'। রবীন্দ নাথের গানের তালে একা একা নাচতে ইচ্ছে করে। আর ইচ্ছে করে প্রাণ খুলে হাসি। জলতরঙ্গের মতো শব্দ তুলে হাসি। পারি না, কিছুতেই পারি না। আমার জীবন হয়ে গেছে খাঁচার ওই বুলবুলি ছানাটির মতো। এই বাড়ির খাঁচার মধ্যে জীবনের এতগুলো বছর কেটেছে আমার। এখন খাঁচার দরজা খুলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে আমাকে। কোন অজানায় উড়ে যাবো আমি, কে জানে!
নীলু বলল, অজানায় কেন? তুমি তো যাবে তোমার বরের কাছে। ইতালিতে।
আমার জন্য সে এক অচেনা জগৎ, অচেনা মানুষ।
পরিবেশটা বদলে দিতে চাইল নীলু। বলল, এত মন খারাপ করা কথা বলো না। কবিতা শোনো। এই কবির কবি মনীশ ঘটক।
কতদিন গিয়েছি তোমার কাছে
একটি কথা বলব বলে।
কথার ওপর কথা গেঁথে
কত হাজার কথা বলে এলাম
কিন্তু সেই একটি কথা বলা হল না।
নীলুর কবিতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়া দূরাগত দুঃখি গলায় বলল, আমার কোন কথা কখনই বলা হয়নি কাউকে। কাউকে অবশ্য বলতে ইচ্ছেও করেনি। আজ আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে; কিন্তু বলার আর কোনও অর্থ হয় না।
অদ্ভূত এক ঘোরলাগা গলায় নীলু বলল, তবু বলো।
না থাক। অন্যকথা বলি। আমার বিয়ের কথা বলি। যেন স্বপ্নের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল আমার। চিনি না শুনি না, দেখিনি কোনওদিন, এমন একটা লোক। জীবন দিয়ে ভালোবাসবো, হূদয় দিয়ে চাইবো এমন একজন হবে আমার বর, এমন ভেবেছি বড় হয়ে ওঠার পর থেকে। সেই স্বপ্ন কল্পনা মুহূর্তে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছিল। বরের বাড়ি গেলামও আমি। বাসররাতে লোকটা আমার হাত ধরতে চাইল। আমার হঠাৎ মনে হলো, এই লোকটা কে? কেন আমার হাত ধরতে চাইছে? কেন তার সঙ্গে রাতেরবেলা একা একটি ঘরে আমি? আমার আর কিছুই মনে নেই। পাগলের মতো বিছানা থেকে নামলাম। দিশেহারা ভঙ্গিতে দরজা খুললাম। এক দৌড়ে বাড়ির উঠোনে। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। যেন বিশাল এক দৈত্য আমাকে গিলতে আসছে, এমন ভয় আতঙ্ক আমার। শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদ, ওর এক ভাইয়ের বউ রাতভর আমাকে বুঝালো। আমি কিছুই বুঝতে চাইলাম না। লোকটার সামনেই তারপর আমি আর কখনও যাইনি। না ওদের বাড়িতে থাকার সময়, না এই বাড়িতে আসার পর। আমাকে আমি এমন করে তার কাছ থেকে সরিয়ে রাখলাম, যেন আমাকে একবার যদি সে ছুঁয়ে দেয় তাহলেই যেন আমি নষ্ট হয়ে যাবো, ধ্বংস হয়ে যাবো। আমি আর আমি থাকবো না। আমি হয়ে যাবো অন্যমানুষ।
মায়া একটু থামলো। তারপর বলল, সে খুবই দুঃখ পেল, মন খারাপ করে চলে গেল ইতালিতে। আর আমার মন ভরে গেল অদ্ভুত এক দুঃখে, বিষাদে। আগের আমিকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেললাম আমি। জীবনে কখনও যা ভাবিনি তাই ভাবতে শুরু করলাম। কেন মা আমার সঙ্গে এমন করল, কেন আমার ভাইটি আমাকে রক্ষা করল না? আমি যদি মায়ের আপন মেয়ে হতাম, মা কি আমার সঙ্গে এমন করতো? বাইশ বছরের বড়, নিরেট ব্যবসায়ী একটা লোক, সুন্দর করে কথা বলতে জানে না, জীবনে একটা রবীন্দ সঙ্গীত শোনেনি, এক লাইন কবিতা পড়েনি, মানুষের মূল্যায়ন করে টাকা দিয়ে, হোঁতকা নোংরা টাইপের শরীর, এরকম একটা মানুষের সঙ্গে আপন মা কি তার মেয়েকে বিয়ে দিতো? যে মেয়েটি বড় হয়েছে রবীন্দ , শুনেই আমি মুগ্ধ হয়ে যাবো। অথবা ওরকম একটা টাকাঅলা লোক আর বিদেশের জীবন পেলেই আমি সুখি হবো। আমার ভিতরকার আমিকে সে চেনার চেষ্টা করেনি, বোঝার চেষ্টা করেনি। আপন মা হলে এমন সে করতো না। আমাকে বোঝার চেষ্টা করতো। সেইভাবে গড়ে দিতে চাইতো আমার জীবন।
মায়া আবার একটু থামলো। তারপর বলল, আর আমার ভাইটি? সে তো লেখাপড়া জানা, শিল্পমনা একটি ছেলে। আপনার মতো বন্ধু আছে যার, সে কেন তার মায়ের মতামতটাই মেনে নেবে? সে কি একবারও ভাববে না তার বোনটির কথা? একবারও মতামত নেয়ার চেষ্টা করবে না বোনের? আমি যদি তার আপনবোন হতাম সে কি তাহলে এমন করতো? মায়ের মতামতটাই মেনে নিতো নাকি বোনের মতামতটাও জানার চেষ্টা করতো? বোনের মনের ভিতরটা যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সেদিকটায় কেন একবারও সে খেয়াল করল না?
মায়া আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি কেউ না। আমি আসলে এই বাড়ির কারো কেউ না। আমার অবস্থা ওই বুলবুলি ছানাটির মতো। মা বাবার মৃতু্য আমার জীবনে হঠাৎ আসা এক দমকা হাওয়া। সেই হাওয়ায় ছিটকে পড়লাম মাটিতে। ফুফু আমাকে কুড়িয়ে এনে একটা খাঁচায় আটকে দিল। আজ বড় করে অচেনা আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে।
মায়া আর কথা বলল না। কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণ রাতের জ্যোৎস্না ভেঙে বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল।
নীলু তখন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুকুরঘাটে।
শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি যে কী অঝোর ধারায় নেমেছে!
চারদিক কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই আচ্ছন্নতায় নিজেকেও যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে মায়া। তার পরনে সেই পাতা রংয়ের শাড়ি। উঠোনে নেমে গভীর বৃষ্টিতে সে হয়ে গেছে মেঘবালিকা। ধীর মন্থর ভঙ্গিতে নাচছে, প্রাণখুলে গাইছে রবীন্দ নাথের বর্ষার গান।
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদলদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে চন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
মেঘমলস্নারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-মন চায়
মন চায় হূদয় জড়াতে কার চিরঋণে ।।
নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে নীলু। মায়ার গান শুনছে, মায়াকে নাচতে দেখছে। এক সময় নিজের মধ্যে আশ্চর্য এক ঘোর তৈরি হলো তার। নিজের অজান্তেই যেন ঘর থেকে বেরুলো সে। মায়ার সামনে এসে দাঁড়াল।
নীলুকে দেখেই নাচ থামালো মায়া।
নীলু বলল, না না থেমো না, থেমো না। গাও। শেষ দুটো লাইন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাও। তুমি গান গাইবে আর বৃষ্টিতে ভিজবে, আমি তোমার গান শুনবো আর বৃষ্টিতে ভিজবো। আর আমাদের দু'জনকে নিয়ে জয় গোস্বামী লিখবেন, 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল'।
মায়া কথা বলল না, মিষ্টি করে হাসল। তারপর গাইতে লাগল।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-মন চায়
মন চায় হূদয় জড়াতে কার চিরঋণে ।।
মায়ার গানের রেশ কানে লেগে থাকতে থাকতেই ঘুম ভাঙল নীলুর। বিছানায় উঠে বসল সে। চোখে এখনও সেই স্বপ্নদৃশ্য। গভীর বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া উঠোনে পাতা রংয়ের শাড়ি পরে নাচছে মায়া, গান গাইছে।
কিন্তু বাস্তবে বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই। খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর এসে ঢুকেছে সকালবেলার রোদ। কখন ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে গেছে রাজু, কে জানে। বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল নীলু।
চা।
নীলু চমকে তাকিয়েছে, দেখে চায়ের মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে মায়া। পরনে হালকা ফিরোজা রংয়ের শাড়ি। মুখের লাবণ্য যেন একটু কম। চোখের কোল বসে গেছে। তার মানে রাতে ভালো ঘুম হয়নি মায়ার।
কিন্তু নীলু এসব নিয়ে কথা বলল না। মায়া তার জন্য সকালবেলার চা নিয়ে এসেছে দেখেই সে মুগ্ধ। ঘুম ভাঙার পর বিছানায় বসে একমগ চা অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ার আনন্দের সঙ্গে পাওয়া যাবে মায়ার সানি্নধ্য।
হাত বাড়িয়ে চায়ের মগটা নিল নীলু। ধন্যবাদ।
মায়া আচমকা যেন মুগ্ধ হলো। বাহ্।
বাহ্ কেন?
আজকাল আর ধন্যবাদ কথাটা কেউ বলে না। বলো থ্যাংকস। আপনার মুখে ধন্যবাদ শব্দটা শুনে ভালো লাগল।
নীলু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, এ কদিন তোমাদের ওই শুকতারা চা দিয়ে গেছে। আজ তুমি নিয়ে এসেছো দেখে আমি একটু বেশি মুগ্ধ। মুগ্ধতা বেশি হলে ধন্যবাদ শব্দটা আমি বলি। তুমি একটু বসবে মায়া।
বসলে আপনি খুশি হবেন?
হঁ্যা।
নীলুর মুখোমুখি, পালঙ্কের কোণে বসল মায়া।
নীলু বলল, আজ তোমাকে খুব আপন মনে হচ্ছে।
কেন?
নিজ থেকে চা নিয়ে এলে, আমার কথামতো বসলে।
মায়া কথা বলল না।
নীলু বলল, রবীন্দকুয়ার ধারে' কবিতার গল্পটা তোমাকে বলি?
মায়া নীলুর দিকে তাকাল। আমি জানি।
তুমি জানো?
হঁ্যা।
কবিতাটা তুমি আগে পড়েছো?
না।
তাহলে?
সেদিন আপনার মুখে শুনে কবিতার ভিতরকার গল্পটা আমি বুঝে ফেলেছি।
তাই?
হঁ্যা।
বলো তো?
মায়া মৃদু হাসল। পরীক্ষা নিচ্ছেন?
নীলুও হাসল। হঁ্যা, পরীক্ষা নিচ্ছি। দেখি পাস করতে পারো কি না।
দুপুরবেলা একটি মেয়ে নিমগাছের তলায়, কুয়ার ধারে বসেছিল। ঠিক আছে?
ঠিক আছে। তারপর?
একজন পথিক এসে জল চেয়েছিল।
ঠিক, একদম ঠিক।
কলস থেকে মেয়েটি তার করপুটে, মানে দুহাত একত্র করে মানুষ যেভাবে পানি খায়, না না জল খায়। এখানে পানি শব্দটা ভালো লাগে না।
নীলু মুগ্ধচোখে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। মায়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েটি তার করপুটে জল ঢেলে দিয়েছে। তৃষ্ণা মিটিয়ে মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করেছিল সে। মেয়েটি তাতে লজ্জা পেয়েছিল।
নিজের মুগ্ধতা আর চেপে রাখতে পারল না নীলু। বলল, অসাধারণ। তুমি, তুমিঃ। আমার বিস্ময় লাগছে মায়া। মাত্র একবার শুনে এইভাবে কবিতাটি তুমি মনে রেখেছো? মানে কবিতার মূল বক্তব্যটা, গল্পটা মনে রেখেছো? সত্যি বিস্ময়কর!
মায়া উদাস হলো। কারো কারো কণ্ঠে শোনা সবকিছুই মনে থাকে। কেন থাকে, কে জানে।
নীলু উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, এই তো ভাব হয়ে গেছে।
ভাব আরও আগেই হয়েছে।
তাই নাকি?
মায়া কথা বলল না, মাথা নাড়ল।
কবে হলো বলো তো?
যেদিন আপনি বললেন আমাদের নিমগাছটির তলায় একটা কুয়া থাকলে ভালো হতো। আপনি চলে যাওয়ার পর সেই কুয়াতলায় বসে আমি আপনার কথা ভাবতাম।
কিন্তু আমি ওসব বলার পর তো তুমি অনেক রুক্ষ হয়ে গেলে!
কেন হয়েছিলাম এখন আপনার সেটা বোঝার কথা। নিজের ওপর এক ধরনের রাগ থেকে আমি এমন করেছি। এই বাড়ির মেয়ে হয়েও আমি আসলে এই বাড়ির মেয়ে না। তারপর দুঃস্বপ্নের মতো বিয়ে নামের একটি বোঝা চেপে গেছে জীবনে। অথচ আপনিঃ
আমি?
ভাইজানের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি। আপনার ছবি দেখেছি ভাইজানের অ্যালবামে। মনে মনে কতদিন চেয়েছি আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন। সামনা সামনি আপনাকে দেখি, আপনার সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি। আশ্চর্য এক ভালো লাগায় কেটে যাক সময়টা। সেই আপনি এলেন ঠিকই, এমন সময়ে এলেন, যখন আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। আমি আর আমি নেই। হয়তো নিজের ওপরকার রাগ থেকেই আমি আপনার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছি। তারপর আমি আবার কষ্টও পেয়েছি।
আপনি এখানে আসার পর একটি রাতও আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার প্রতিটি রাত কেটেছে না ঘুমিয়ে। বিয়ের পর এলোমেলো তো আমি হয়েছিই, আপনাকে দেখার পর, আপনি এখানে আসার পর আরো এলোমেলো হয়ে গেলাম। সেই রাতে বলেছিলাম, নিজের কথা আপনাকে আমার বলতে ইচ্ছে করে, আমি আজ বলে দিলাম। আপনার যা মনে হয় আপনি ভাবতে পারেন। না বলে আমার উপায় ছিল না।
অনেকক্ষণ মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল নীলু। তারপর গম্ভীর পরিবেশটা আচমকাই হালকা করে ফেলল। এই তো ভাব হয়ে গেছে। না, আর এখানে থাকা যাবে না। পরে ভাব থেকে ভালোবাসা হয়ে যাবে। একটি বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে ভাইয়ের অবিবাহিত বন্ধুর প্রেম। যখন তখন শুধু সুনীলের কবিতা মনে হবে 'ভ্রু পলস্নবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে'। অথবা 'তোমাকে যখন দেখি, তারচে' বেশি দেখি, যখন দেখি না'। এখানে আর থাকা যাবে না। একদম না।
মায়া বলল, আপনার এত রোমান্টিক হওয়া ঠিক হয়নি।
সেদিন বিকেলেই ঢাকায় রওনা দিয়েছিল নীলু। ট্রেনে সারাক্ষণ তার মনে পড়েছে মায়ার কথা।
মায়ার মায়াবী মুখখানি সারাক্ষণ লেগেছিল চোখে। শ্রাবণ দিনের বৃষ্টিতে বাড়ির উঠোনে নেচে নেচে গান গাইছে মায়া, এই স্বপ্ন জেগে জেগেও দেখছিল। আর দেখছিল উদাস দুপুরে নিমের ছায়ায়, একটা কুয়ার ধারে বসে আছে মায়া। মুখে পৃথিবীর যাবতীয় বিষণ্নতা। ওভাবে বসে কথা ভাবে সে, কার কথা মনে পড়ে?
কুয়ার ধারে দুপুরবেলা তেমনি ডাকে পাখি,
তেমনি কাঁপে নিমের পাতা, আমি বসেই থাকি।
মায়া কার জন্য ওভাবে একা একা নিমের ছায়ায় বসে থাকে!
======================
গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ  ইমদাদুল হক মিলন


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.