শিল্পঋণে রাজনৈতিক প্রভাবের পূর্ণ দমন সম্ভব নয়: অর্থমন্ত্রী

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের (এসসিবি) শিল্পঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব পুরোপুরি দমন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তবে অর্থমন্ত্রী মনে করেন, পুরোপুরি দমন করতে না পারলেও রাজনৈতিক প্রভাব কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমান সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমরা বোধ হয় সে তুলনায় এ ক্ষেত্রে তেমন একটা রাজনৈতিক প্রভাব খাটাচ্ছি না।’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) আয়োজিত ‘শিল্পঋণ প্রাপ্তি ও দুর্নীতি হ্রাস’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। ইউএসএইড-প্রগতির সহযোগিতায় শিল্পঋণে দুর্নীতির ওপর তৈরি করা সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আইবিএফবির নির্বাহী পরিচালক এম মফিজুর রহমান। আইবিএফবির সভাপতি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামান ফারুক ছিলেন কর্মশালার সঞ্চালক।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, একসময় ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের ৯০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে থাকলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। অথচ দেশব্যাপী আওতা ও শাখা রয়েছে এদের।
প্রতিবেদনে এসব ব্যাংকে দুর্নীতির কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের মনোনীত পরিচালকদের কোনো জবাবদিহি নেই। রাজনীতিবিদ, আমলা ও অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যাংকের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন (সিবিএ)। এ ছাড়া ভালো কাজের জন্য পুরস্কার ও খারাপ কাজের জন্য শাস্তির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই এসসিবিতে।
শিল্পঋণের অনুমোদন ও বিতরণে অনিয়ম, দুর্নীতি ও কিছু জটিলতার কথা তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, ঋণের আবেদনপত্রের সঙ্গে দুর্নীতির দলিলও জমা দেওয়া হয়। শুরু করা হয় জামানত হিসেবে জমি বা স্থাবর সম্পত্তির বাড়তি মূল্যায়ন দিয়ে। এতে উদ্যোক্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন প্রকৌশলী, ব্যাংকার ও জরিপকারীরা। ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী ও ব্যাংক কর্মকর্তারাও প্রভাবিত হয়ে এসব সম্পত্তির বিপরীতে ঋণ দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
এ ছাড়া ঋণ অনুমোদনে প্রভাব খাটায় সিবিএ। ব্যাংকে তারা সমান্তরাল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালায়। ব্যাংকের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে সিবিএ।
ঋণের জন্য মৌখিক বা লিখিত যেকোনো ধরনের সুপারিশকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা বলে বিবেচনা করা হবে—মন্ত্রিসভা কমিটিকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আরও যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে মেধা ও দক্ষতাকে এসসিবিতে পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার মাপকাঠি করা, ঋণ অনুমোদনে ট্রেড ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখা, শিল্প প্রকল্পে ব্যাংক ও গ্রাহকের অংশ ৭০: ৩০ করা, ব্যাংক খাতের জন্য স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো করা, ঋণপ্রাপ্তির সময়সীমা ৭০ দিন থেকে কমিয়ে ৩০ দিনে নিয়ে আসা ইত্যাদি।
ইব্রাহীম খালেদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, এসসিবিতে দুর্নীতি এসেছে মূলত স্বৈরশাসনের আমলে। স্বৈরসরকার এসসিবিতে শুধু দুর্নীতিই ঢোকায়নি, দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করেছে এবং তাদের রক্ষাও করেছে। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করেন তিনি।
ইব্রাহীম খালেদ বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ স্বয়ং একজনের পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার জন্য তিনি টেলিফোন করেছিলেন একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে।
তিনি আঞ্চলিক পর্যায়ে সিবিএ না রেখে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটিমাত্র সিবিএ এবং একটি ব্যাংকে একটি সিবিএ রাখার সুপারিশ করেন।
আইবিএফবির সভাপতি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নতুন শিল্প স্থাপনে খুব দ্রুত ও সহজ পদ্ধতিতে ঋণ দিতে হবে। তাহলে দেশের বিপুল বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সম্ভব হবে।
এসব সুপারিশের অধিকাংশের সঙ্গেই একমত পোষণ করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, যেসব সুপারিশ এসেছে, সেগুলো ভালো। কিছু কিছু এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকিগুলো খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে না। ঋণপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৭০ দিন লাগা উচিত নয় বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
একটি সিবিএ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, শুধু ব্যাংক নয়, কোনো সংগঠনেরই একটির বেশি ট্রেড ইউনিয়ন থাকা উচিত নয়।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাংসদ হাফিজ আহমেদ মজুমদার, সাংসদ ফজলুল আজিম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ, ইউএসএইড-প্রগতির ডেপুটি চিফ অব পার্টি জেরেমি কানথর প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.