আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক

শিল্পের নন্দনতাত্তি্বক ধারণা নিয়ে জটিলতার শেষ নেই। এর শুরু সেই প্রাচীনকাল থেকে। প্রাচ্যে সংস্কৃত সাহিত্যে রসতত্ত্বের ব্যাখ্যায় যেমন নন্দনতত্ত্বের উদ্ভাস তেমনি পাশ্চাত্যে গ্রীক দার্শনিকদের কাব্যতত্ত্ব বিচারে অপরিহার্যভাবে নান্দনিকতার বিষয় প্রকাশ পেয়েছে।

প্রসঙ্গত অ্যারিস্টটলে শিল্পতাত্তি্বক বিবেচনা স্মরণ করার মত। যেমন, কবিতা, জীবনের প্রতিরূপ ধারন করেও সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে যে বিশেষ রূপের অভিব্যক্তি ঘটায় (প্রাচ্যের রসতত্ত্বের অনুরূপ)। সেখানেই নান্দনিকতার প্রকাশ বা বিচার্যবিষয়।
ভরতীয় নন্দনতত্ত্বে রূপরস সৌন্দর্য আনন্দ ইত্যাদির বিচার-বিশেস্নষণে 'রস' শব্দটিরই বহুবিভাজিত প্রাধান্য। ভরতের নাট্যশাস্ত্র বিচারে রসের নানারূপ নিয়ে অভিনবগুপ্ত থেকে একাধিক আলংকারির বিচার ও জিজ্ঞাসা বিষয়টিকে যথেষ্ট জটিল করে তুলেছেন।
রস বিচারে শৃঙ্গার হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত ইত্যাদি মূলে শৃঙ্গার বীর, বীভৎস ও রৌদ্ররসের উপস্থিতির কথা ভরতের নাট্যশাস্ত্র উপলক্ষে বলা হলেও এদের শৈল্পিক রূপের প্রকাশে শৃঙ্গার কৌতুক, করুণ, বীর, বীভৎস, বিস্ময়, যেমন অস্বীকার করা চলে না তেমনি বিবেচনা করতে হয় দুঃখ-বেদনা, ক্রোধ, ভয়, বিরক্তি, আনন্দ, উলস্নাস, ইত্যাদি অভিব্যক্তির, তা সে নাটকে হোক বা হোক কবিতাও অন্যান্য শিল্পকলার শাখায়।
অবশ্য একই বিষয়ে অর্থাৎ রস বিচারে অভিনব গুপ্তের উলেস্নখ করে বিলেতি বিশ্বকোষে প্রধান অনুভূতি হিসাবে আনন্দ, হাস্য, দুঃখ, ক্রোধ, ভয়, বিরক্তি, বীর ও বিনয় নির্ভর আট প্রকার রসের কথা বলা হয়েছে। এগুলোরও প্রকাশ ঘটতে পারে একাধিক রূপে এবং সেই সূত্রে নান্দনিক অভিজ্ঞতার উদ্ভব। উলিস্নখিত একাধিক রসের বিভিন্ন রূপ প্রকৃতিভেদ ও অনুষঙ্গ নিয়ে নন্দনতত্ত্ববিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ। শান্ত রসের পাশাপাশি কেউ কেউ ভক্তিকেও রস হিসাবে বিবেচনা করতে আগ্রহী।
অবশ্য রূপ যে রসের ধারক এ বিষয়ে মতভেদ যথেষ্ট না হওয়া সত্ত্বেও বিতর্ক রয়েছে একে উৎস হিসাবে গ্রহণের ক্ষেত্রে। কিন্তু ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে রূপ থেকে তথা বস্তুরূপ থেকে যে রসের উদ্ভাস সে কথা কি অস্বীকার করা চলে? বিশেষ করে শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রেতো মোটেই চলে না। তা সে সম্পর্কে সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রকারগণ যাই বলুন না কেন। এসব ক্ষেত্রে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। রূপ প্রসঙ্গে ঐ সূত্র ধরে তাই বিতর্ক বিস্তর। রূপ বস্তুনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও ভাববাদী দার্শনিকেরা অনেকেই এর চৈতন্যনির্ভর বিমূত অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তাদের বিচারে রূপ কেবল বস্তু নিরপেক্ষই নয়, জ্ঞানেরও অতীত হতে পারে। অর্থাৎ রূপে- অরূপে একাকার। কিন্তু তাদের উলিস্নখিত ধারণা অর্থাৎ রূপের বস্তুনিরপেক্ষ ধারণার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ তাদের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না, তত্ত্বই সেখানে প্রধান হয়ে ওঠে। স্বাভাবতেই বস্তুনিরপেক্ষ রূপ যা কারো কারো ভাষায় শুদ্ধ রূপ নিতান্তই অভিজ্ঞতার অতীত। সেজন্যই যুক্তিবাদী কারো কারো কাছে এমন ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আশ্চর্য যে, এই রূপ অপরূপের ভাববাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে বড় একটা অমিল দেখা যায় না, বৃথাই অভিযোগ ওঠে যে, প্রাচ্যদেশীয় অর্থাৎ ভারতীয় সৈনিক বা জাপানি নন্দনতাত্তি্বকদের ধারনায় ভাববাদিতার প্রভাব সর্বাধিক।
তাই পাশ্চাত্যে নন্দনতত্ত্বের বিষয়গত গুণগত বিচারের পাশাপাশি এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জটিলতার প্রকাশ যথেষ্ট, বিতর্ক বিস্তর। এমনকি রূপ থেকে সুন্দরের ব্যাখ্যায় পশ্চাত্য নন্দনতত্ত্ববিদগণের বক্তব্য যেমন সহজ-সরল বা স্বচ্ছ নয়, তেমনি তাতে ভাববাদিতার প্রকাশও পরিমেয় নয়। তাই নন্দনতত্ত্ব সৌন্দর্য ও অভিরুচির দার্শনিক সমীক্ষা, এমন একটি সংজ্ঞায় পূর্ণতার সন্ধান মেলে না।
শিল্প সৃষ্টির বিভিন্ন শাখা বা চারুকলার মত বিষয় সামনে রেখে সুন্দর-অসুন্দর, শুভ-অশুভ, কল্যাণ-অকল্যাণ বা অনুরূপ দ্বান্দ্বিক নিরিখে নান্দনিকতার শৈল্পিক মূল্যায়ন একটি বাস্তব ধারা হওয়া সত্ত্বেও নন্দনতত্ত্বের সার্বিক বিচারে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট মতবাদ তৈরি করতে গিয়ে তাত্তি্বকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দার্শনিকতার আশ্রয় নিয়েছেন যা বিষয়টিকে জটিল থেকে জটিলতর করছে মাত্র। কিন্তু দার্শনিকদের তাত্তি্বক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য নন্দনতাত্তি্বক নীতিমালা বা গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
বরং এর ফলে তৈরি হয়েছে শিল্প সৃষ্টির মূল্যায়নে নানাতত্ত্ব এবং প্রকরণ, বিষয়, অভিব্যক্তি আবেগ শৈলী ইত্যাদি নানাদিক থেকে শিল্পকর্মের নন্দনতাত্তি্বক বিচার বিতর্কের আবর্ত সৃষ্টি করেছে। এডমন্ড বার্কের নন্দনতাত্তি্বক ধারণায় মহৎ ও সুন্দরের ব্যাখ্যা যেমন নন্দনতত্ত্বের অবস্থান স্বচ্ছ করে তুলতে পারেনি তেমনি পারেনি কান্টের বস্তুবিচারের ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা হেসেলীয় দর্শনের দ্বিচারিতা। শিল্পকর্ম অনুভবগ্রাহ্য বিষয় হওয়ার কারণে এর মধ্যে বস্তুধর্মিতার প্রকাশ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক গুণধমর্ী রূপায়ণ।
এ ক্ষেত্রে ভাববাদী দার্শনিকেরা বরাবরই বিষয় ও প্রকরণ বিচারে প্রকরণ তথা কর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। কেউ আবার উলিস্নখিত বিষয় ও আঙ্গিক অবিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। যেখানে কর্ম হয়ে উঠেছে প্রধান। চিত্রসমালোচক ক্লাইভ বেল তাই শিল্প সৃষ্টিকে সিগনিফিকেন্ট কর্মরূপে দেখেন।
আর সে তাৎপর্যপূর্ণ ফর্মে পরম সত্তার আভাস পান। শিল্প সৃষ্টির মূল্যায়নে ভাববাদিতার এ চরম রূপায়ন একাধিক শিল্পী দার্শনিককে শিল্প বিচারে ফর্মের ফর্মালিজমে পথ হারাতে দেখা গেছে। 'রূপ বর্ণ ও স্থান' এমন এক ত্রিমাত্রিকতায় শিল্প সৃষ্টিতে রসের উদ্ভব, অর্থাৎ বিষয়বস্তুহীন রূপরসের উদ্ভব এ ধরনের বক্তব্য নান্দনিকতার প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয়েছে।
অবশ্য অপেক্ষাকৃত অনুগ্র তাত্তি্বকদের মতে শিল্পকর্মের অন্তর্নিহিত কিছু স্থায়ী গুণ নান্দনিক অনুভব সৃষ্টি করে যা শিল্প সুন্দরের ব্যাখ্যায় ব্যবহূত হতে পারে। এ পথেই এক পা বাড়িয়ে বেনেদিত্তো ক্রোচে শিল্পকর্মের নান্দনিকতার ব্যাখ্যা 'ংবহংড়ৎু বসনড়ফরসবহঃ' -এর প্রতি নির্বিচার সমর্থন যোগান। তাঁর মতে শিল্প সৃষ্টিতে প্রাকৃত ঘটনা বা বস্তুধর্মের কোন স্থান নেই। শিল্পকর্ম বরং স্বজ্ঞা তা অন্তর্জ্ঞানের সাহায্যে সৃষ্টি যা পাঠক বা দর্শকের নান্দনিক অনুধাবনের বিষয় হয়ে ওঠে।
এ ধরনের তত্ত্বেও শিল্পের নন্দনতাত্তি্বক অনুধাবন স্পষ্ট হওয়া দূরে থাক তাতে ভাববাদিতার অস্পষ্টতাই প্রধান হয়ে ওঠে, কখনো সেখানে অধ্যাত্মবাদিতার মেঘও এসে জমা হয় যা ঐশী চেতনার পরমকে ডেকে আনে। হেগেল তাই শিল্প সৃষ্টির নান্দনিক ব্যাখ্যায় শিল্পধারার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী আধ্যাত্মিক বিষয়ের বিবেচনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। শিল্পবিচারে হেগেল-কথিত এ অধ্যাত্মবাদিতার জোয়ারে তাঁর বহুনন্দিত দ্বান্দিকতার সূত্র অজানালোকে ভেসে যায়।
একই ভাবে নিরাসক্ত ভাবনার নন্দনতাত্তি্বক অভিজ্ঞতা সৌন্দর্য বিচারের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়, দাঁড়ায় ভাববাদী ফর্মের আলোয়। প্রসঙ্গত কন্ট কথিত নান্দনিক অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থাৎ বস্তুধর্মিতার নিরিখে বিচার করেই লেখেন 'আমার মতে নন্দনতত্ত্বের মূল কথা হল নান্দনিক অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার বিচার বিশেস্নষণ করা, সাধারণ রীতিনীতি বিশেষ করে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখানোই তাত্তি্বকের প্রধান কর্তব্য।'
আবার এমন ধারণারও প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় যে, নান্দনিক অভিজ্ঞতা বিষয়-নির্ভর হয়েও মনও কল্পনাসহ নিছক ব্যক্তি চৈতন্য নির্ভর। এমনকি রূপ কিংবা সৌন্দর্যের ধারণাও ব্যক্তি চেতনা নির্ভর। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এমন চিন্তা কাজ করে শিল্প সর্বস্বতার নন্দনতত্ত্বে প্রাধান্য পায়। কল্পনা শিল্প সৃষ্টির আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া হিসাবে উঠে আসে।
হিউমের বিচারে এ প্রক্রিয়ায় নান্দনিক অভিজ্ঞতা থেকে ভাব তথা 'আইডিয়া'র উদ্ভাস। কাষ্ট অবশ্য কল্পনাকে নন্দনতাত্তি্বক অভিজ্ঞতার সঙ্গে একাকার করে দেখতে আগ্রহী। তাঁর ধারণায় স্বজ্ঞা ও ধারণার (ওহঃঁরঃরড়হ ও ঈড়হপবঢ়ঃ) সমন্বয়ের পেছনে রয়েছে কল্পনা- যা শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞতার রূপ পরিগ্রহ করে।
শিল্প সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে নান্দনিকতা তথা শিল্পতত্ত্বের নান্দনিকতা নিয়ে এ ধরনের বিভিন্ন মতবাদের প্রকাশ প্রধানত ভাববাদিতার প্রধান্য ঘটাতেই দেখা গেছে যে কথা একাধিক প্রসঙ্গে উলিস্নখিত। এমন কথাও বলা হয় যে, শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পীর উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা বিচার্য বিষয় নয়, সৃষ্টিই বিচার্য বিষয়। অর্থাৎ কোনো শিল্প সৃষ্টির গুণগত, সৌন্দর্যগত বা তাৎপর্যগত বিষয় শিল্পীর চিন্তা ভাবনা-নিরপেক্ষতায় বিচার-ব্যাখ্যাই নন্দনতাত্তি্বক দিক থেকে সঠিক।
শিল্প সৃষ্টিকে যদি আবেগের অভিব্যক্তি (রুশো) হিসাবে মেনে নেওয়া হয় তাহলে সেখানে সৌন্দর্য বা সঙ্গীতের প্রকাশ আর ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, চৈতন্য নিরপেক্ষ থাকে না। এমন কি থাকে না কান্ট-কথিত নৈতিক ও আধ্যাতি্বক তাৎপর্যের নান্দনিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও। শিলার থেকে হেগেল সবাই শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তির সত্যকে স্বীকার করেও রোমান্টিক ভাববাদিতাকেই প্রধান করে তুলেছেন। সেই সূত্রে টেনে এনেছেন আধ্যাতি্বকতা, ঐশীচেতনা, পরম বা শাশ্বতীর কল্পনা। আবার সৌন্দর্য সঙ্গীত ও আনন্দও নানা সূত্রে যুক্ত হয়ে নান্দনিক বিচারের ক্ষেত্রটিকে জটিল করে তুলেছে। কারো কারো মতে, এজন্য দায়ী নন্দনতত্ত্বের ওপর দার্শনিকতার প্রবল প্রভাব।
শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে সৌন্দর্য যেমন বিচার্য বিষয় তেমনি-এর নন্দনতাত্তি্বক বিশেস্নষণে আরো একাধিক উপাদান বিবেচনায় চলে আসে। যেমন আনন্দ নামীয় অনুভবের বিষয়টি। সৌন্দর্যের বিচার-বিশেস্নষণ করতে গিয়ে জর্জ সান্তায়ন আনন্দকে সৌন্দর্যের সঙ্গে একাকার নিয়েছেন। সুন্দর আনন্দের উৎস এবং সেদিক থেকে নান্দনিক অনুভবেরও মূল কথা। 'মানুষের সর্বকর্মের ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত হয়েই সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ। আর সেক্ষেত্রে তার রূপ ও অভিব্যক্তি দুই পাশর্্বমুখ হিসাবে বিবেচিত হবার যোগ্য। এক্ষেত্রে তিনি ভাবানুষঙ্গের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন যে, অভিব্যক্তিবাদের মূল কথা হল বস্তুগত উপাদান থেকে উদ্ভূত সৌন্দর্য, আনন্দ ইত্যাদির প্রকাশ বা অভিব্যক্তি এবং এদুইয়ে মিলেমিশেই নান্দনিক অভিজ্ঞতা তথা নান্দানিক আনন্দের প্রকাশ।
আধুনিক নন্দনতত্ত্বে ক্রোচের প্রভাব যথেষ্ট হলেও বস্তুবাদী বা মার্কসবাদী তাত্তি্বকগণ তা গ্রহণ করার পক্ষপাতী নন। বিশেষ করে ক্রোচে যেখানে বিষয় ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও 'ইনটুইশন' বা অন্তর্জ্ঞানকে প্রধান করে তোলেন সেখানেই আপত্তি ও বিতর্ক দেখা দেয়। ক্রোচেশিষ্য কলিউডকে নিয়েও প্রায় একই ধরনের তাত্তি্বক সমস্যা। সমস্যা যেমন অভিব্যক্তি নিয়ে, উপায় (সবধহং) এবং লক্ষ্য তথা সমাপন নিয়ে- বিশেষ করে লক্ষ্য বা সমাপন (বহফ) যেখানে আপনাতেই আপনি সম্পূর্ণ- তেমনি সমস্যা কল্পনার ভূমিকা নিয়েও। কল্পনা সেখানে অভিজ্ঞতাকেও অতিক্রম করে যায়।
ললিতকলার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য আনন্দ প্রসঙ্গে, সৌন্দর্য প্রসঙ্গে কথাটা তার মত করেই বলেছেন। তার বিচারে শিল্প সৃষ্টির লক্ষ্য উপলব্ধির আনন্দ, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ী এক হয়ে যাওয়াতে যে আনন্দ, অনুভূতির গভীরতা দ্বারা বাহিরের সঙ্গে অন্তরের একাত্মবোধ যতটা সত্য হয় সেই পরিমাণে জীবনে আনন্দের সীমানা বেড়ে চলতে থাকে, অর্থাৎ নিজেরই সত্তার সীমানা।' সৌন্দর্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন 'অনুভূতির বাইরে রসের কোনো অর্থই নেই। সৌন্দর্যরসের সঙ্গে অন্য সকল রসেরই মিল হচ্ছে ঐখানে যেখানে সে আমাদের অনুভূতির সামগ্রী।'
অন্যত্র (ঞযব সবধহরহম ড়ভ অৎঃ) রবীন্দ্রনাথ শিল্পের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলেছেন 'নির্বস্তুক রূপরস সত্য বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যার অন্তর্গত হতে পারে কিন্তু বাস্তব জগৎ শিল্পকলারই ভুবন। শিল্পের নান্দনিকতা প্রসঙ্গে আমরা যে সৌন্দর্যের কথা বলি তা সাধারণ অর্থে নয় সৌন্দর্যবোধের গভীরতর অর্থেই বলে থাকি যা কবির ভাষায় 'সত্যই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই সত্য' হিসাবে উচ্চারিত।' বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতেই অর্থাৎ জীবন চিত্রণের বাস্তবতায় শিল্পসৃষ্টির সৌন্দর্য আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে।'
এ বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ অনেকাংশে তার নান্দনিকতার প্রকাশ্যে বাস্তববাদী, কিন্তু অন্যত্র একাধিক রচনায় প্রাসঙ্গিক ভাববাদিতার প্রকাশও রয়েছে। এজরা পাউন্ডের নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক একটি কবিতার আলোচনা শেষে রবীন্দ্রনাথ (আধুনিক কাব্য) শিল্পসৃষ্টিতে পরিস্ফূট সৌন্দর্যকে 'নৈর্ব্যক্তিক' আখ্যা দিয়েছেন একই ছেলের চোখে সুন্দরী মেয়েও মার্কিন মাছের সৌন্দর্যে উপলব্ধির প্রসঙ্গ টেনে। সেই সঙ্গে তার বহুকথিত 'বিষয়ীর আত্মতা ও বিষয়ের আত্মতা'র প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন।
আবার সাহিত্যতত্ত্বের ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথ এমন কথাও বলেছেন যে, প্রাকৃত সৌন্দর্য তখনই সুন্দর যখন তার সঙ্গে 'মনের দান মেশে' সৌন্দর্য তখন 'মনোহর' হয়ে ওঠে। আরো বলেছেন 'আনন্দময় রূপস্বস্তিতে বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তির একাত্মতা'র কথা। কিন্তু প্রায় একই সঙ্গে বলেছেন পরমপুরুষের সঙ্গে ব্যক্তির পারস্পরিকতার কথা।
যার মাধ্যমে সত্যের অসীম রহস্য, সৌন্দর্যের অনির্বচনীয়তা উদ্ভাসিত হয়। এতদসত্ত্বেও শিল্পের নন্দনতাত্তি্বক ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণে রবীন্দ্রনাথকে মধ্যপন্থী বলা হয়েছে। এজন্য যে বস্তুগত ও পরমের পারস্পরিকতার মতই, সৌন্দর্য ও আনন্দের জাগতিক উপলব্ধির মতই রবীন্দ্রনাথ শিল্প সৃষ্টিকে সয়াতি করেন ঘটনা (ভধঁঃং) ও ভাবের (রফবধং) আবেগময় প্রকাশ হিসাবে। পাশ্চাত্য নন্দনতাত্তি্বকদের কথিত ংবহংড়ৎু বসনড়ফরসবহঃ রবীন্দ্রনাথে এসে অধিকতর মাত্রায় ব্যক্তিনির্ভর, অভিজ্ঞতা নির্ভর, উপলব্ধি নির্ভর হয়ে ওঠে। এজন্যই শিল্পসৃষ্টির নান্দনিকতা বিচারে রবীন্দ্রনাথকে মধ্যপন্থা বলা সঙ্গত।
শিল্পের নন্দনতাত্তি্বক ধারণা সম্পর্কে মার্কসবাদীদের প্রত্যয় যে শিল্পসর্বস্বতার বিরোধী, পরম ও ঐশী সৌন্দর্য অবিশ্বাসী বরং সমাজসত্তা ও সামাজিক বাস্তবতার সত্যে বিশ্বাসী সেসব কথা বহু আলোচিত। তবে একথাও সত্য যে শিল্প সৃষ্টির নান্দনিকতা বিচারে মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব একাধিক ধারনায় বিভক্ত তা সত্ত্বেও আর্নস্ট বস্নক গিয়োর্গ লুকাচ বা বেট্রোল্ডব্রেস্ট থেকে ওয়ল্টার বেঞ্জামিনা থিয়োডোর অ্যাডোর্নো প্রমুখ মার্কসবাদী শিল্পতাত্তি্বকগণ মতের ভিন্নতার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের ধারা তৈরি করেছেন বিশেষত লুকাচ।
এদের বক্তব্যে নীতিগত পরস্পর বিরোধিতা সত্ত্বেও এরা মোটামুটিভাবে ঐতিহাসিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শিল্পসৃষ্টির নান্দনিক রূপচরিত্র নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। লুকাচ অবশ্য উলিস্নখিত দ্বিমাত্রিকতার সঙ্গে শ্রেণীচেতনার বিষয়টি অন্তভর্ুক্ত করেছেন এবং শিল্পের চরিত্র বিচারে এদিকে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অন্যদিকে হেগেলীয় ভাববাদী সূত্র প্রভাবিত বস্নক তার অন্য সতর্থদের সঙ্গে একই পথে যাত্রা শুরু করেও অংশত অধ্রুতাবাদী, অংশত, শোপেদ হাওয়ারীও তত্ত্বে প্রভাবিত যেজন্য তার নন্দনতাত্তি্বক শিল্প বিচার লুকাচের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন। শেষ পর্যন্ত দুই সঙ্গীর শৈল্পিক অবস্থান দুই ভিন্ন মেরুতে।
অবশ্য ব্রেঘট সমাজ বাস্তবতার অনুসারী ও শ্রেণীচেতনায় বিশ্বাসী হয়েও লুকাচের তুলনায় শিল্প সৃষ্টির নান্দনিকতা বিচারে অনেকটাই উদার ও সহনশীল। অবশ্য তিনি টলাটয় বা ব্যালমক থেকে একাধিক জীবনবাদী বুর্জোয়া কথাশিল্পীর সৃষ্টির ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে ভিন্ন কারণে লুকাচের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিনত্ত্ব সৃষ্টির পক্ষপাতী। সেজন্য মতাদর্শগত চৌসুপির বাইরে শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে শর্তাধীন অবস্থায়ও শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।
আর সেকারণেই তিনি শিল্পসাতে অন্তপুরে স্বগতভাষণ (রহঃবৎরড়ৎ সড়হড়ষড়মঁব) বা মন্তাজ বা অনুরূপ প্রাকরণিক কৌশল ব্যবহারের বিরোধিতা করেন না।
করেন না যতক্ষণ সেসব সৃষ্টিতে সমাজ বাস্তবতার সত্য প্রকাশ পায়। তার মঞ্চনাটক তাই সমাজবাস্তবতার প্রকাশ ঘটিয়েও নন্দনতাত্তি্বক বিচারে ভিন্নমতবাদীদের প্রশংসা কুড়াতে পেরেছে। লুকাচের নন্দনতাত্তি্বক ধ্যান-ধারণা অবশ্য বহুলাংশে ব্রেখটীয় ধারণার সঙ্গে মেলে না। বলা বাহুল্য বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার। এ আলোচনা যেমন বাস্তববাদ বনাম আধুনিকতা নিয়ে তেমনি কথিত ভাববাদী নন্দনতত্ত্ব বনাম মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব নিয়ে যেখানে জড়িত একাধিক ধীমান, একাধিক শিল্প প্রতিভা, এরা সবাই সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তিত্ব। এমন কি জড়িত ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও নববাস্তববাদের ধারণা এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে নান্দনিকতার বিবেচনা।
শিল্পের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে এমনি ধারার বিতর্ক, ভিন্নমত ও জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে এক কথায় বলা চলে যে শিল্প সৃষ্টির নান্দনিক মূল্য নির্ভর করে এর স্বচ্ছতার ওপর। বিষয় নিষ্ঠা ও উপভোগ্য সৌন্দর্যের ওপর অস্পষ্টতা বা বিশৃংখলা তথা নৈরাজ্যের ওপর নয়। তবু অবশেষে সিদ্ধান্তে পেঁৗছাতে কেউ কেউ হয়তো ঐ দুই বিপরীতের দ্বন্দ্ব স্বীকার করে নেন যেমন নভোবিজ্ঞনীরা মেনে নেন মহাবিশ্বের ধারণায় শৃংখলা ও বিশৃংখলার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের বিষয়টি।
এ ছাড়াও মনে রাখা দরকার যে দেশকাল ও সমাজ বিচারে যেমন শিল্পের তত্ত্বগত ধারণা বদলায় তেমনি পরিবর্তন ঘটে নন্দনতাত্তি্বক ধারণারও। বদলায় আধুনিকতার চরিত্ররূপও। তাই শিল্পস্থষ্টির মূল্যায়নে বা তার নান্দনিকতার নির্ধারণ ব্যক্তিক ও সামুহিক প্রেক্ষাপট বিচার যেমন অনিবার্য তেমনি অপরিহার্য সমকালের নিরিখে বিষয় ও প্রকরণগত বিচার-বিবেচনাও। অর্থাৎ একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বমাত্রিক বিচারই ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত। শিল্প সৃষ্টি বুঝতে তার সৌন্দর্য অনুধাবন করতে বা রূপরস উপভোগ করতে সর্বোপরি মূল্যায়নে উলিস্নখিত সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি খুবই জরুরি। তা না হলে একদেশদশর্ী সংকীর্ণতাই প্রধান হয়ে ওঠে।
===========================
আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন  গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার   গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান  গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার  গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী 



দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ আহমদ রফিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.