গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক (অনুবাদঃ নাজিব ওয়াদুদ

মূলত এটি একটি উপন্যাস। বিশ্ববিখ্যাত কথাসাহিত্যিক অরহ্যান পামুকের জন্ম তুরস্কের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বন্দর নগরী ইস্তাম্বুলে, ১৯৫২ সালের ৭ই জুন। তিনি ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। দি হোয়াইট ক্যাসল (১৯৮৫, ইংরেজী অনুবাদ ১৯৯১),

দি বস্ন্যাক বুক (১৯৯০, ইংরেজী অনুবাদ ১৯৯৪), দি নিউ লাইফ (১৯৯৪, ইংরেজী অনুবাদ ১৯৯৭), মাই নেম ইজ রেড (১৯৯৮, ইংরেজী অনুবাদ ২০০১), স্নো (২০০২, ইংরেজী অনুবাদ ২০০৪), ইস্তাম্বুল: মেমোরিজ এন্ড দি সিটি (২০০৩, ইংরেজী অনুবাদ ২০০৫) এবং দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স (২০০৯) তার বিখ্যাত রচনা। এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০টি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে।
পামুক মূলত উপন্যাস লেখেন। প্রচুর কলাম ও প্রবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু গল্প বা উপন্যাসিকা লিখেছেন মাত্র কয়েকটি। তার কোনও গল্পগ্রন্থ নেই। সেই বিরল রচনাগুলোর একটি এই অনূদিত উপন্যাসিকা। ২০০৭ সালে ফেবার এন্ড ফেবার প্রকাশিত অরহ্যান পামুকের গদ্য রচনার বই আদার কালার্স-এ এই উপন্যাসিকাটি ছাপা হয়। মূল তুর্কী ভাষা থেকে এটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন ঔপন্যাসিক-অনুবাদক মওরিন ফ্রিলি।]

দেখার বা শোনার মতো কিছু না থাকলে জীবন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। শৈশবে একঘেয়েমি তাড়াতে আমরা রেডিও শুনতাম, নাহয় দৃষ্টি ছড়িয়ে দিতাম জানালার বাইরে পাশর্্ববর্তী অ্যাপার্টমেন্টের দিকে, কিংবা নিচের সড়কে চলাচলকারী লোকদের ওপর। সেসব দিনে, ১৯৫৮ সাল সেটা, তুরস্কে টেলিভিশন চালু হয়নি। কিন্তু আমরা সেটা স্বীকার করতে চাইতাম না। আমরা আশাবাদীর মতো টেলিভিশন নিয়ে আলোচনা করতাম, যেরকম করতাম হলিউডের অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম নিয়ে, যা ইস্তাম্বুলের সিনেমাহলে এসেছে আরো চার-পাঁচ বছর পর, আমরা এটাকে বলতাম 'আসার পথে।'
জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো এত বড় গুরুত্বপূর্ণ আমোদ-প্রমোদের ব্যাপার ছিল যে, যখন শেষ পর্যন্ত তুরস্কে টেলিভিশন এল তখনও লোকেরা তাদের সেটের সামনে বসে সেরকম আচরণই করতে থাকল যা তারা আগে করত তাদের জানালার সামনে বসে। যখন আমার পিতা, আমার চাচারা, এবং আমার দাদী টেলিভিশন দেখতেন তখন কারো দিকে না তাকিয়েই তারা যুক্তিতর্ক করতেন, মাঝে মাঝে একটু থামতেন এক্ষুণি কী দেখলেন তা নিয়ে আবার আলোচনা করার জন্য, ঠিক যা করতেন জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে।
'এভাবে যদি তুষার পড়তে থাকে তাহলে সব কিছু অচল হয়ে পড়বে,' আমার চাচী বললেন, পাক খেয়ে খেয়ে পিছিয়ে যাওয়া তুষারকণার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে।
'আরে হেলভা বিক্রেতা লোকটা নিসানতাসি মোড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে যে!' অন্য একটা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলি আমি, সামনের রাস্তায় সারিবদ্ধ গাড়িগুলোর দিকে দৃষ্টি আমার।
রোববারে আমরা, আমার চাচা, চাচী, এবং নিচের অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় বসবাসকারী প্রত্যেকে, আমার দাদীর সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে ওপরতলায় যেতাম। খাবার আসার জন্য অপেক্ষার সময় আমি যখন জানালার পাশে দাঁড়াতাম, তখন আমার আম্মা, আমার আব্বা, আমার চাচারা, আমার চাচীরা, এবং আর আর সবাইকে এখানে দেখে আমার কী যে খুশি লাগত, মনে হতো যেন লম্বা খাবারের টেবিলের ওপর ঝুলন্ত কাঁচের ঝাড়বাতির মস্নান আলোয় সব কিছু জ্বলজ্বল করছে। আমার দাদীর বসার ঘরটা ছিল অন্ধকার, নিচতলার বসার ঘরগুলোর মতোই, কিন্তু এটা যেন বেশি অন্ধকার। তার কারণ সম্ভবত উভয় পাশের কখনো-না-খোলা ব্যালকনি-দরোজায় ঝুলন্ত রেশমের জরিওয়ালা ভারি পর্দা এবং আচ্ছাদন, যা ভীতিকর সব ছায়া তৈরি করে। অথবা এটা হয়তো মুক্তাখচিত পর্দা, বিশাল বিশাল টেবিল, চেয়ার, আলমারি, এবং ছোট রাজকীয় পিয়ানো, ওপরের সব ছবি, অথবা এই বাতাসহীন ধুলোর গন্ধময় ঘরের বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণে।
খাবারের পালা চুকলে আমার চাচা পাশের এক অন্ধকার ঘরে গিয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগলেন। 'আমার কাছে ফুটবল ম্যাচের টিকিট আছে কিন্তু আমি যাচ্ছি না,' তিনি বললেন। 'তার বদলে তোমার আব্বা তোমাদের নিয়ে যাচ্ছেন।'
'আব্বা, আমাদের ফুটবল ম্যাচ দেখতে নিয়ে চলো!' অন্য ঘর থেকে আমার বড় ভাইটি চিৎকার করে বলল।
'ছেলেরা কিছু মুক্ত বাতাস সেবন করতে পারবে,' বসার ঘর থেকে বললেন আমার আম্মা।
'তাহলে তুমি ওদের বাইরে নিয়ে যাও,' আমার আব্বা আমার আম্মাকে বললেন।
'আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি,' আম্ম্া উত্তর করলেন।
'আমরা নানীর বাসায় যেতে চাই না,' আমার বড় ভাইটি বলল।
'তোমরা গাড়ি নিয়ে যেতে পারো,' আমার চাচা বললেন।
'পস্নীজ, আব্বু!' আমার ভাই বলল।
তারপর একটা দীর্ঘ আশ্চর্য নিরবতা। এমন যেন ঘরের প্রত্যেকে আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু ভাবছে, এবং যেন আমার আব্বা সে ভাবনাগুলো কী তা বলতে পারবেন।
'তার মানে আমাকে তোমার গাড়িটা দিচ্ছ, তাই তো?' আমার আব্বা চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন।
পরে, যখন আমরা নিচে গেলাম, তখন মা আমাদের পুলওভার এবং উলের মোটা মোজা পরিয়ে দিচ্ছিলেন, আর আমার আব্বা করিডোরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পায়চারি করছিলেন। আমার চাচা তার 'চমৎকার, ঘিয়ে রঙের' ৫২ ডজকে তাসভিকিয়ে মসজিদের সামনে দাঁড় করালেন। আব্বা আমাদের দুই ভাইকে সামনের সিটে বসার অনুমতি দিলেন এবং একবার চাবি ঘুরিয়েই ইঞ্জিন চালু করতে সমর্থ হলেন।
স্টেডিয়ামে কোনও লাইন ছিল না। 'এই টিকিট এই দু'জনের জন্যে,' আমার আব্বা গেটে দণ্ডায়মান লোকটাকে বললেন। 'একজনের বয়স আট, আরেকজনের দশ।' লোকটার চোখের দিকে তাকাতে আমাদের ভয় হচ্ছিল। ভেতরে ঢুকলাম আমরা। গ্যালারিতে প্রচুর ফাঁকা সিট ছিল। আমরা তৎক্ষণাৎ বসে পড়লাম।
ততক্ষণে কর্দমাক্ত মাঠে দু'টো টিমই উপস্থিত, খেলোয়াড়রা জ্বলজ্বলে শাদা শর্টস পরে ওয়ার্ম-আপ করছে। আমি সেটা উপভোগ করতে লাগলাম। 'দ্যাখ্, ওইটা হচ্ছে ছোট মোহাম্মদ,' একজনকে দেখিয়ে আমার ভাই বলল। 'সে সবেমাত্র জুনিয়র টিম থেকে এসেছে।'
'জানি।'
ম্যাচ শুরু হলো। দীর্ঘক্ষণ আমরা আর কথা বললাম না। কিছুক্ষণ পর আমার চিন্তা ম্যাচ থেকে সরে গিয়ে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হলো। ফুটবল খেলোয়াড়দের সবার পৃথক পৃথক নাম থাকা সত্ত্বেও ওরা প্রত্যেকে একই রকম স্ট্রাইপওয়ালা গেঞ্জি পরে কেন? আমার মনে হলো মাঠে যারা দৌড়াদৌড়ি করছে তারা আর খেলোয়াড় নয়, একেকটা নাম মাত্র। ওদের শর্টসগুলো ক্রমেই ময়লা থেকে ময়লাতর হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম পেছনে বসফরাসের বুক বেয়ে একটা চমৎকার চিমনিওয়ালা জাহাজ ধীর গতিতে ভেসে চলেছে। হাফ-টাইমের মধ্যে কোনও পক্ষই গোল করতে পারল না, আব্বা আমাদের প্রত্যেককে মটরশুঁটির মোচা আর পনিরের পিঠা কিনে দিলেন।
'আব্বু, আমি আর খেতে পারছি না,' আমার হাতের অবশিষ্ট খাবারগুলো দেখিয়ে বললাম আমি।
'ওখানে রেখে দাও,' তিনি বললেন। 'কেউ দেখতে পাবে না।'
অন্য লোকদের মতো আমরাও উঠে হাত-পা ছাড়াতে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। আব্বার মতো আমাদের হাত উলের ট্রাউজার্সের পকেটে। পেছন থেকে কেউ একজন আমার আব্বার নাম ধরে ডাকল, আমরা ঘুরে পেছনের দিকে তাকালাম। হইচইয়ের ভেতর তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না, সেটা বুঝাতে আব্বা তার হাত কানের পেছনে ধরলেন।
'আমি আসতে পারছি না,' আমাদের দেখিয়ে বললেন, 'আমার ছেলেরা আমার সঙ্গে আছে।'
লোকটা একটা লাল রঙের স্কার্ফ পরে আছে। সে আমাদের সারিতে আসার জন্যে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করল, লোকজনকে ঠেলে-ঠুলে আমাদের কাছে পেঁৗছল।
'এরা তোমার ছেলে?' আব্বার সঙ্গে কোলাকুলি করার পর তিনি বললেন। 'কত বড় হয়ে গেছে, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।'
আমার আব্বা কিছু বললেন না।
'এরা কবে জন্মাল?' আমাদের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন। 'স্কুল শেষ করেই বিয়ে করে ফেলেছ নাকি?'
'হঁ্যা,' তার দিকে না তাকিয়েই বললেন আব্বা। তারা বেশ খানিকক্ষণ আলাপ করলেন। ভদ্রলোক আমাদের দিকে ঘুরে আমাদের দুই ভায়ের হাতে আমেরিকান চীনাবাদাম গুঁজে দিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আব্বা বসলেন, দীর্ঘক্ষণ তিনি কোনও কথা বললেন না।
খেলোয়াড়রা নতুন শর্টস পরে আবার মাঠে নামল। তার কিছুক্ষণ পর আব্বা বললেন, 'চলো, বাড়ি যাওয়া যাক। তোমাদের ঠাণ্ডা লাগছে।'
'আমার ঠাণ্ডা লাগছে না,' আমার ভাইটি বলল।
'হঁ্যা, লাগছে,' আব্বা বললেন। 'আলীরও ঠাণ্ডা লাগছে। চলো, চলতে শুরু করো।'
অন্যদের সারিতে রেখে আমরা এগোলাম, হাঁটুতে হাঁটুতে ঘষা খেয়ে, কখনও কখনও কারো কারো পা মাড়িয়ে এগুতে গিয়ে আমি আমার ফেলে দেওয়া পনিরের পিঠা পদপিষ্ট করে ফেললাম। আমরা যখন সিঁড়ি ভাঙ্গছিলাম তখন রেফারি খেলা শুরুর বাঁশি বাজাল।
'তোর ঠাণ্ডা লাগছে?' আমার ভাই জিজ্ঞেস করল। 'বললি না কেন যে তোর ঠাণ্ডা লাগছে না?।' আমি চুপ করে থাকলাম। 'বোকা কোথাকার।' ভাই বলল।
'তোমরা বাড়িতে বসে রেডিওতে সেকেন্ড-হাফের খেলার ধারাবিবরণী শুনে নিতে পারবে,' আব্বা বললেন।
'এই খেলা রেডিও প্রচার করছে না,' ভাই বলল।
'এখন শান্ত হও,' আব্বা বললেন। 'ফেরার পথে আমি তোমাদের তাকসিম হয়ে নিয়ে যাব।'
আমরা চুপচাপ বসে থাকলাম।
পৌরোদ্যান পেরিয়ে আব্বা গাড়িটাকে একেবারে নিলামখানার পেছনে নিয়ে গিয়ে রাখলেন। 'কারো কথায় দরজা খুলো না যেন,' তিনি বললেন। 'এক্ষণি আসছি আমি।'
তিনি গাড়ি থেকে বের হলেন। তিনি বাইরে থেকে দরজা লক করার আগেই আমরা বাটনে চাপ দিলাম এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করলাম। কিন্তু আব্বা নিলামের দোকানে না গিয়ে দৌড়ে নুড়িপাথরের রাস্তার অপর পাশে গেলেন। ওপাশে একটা দোকান আছে, তাতে সাজানো হরেক রকম জাহাজ, পস্নাস্টিকের তৈরী বড় বড় এরোপেস্নন ও রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রাকৃতিক দৃশ্যের পোস্টার। সেটা এমনকি রোববারেও খোলা থাকে। তিনি সেই দোকানে গেলেন।
'আব্বা কোথায় গেলেন?'
'আমরা বাড়ি গিয়ে ওপরতলা-নিচতলায় ওঠানামার খেলা খেলব, ঠিক আছে?' আমার ভাই জিজ্ঞেস করল।
যখন আব্বা ফিরে এলেন তখন সে অ্যাকসিলারেটর নিয়ে খেলা করছিল। আমরা নিসানতাসি ফিরে গেলাম এবং আবার সেই মসজিদের সামনে পেঁৗছলাম।
'তোমাদের জন্যে কিছু কেনা যাক, নাকি বলো!' আব্বা বললেন। 'তবে দয়া করে আবার সেই ফেমাস পিপল সিরিজের কথা, বোলো না যেন!'
'ওহ, আব্বু, পিস্নজ!' আমরা পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম।
আমরা আলাউদ্দিনের দোকানে গেলাম। আব্বা আমাদের প্রত্যেককে ফেমাস পিপল সিরিজের ১০ প্যাকেট করে চুয়িংগাম কিনে দিলেন। আমরা আমাদের দালানে ফিরলাম। লিফটে ওঠার সময় আমি এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম যে আমার মনে হলো আমি বোধ হয় আমার প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলব। ভেতরে বেশ গরম। আমার আম্মা এখনও ফেরেননি। আমরা চুয়িংগামের প্যাকেট ছিঁড়লাম, কাগজগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে দিলাম। তার ফল হলো:
আমি পেলাম দুটো ফিল্ড মার্শাল ফেভজি স্যাকম্যাক; একটা করে চার্লি চ্যাপলিন, কুস্তিগীর হামিদ ক্যাপলান, গান্ধী, মোজার্ট, এবং দ্য গ্যল; দুইটা আতাতুর্ক, এবং একটা গ্রেটা গার্বো- নম্বর ২১- আমার ভায়ের এখনও যা হয়নি। এগুলো নিয়ে আমার বিখ্যাত লোকের ছবির সংখ্যা দাঁড়াল ১৭৩, কিন্তু সিরিজ পূর্ণ করতে আমার এখনও ২৭টা ছবি দরকার। আমার ভাই পেয়েছে চারটা ফিল্ড মার্শাল ফেভজি স্যাকম্যাক, পাঁচটা আতাতুর্ক, আর একটা এডিসন। আমরা চুয়িংগাম মুখে ছুঁড়ে দিয়ে কার্ডের পেছনে মুদ্রিত লেখা পড়তে লাগলাম:
ফিল্ড মার্শাল ফেভজি স্যাকম্যাক
স্বাধীনতা যুদ্ধের জেনারেল
(১৮৭৬-১৯৫০)
ম্যাম্বো সুইট্স চুয়িংগাম, ইন্ক্
যে ১০০ বিখ্যাত লোকের ছবি সংগ্রহ করতে পারবে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে একটি চামড়ার বল পুরস্কার দেওয়া হবে।
আমার ভাই ১৬৫টি ছবি গাদা করে ধরে আছে। 'নে, আমরা ওপর-অথবা-নীচ খেলা খেলি।'
'না।'
'আমি তোকে বারটা ফেভজি স্যাকম্যাক দিচ্ছি, তুই আমাকে তোর গ্রেটা গার্বো দে। দিবি?' সে জিজ্ঞেস করল। 'তাহলে তোর কার্ড হবে একশ' চুরাশিটা।'
'না।'
'তোর তো দুটো গ্রেটা গার্বো আছে।'
আমি কিছু বললাম না।
'কালকে স্কুলে যখন টিকা দিবে, টিকা কী কষ্টের তা তো জানিস?' সে বলল। 'তখন কিন্তু আমি তোর সেবা করতে পারব না, বলে দিচ্ছি।'
'আমি তোমার সেবা চাই না।'
আমরা রাতের খাবার খেলাম চুপচাপ। যখন রেডিওতে 'খেলার জগত' শুরু হলো, তখন আমরা শুনলাম যে ম্যাচটা ২-২ গোলে ড্র হয়েছে। মা আমাদের ঘরে শুইয়ে দিতে নিয়ে গেলেন। আমার ভাই তার স্কুলব্যাগ গোছাতে লাগল, আর আমি সিটিংরুমে ছুটে গেলাম। আমার আব্বা জানালার কাছে বসে আছেন, তার দৃষ্টি বাইরে, সড়কের দিকে নিবদ্ধ।
'আব্বা, আমি কাল স্কুলে যাব না।'
'সেটা কেমন করে হয়?'
'কাল ওরা টিকা দিবে। আমার জ্বর আসে, আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আম্মুকে জিজ্ঞেস করো।'
আমার দিকে তাকালেন তিনি, কিন্তু কিছু বললেন না। আমি ড্রয়ারের কাছে ছুটে গিয়ে একটা কলম আর কাগজ নিয়ে এলাম।
'তোমার মা এটা জানে?' প্রশ্ন করে কাগজটা তিনি কিয়ের্কগার্ডের লেখা বইয়ের ওপর রাখলেন। বইটা তিনি সবসময় পড়ছেন কিন্তু শেষ করতে পারছেন না। 'তুমি স্কুলে যাবে, কিন্তু ওরা তোমাকে ইঞ্জেকশন দেবে না,' তিনি বললেন। 'আমি সেটাই লিখব।'
চিঠি লিখে তিনি তাতে স্বাক্ষর দিলেন। সেটা নিয়ে আমি কালির ওপর ফুঁ দিয়ে ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। বেডরুমে এসে সেটা ব্যাগে ঢুকালাম। তারপর বিছানায় উঠে লাফালাফি করতে লাগলাম।
'শান্ত হ,' আমার ভাই বলল। 'এখন ঘুমানোর সময়।'
।। ২ ।।
স্কুলে লাঞ্চের সময় হলো। ক্লাসের সব ছাত্র দুই-দুই করে লাইনে দাঁড়াল। আমরা টিকা নেওয়ার জন্যে সেই পঁূতি-গন্ধময় ক্যাফেটেরিয়াটায় যাচ্ছি। কিছু ছেলেমেয়ে কাঁদছে, অন্যরা অসহায় মলিন মুখে অপেক্ষা করছে। যখন সিঁড়ি বেয়ে আয়োডিনের গন্ধ ভেসে এল তখন আমার হূৎপিণ্ড লাফালাফি শুরু করে দিল। আমি লাইন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ানো শিক্ষকের কাছে গেলাম। পুরো ক্লাস হইচই করতে করতে আমাদের সময় পেরিয়ে গেল।
'হঁ্যা, বলো?' শিক্ষক বললেন। 'কী ব্যাপার?'
আমার আব্বার চিঠিটা বের করে তার হাতে দিলাম।
তিনি ভুরু কুঁচকে চিঠিটা পড়লেন। 'তোমার আব্বা তো ডাক্তার নন, তাই না?' তিনি বললেন। একটুক্ষণ ভাবলেন তিনি। 'আচ্ছা, তুমি ওপরতলায় যাও। রুম নম্বর টু-এ-তে গিয়ে অপেক্ষা কর।'
রুম নম্বর টু-এ-তে আমার মতো রেহাই পাওয়া ছয়-সাতজন রয়েছে। একজন আতঙ্কে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। নীচের করিডোর থেকে আতঙ্কগ্রস্ত কান্নার রোল ভেসে আসছে। চশমা-পরা এক মোটাসোটা ছেলে সশব্দে মিষ্টি কুমড়ার বীচি চিবাচ্ছে আর কিনোভা কমিক বই পড়ছে। দরজা খুলে গেল, ভেতরে প্রবেশ করলেন পাতলা, হালকা শরীরের সহকারী হেডমাস্টার সাইফি বে।
'সম্ভবত তোমাদের কেউ কেউ সত্যি-সত্যিই অসুস্থ, যদি তা-ই হয় তাহলে তোমাদের নীচে যেতে হবে না,' বললেন তিনি। 'কিন্তু যারা রেহাই পাওয়ার জন্যে মিথ্যা বলছ তাদের উদ্দেশে আমি যা বলতে চাই তা হলো- একদিন তোমরা বড় হবে, দেশের সেবা করবে, এমনকি তার জন্য প্রাণ দেবে। আজ স্রেফ একটা ইঞ্জেকশনের ভয় করছ, কিন্তু বড় হয়ে যদি এরকম কর, যথার্থ কারণ ও যুক্তি ছাড়াই, তাহলে তোমরা দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। তোমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত!'
একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। আমি আতাতুর্কের ছবির দিকে তাকালাম, আমার চোখে অশ্রু।
পরে, সকলের অজ্ঞাতে আমরা আমাদের ক্লাসে ফিরে গেলাম। টিকা নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে ছেলেরা। কারো শার্টের হাতা মোড়ানো, কারো চোখে অশ্রু, কেউ ফোঁপাচ্ছে।
'কাছাকাছি বাড়ি যাদের তারা চলে যেতে পার,' শিক্ষক বললেন। 'যাদের নেওয়ার জন্যে কেউ আসেনি তারা অবশ্যই শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কেউ যেন কারো বাহুতে আঘাত করবে না। আগামীকাল স্কুল ছুটি।'
প্রত্যেকে চীৎকার জুড়ে দিল। কেউ কেউ স্কুল ছাড়ার সময় তাদের বাহু ধরে থাকল, অন্যেরা দারোয়ান হিল্মি আফেন্দিকে তাদের বাহুতে লেগে থাকা আয়োডিনের দাগ দেখাতে থামল। আমি যখন রাস্তায় বেরিয়ে এলাম, তখন ব্যাগটা কাঁধে ছুঁড়ে ফেলে দৌড়াতে লাগলাম। কারাবেত কসাইয়ের দোকানের সামনে একটা ঘোড়ার গাড়ি রাস্তা আটকে দিয়েছে, সুতরাং রাস্তার অপর পাশে আমাদের দালানে যেতে আমাকে গাড়ির ফাঁক গলে গলে বেরতে হলো। আমি দ্রুত হাইরির কাপড়ের দোকান ও সালেহর ফুলের দোকান পেরুলাম। আমাদের দারোয়ান হাজিম আফেন্দি আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল।
'তুমি এই সময় এখানে একা একা কী করছ?' সে জিজ্ঞেস করল।
'আজ আমাদের টিকা দিয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি ছুটি হলো।'
'তোমার ভাই কোথায়? তুমি একাই এসেছ?'
'আমি রাস্তার গাড়ির সারি একাই পার হয়েছি। আগামীকাল আমাদের ছুটি।'
'তোমার আম্মা এখন বাইরে,' সে বলল। 'উপরে দাদীর কাছে যাও।'
'আমি অসুস্থ,' আমি বললাম। 'আমি আমাদের ঘরে যেতে চাই। তুমি ঘর খুলে দাও।'
সে দেওয়াল থেকে একটা চাবি টেনে নিল। আমরা লিফটে উঠলাম। আমাদের তলায় উঠতে উঠতে তার সিগারেটের ধোঁয়ায় লিফটের ভেতরটা ভরে গেল। আমার চোখ জ্বলতে লাগল। সে দরজা খুলে ধরল। 'ইলেকট্রিক্যাল সকেট নিয়ে খেলবে না যেন,' দরজা টেনে বন্ধ করতে করতে বলল সে।
ঘরে নেই কেউ, তবু আমি চেঁচাতে লাগলাম, 'কেউ এখানে আছ নাকি, কে আছ ঘরে? বাড়িতে কেউ নেই নাকি?' আমি ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললাম, আমার ভায়ের ড্রয়ার খুললাম, তার ফিল্ম টিকিটের সংগ্রহটা খুঁজতে লাগলাম। সেটা আমাকে কখনও দেখায়নি সে। আমার নজর পড়ল একটা খাতার ওপর, সেটায় খবরের কাগজ থেকে কাটা ফুটবল ম্যাচের ছবি আঠা দিয়ে আটকানো। পদশব্দ শোনা গেল, আমি বলতে পারি এটা আমার আম্মার নয়, আব্বার পদশব্দ। আমি আমার ভায়ের টিকিট এবং খাতাটা সযত্নে যথাস্থানে রেখে দিলাম যেন সে বুঝতে না পারে আমি সেগুলো হাতড়েছি।
আব্বা তার বেডরুমে, তিনি তার ওয়ার্ডরোব খুলে কী যেন খুঁজছেন।
'তুমি এখনই বাড়িতে যে, কী ব্যাপার?'
'না, আমি প্যারিসে,' আমি বললাম, যেমন করে সব স্কুলে বলে।
'তুমি আজ স্কুলে যাওনি?'
'আজ আমাদের টিকা দিয়েছে।'
'তোমার ভাই আসেনি?' তিনি জিজ্ঞেস করলেন। 'ঠিক আছে, তাহলে তুমি তোমার ঘরে যাও, আমি দেখতে চাই কতটা শান্ত তুমি থাকতে পার।'
তার কথা মতো কাজ করলাম আমি। আমি জানালায় কপাল ঠেসে ধরে বাইরেটা দেখতে লাগলাম। বড় ঘরের ভেতর থেকে যে আওয়াজ ভেসে এল তা শুনে আমি বলতে পারি আব্বা আলমারি থেকে তার সু্যটকেস বের করলেন। তিনি তার ঘরে ফিরে গেলেন এবং হ্যাঙ্গারের খটমট শব্দ শুনে বলতে পারি তিনি ওয়ার্ডরোব থেকে তার জ্যাকেট এবং ট্রাউজার্স নিলেন। তিনি বারবার ড্রয়ার খুললেন ও বন্ধ করলেন, এতে তার শার্ট, মোজা এবং আন্ডারপ্যান্ট থাকে। সেগুলো সব তার সু্যটকেসে ঢোকানোর শব্দ পেলাম। তিনি বাথরুমে গেলেন, আবার বেরিয়ে এলেন। তিনি সু্যটকেসের তালা বন্ধ করলেন। তারপর আমার ঘরে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।
'তাহলে এখানে তুমি কী করছ?'
'আমি জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছি।'
'আস, আমরা দুজনে মিলে জানালার বাইরেটা দেখি।'
তিনি আমাকে তার কোলে তুলে নিলেন, আমরা দীর্ঘক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। অপর পাশের অ্যাপার্টমেন্ট এবং আমাদের দালানের মাঝখানের লম্বা সাইপ্রেস গাছটা বাতাসে মাথা দোলাতে লাগল। আমার পিতা যেভাবে সুবাস টানলেন সেটা আমার ভাল লাগল।
'আমি দূরে যাচ্ছি,' তিনি বললেন। তিনি আমাকে চুমু খেলেন। 'তোমার মাকে বোলো না। পরে আমি নিজেই তাকে বলব।'
'তুমি কি পেস্ননে চড়ে যাচ্ছ?'
'হঁ্যা,' তিনি বললেন। 'প্যারিসে যাচ্ছি। একথা আর কাউকে বোলো না।' তিনি তার পকেট থেকে একটা বড় আড়াই লিরার কয়েন বের করে আমাকে দিলেন, তারপর আবার আমাকে চুমু খেলেন। 'আর তুমি যে আমাকে এখানে দেখেছ সেকথাও বলবে না।'
আমি মুদ্রাটা সোজা আমার পকেটে রাখলাম। যখন আব্বা আমাকে তার কোল থেকে নামালেন এবং তার সু্যটকেস হাতে নিলেন, আমি বললাম, 'তুমি যেও না, আব্বু।' তিনি আবারও একবার আমাকে চুমু খেলেন এবং তারপর বেরিয়ে গেলেন।
আমি তাকে জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম। তিনি সোজা আলাউদ্দিনের দোকানে গেলেন, তারপর একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালেন। সেটায় ওঠার আগে আর একবার আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে তাকালেন এবং হাত নাড়লেন। আমিও হাত নাড়লাম। তিনি চলে গেলেন।
আমি শূন্য রাস্তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। অনেকক্ষণ। একটা স্ট্রিটকার ছুটে গেল, তারপর একটা পানি বিক্রেতা ঘোড়ার গাড়ি। আমি বেল বাজিয়ে হাজিম আফেন্দিকে ডাকলাম।
'তুমি বেল বাজিয়েছ?' দরজার কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করল। 'বেল নিয়ে খেলা কোরো না।'
'এই আড়াই লিরার কয়েনটা নাও,' আমি বললাম, 'আলাউদ্দিনের দোকানে গিয়ে আমার জন্যে ফেমাস পিপল সিরিজের দশটা চুয়িংগাম কিনে আন। দশ কুরুস ফেরত আনতে ভুলো না যেন।'
'এই টাকা কি তোমাকে তোমার আব্বা দিয়েছেন?' সে জিজ্ঞেস করল। 'তোমার আম্মা না রেগে যান।'
আমি কিছু বললাম না। সে চলে গেল। আমি জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম এবং তাকে আলাউদ্দিনের দোকানে যেতে দেখলাম। একটু পরেই সে বেরিয়ে এল। ফেরার সময় সে পথিমধ্যে মারমারা অ্যাপার্টমেন্টস-এর দারোয়ানের কাছে থেমে গল্প করল।
ফিরে এসে সে আমাকে বদলির পয়সা ফেরত দিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে চুয়িংগামের আবরণ ছিঁড়ে ফেললাম। আরো তিনটা ফেভজি স্যাকম্যাক, একটা আতাতুর্ক, এবং লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মহান সুলায়মান, চার্চিল, জেনারেল ফ্রাঙ্কো এবং আরো একটা ২১ নম্বর, গ্রেটা গার্বো, যা আমার ভায়ের এখনও অব্দি একটাও নেই। সুতরাং আমার মোট ছবির সংখ্যা দাঁড়াল ১৮৩। কিন্তু ১০০টার সেট পূর্ণ হতে আমার আরো ২৬টা ছবি দরকার।
আমি আমার ৯১ নম্বর ছবিটার প্রশংসা করছিলাম, এটা সেই বিমানটার ছবি যেটায় চড়ে লিন্ডবার্গ আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়েছিলেন। ঠিক তখনই দরজায় চাবির শব্দ পেলাম। আমার আম্মা! আমি দ্রুত মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা কাগজগুলো কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখলাম।
'আমাদের আজ টিকা দিয়েছে, সেজন্যে তাড়াতাড়ি বাড়ি এসেছি,' আমি বললাম। 'টাইফয়েড, টাইফাস, টিটেনাস।'
'তোমার ভাই কই?'
'ওদের ক্লাসের টিকা দেয়া এখনও শেষ হয়নি,' আমি বললাম। 'ওরা আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আমি একাই রাস্তা পার হয়েছি।'
'তোমার ডানায় লেগেছে?'
আমি কিছু বললাম না। একটু পরে আমার ভাই এল। তার বাহুতে যন্ত্রণা হচ্ছিল। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল অন্য বাহুর ওপর কাত হয়ে, ঘুমিয়ে পড়লে তাকে খুব করুণ দেখাতে লাগল। যখন সে জাগল তখন বাইরে বেশ অন্ধকার। 'আম্মা, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে,' সে বলল।
'তোমার জ্বর হতে পারে,' আম্মা বললেন, তিনি তখন অন্য ঘরে কাপড় ইস্ত্রি করছিলেন। 'আলী, তোমার ডানাতেও কি যন্ত্রণা হচ্ছে? শুয়ে পড়, শান্ত হয়ে থাক।'
আমরা বিছানায় গিয়ে শান্ত হয়ে থাকলাম। একটু ঘুমিয়ে আমার ভাই জেগে উঠল এবং খেলার পাতা পড়তে লাগল। সে বলল যে আমার জন্যেই গতকাল আমাদের আগেভাগে ম্যাচ ছেড়ে আসতে হয়েছে, আর আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসার কারণে আমাদের টিম চারটা গোল মিস করেছে।
'আমরা চলে না এলেও ওই গোলগুলো মিস হতে পারত,' আমি বললাম।
'কী?'
খানিকক্ষণ তন্দ ায় ঢুলার পর আমার ভাই আমাকে ছটা ফেভজি স্যাকম্যাকস, চারটা আতাতুর্ক এবং তিনটা অন্য কার্ড দিতে চাইল যেগুলো আমার আগে থেকেই আছে, তার বদলে চাইল একটা গ্রেটা গার্বো। আমি প্রত্যাখ্যান করলাম।
'ওপর-অথবা-নীচ খেলা খেলবি?' সে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
'ঠিক আছে, চলো খেলি।'
আপনি আপনার দুই হাতের তালুর মাঝখানে পুরো গাদা চেপে ধরবেন। প্রশ্ন করবেন, 'ওপর না নিচ?' যদি সে বলে নিচ, তাহলে আপনি নিচের ছবিটা দেখবেন, ধরুন সেটার নম্বর ৬৮, রিতা হেইওয়ার্থ। এখন ধরুন, ওপরেরটা ১৮ নম্বর, কবি দান্তের। তাহলে নিচেরটা জয়ী হলো এবং আপনাকে আপনার সবচেয়ে কম পছন্দের বা যেটা আপনার অনেকগুলি আছে সেটার একটা তাকে দিতে হবে। সন্ধ্যায় রাতের খাবারের সময় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ফিল্ড মার্শাল ফেভজি স্যাকম্যাকস আসা-যাওয়া করতে থাকল।
'তোমাদের কেউ একজন ওপরতলায় যাও, একনজর দেখে এস,' আমার আম্মা বললেন। 'তোমাদের আব্বা হয়তো ফিরেছেন।'
আমরা উভয়েই ওপরতলায় গেলাম। আমার চাচা দাদীর সঙ্গে বসে ধূমপান করছেন, আমার আব্বা নেই সেখানে। আমরা রেডিওর খবর শুনলাম, খেলার পাতা পড়লাম। তারপর দাদী যখন খেতে বসলেন তখন আমরা নিচেরতলায় নামলাম।
'কী তোমাদের ধরে রেখেছিল?' আম্মা বললেন। 'সেখানে কিছু খাওনি তো? খেয়েছ নাকি? আমি এখন তোমাদের মসুর ডালের সু্যপ দিচ্ছি, তোমাদের আব্বা যতক্ষণ বাড়ি না ফেরেন ততক্ষণ খুব ধীরে ধীরে খাও।'
'টোস্টেড ব্রেড নেই?' আমার ভাই জিজ্ঞেস করল।
আমরা নীরবে সু্যপ খাওয়ার সময় আম্মা আমাদের লক্ষ্য করছিলেন। যেভাবে তিনি তার মাথা ধরে রেখেছিলেন এবং যেভাবে তার দৃষ্টি আমাদের ওপর থেকে সরে সরে যাচ্ছিল তা দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম তার কান রয়েছে লিফটের দিকে। আমাদের সু্যপ খাওয়া শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'আরো খানিকটা নেবে?' তিনি পাত্রটার দিকে তাকালেন। 'ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার আগে আমারও খেয়ে নেওয়া উচিত,' তিনি বললেন। কিন্তু তার বদলে তিনি জানালার কাছে গেলেন এবং নিচে নিসানতাসি স্কয়ারের দিকে তাকালেন। তিনি সেখানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঘুরলেন, টেবিলের কাছে ফিরে এলেন, এবং তার ভাগের সু্যপ খেতে শুরু করলেন। আমার ভাই আর আমি গতকালের ম্যাচ নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
'চুপ করো তো! এটা লিফটের শব্দ না?'
আমরা শান্ত হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। এটা লিফটের শব্দ না। টেবিল, গস্নাস, কলসি এবং তার ভেতরের পানিকে আলোড়িত করে নিস্তব্ধতা ভাঙল একটা স্ট্রীটকার। কমলা খাওয়ার সময় আমরা নিশ্চিতই লিফটের শব্দ শুনলাম। ক্রমেই সেটা কাছে আসতে লাগল, কিন্তু আমাদের ফ্লোরে দাঁড়াল না, সেটা গেল আমার দাদীর ফ্লোরে। 'ওপরে গেল,' আমার আম্মা বললেন।
খাওয়া শেষ হলে তিনি বললেন, 'তোমাদের পেস্নটগুলো রান্নাঘরে নিয়ে যাও। তোমাদের আব্বার পেস্নটটা যেখানে আছে সেখানেই থাক।' আমরা টেবিল পরিষ্কার করলাম। আব্বার পরিষ্কার পেস্নটটা শূন্য টেবিলের ওপর অনেকক্ষণ একাকী পড়ে থাকল।
আমার আম্মা জানালার কাছে গেলেন, সেখান থেকে নিচের পুলিশ স্টেশনটা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তারপর হঠাৎ মনস্থির করলেন। আমার আব্বার ছুরি, কাঁটা চামচ এবং শূন্য থালা জড় করে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন। 'আমি ওপরতলায় তোমাদের দাদীর ওখানে যাচ্ছি,' তিনি বললেন। 'আমি না থাকার সুযোগে দয়া করে তোমরা যেন লড়াই বাধিয়ো না।'
আমার ভাই এবং আমি আমাদের ওপর অথবা নিচ খেলায় ফিরে গেলাম।
'ওপর,' আমি বললাম, প্রথমবারের মতো।
সে ওপরের কার্ডটা বের করল: ৩৪ নম্বর, কোকা ইউসুফ, বিশ্ববিখ্যাত কুস্তিগীর। সে গাদার নিচের কার্ডটা টেনে বের করল: ৫০ নম্বর, আতাতুর্ক। 'তুই হারলি। আমাকে একটা কার্ড দে।'
আমরা দীর্ঘ সময় খেললাম, সে ক্রমাগত জিততে থাকল। শিগগিরই সে আমার উনিশটা ফেভজি স্যাকম্যাক এবং দুটি আতাতুর্ক জিতে নিল।
'আমি আর খেলছি না,' আমি রেগেমেগে বললাম। 'আমি ওপরতলায় যাচ্ছি। আম্মার কাছে।'
'আম্মা রাগ করবেন।'
'ভীতু! একা ঘরে থাকতে তোমার ভয় লাগবে তো?'
আমাদের দাদীর দরজা রীতি মাফিক খোলাই ছিল। রাতের খাওয়া শেষ। বাকির, বাবুর্চিটা, থালা-বাসন পরিষ্কার করছিল; আমার চাচা আর দাদী মুখোমুখী বসে আছেন। আমার আম্মা জানালায় দাঁড়িয়ে নিসানতাসি স্কয়ারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
'এস,' তিনি বললেন, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই। আমি সোজা খালি জায়গাটার দিকে এগিয়ে গেলাম, সেটা যেন আমার জন্যেই নির্ধারিত করে রাখা ছিল। তার দিকে ঝুঁকে আমিও নিসানতাসি স্কয়ারের দিকে তাকালাম। আম্মা আমার মাথায় তার হাত রাখলেন এবং আমার চুলে মৃদু মৃদু চাপড় দিতে থাকলেন।
'তোমার আব্বা আজ বিকেলে বাড়ি এসেছিলেন, আমি শুনেছি। তুমি তাকে দেখেছ।'
'হঁ্যা।'
'উনি ওনার সু্যটকেস নিয়ে গেছেন। হাজিম আফেন্দি তাকে দেখেছে।'
'হঁ্যা।'
'উনি কোথায় গেছেন সেকথা কি তোমাকে বলেছেন, সোনা আমার?'
'না,' আমি বললাম। 'তিনি আমাকে আড়াই লিরা দিয়েছেন।'
নিচের সড়কে প্রত্যেকটা জিনিস- রাস্তার ধারের অন্ধকার দোকানগুলো, গাড়ির আলো, মাঝখানের ছোট্ট খালি জায়গাটা যেখানে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, ভেজা নুড়িপাথর, গাছে ঝোলানো বিজ্ঞাপন বোর্ডের অক্ষরগুলো- সবকিছু নিঃসঙ্গ এবং বিষণ্ন। বৃষ্টি শুরু হলো, আম্মা আমার চুলের ভেতর ধীরে ধীরে বিলি কাটতে লাগলেন।
সেই সময় দাদী ও চাচার মাঝখানে রাখা রেডিওটা আমার নজরে পড়ল, যে রেডিও সব সময় খোলা থাকে লক্ষ্য করলাম সেটা এখন নীরব। আমার মধ্যে দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল।
'ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থেক না, বাছা,' দাদী বললেন।
আমার ভাইটি ওপরে উঠে এসেছে।
'রান্নাঘরে যাও, তোমরা দুটি,' চাচা বললেন। 'বাকির!' তিনি ডাকলেন। 'ওদের একটা বল বানিয়ে দাও, ওরা বড় ঘরের বারান্দায় ফুটবল খেলুক।'
রান্নাঘরে বাকিরের থালা-বাসন ধোয়ার কাজ শেষ। 'ওখানে বস,' সে বলল। সে কাঁচঘেরা ব্যালকনিতে গেল, আমার দাদী যেটাকে গ্রীনহাউস বানিয়ে রেখেছেন, সেখান থেকে এক গাদা খবরের কাগজ এনে দুমড়ে-মুচড়ে বল বানাতে লাগল। যখন সেটা একমুঠের মত বড় হলো তখন সে জিজ্ঞেস করল, 'এটাতে চলবে না?'
'এর ওপর আরো কিছু কাগজ জড়াও,' আমার ভাই বলল।
বাকির আরো কিছু খবরের কাগজ জড়াতে লাগল, আমি তখন দরজার মধ্যে দিয়ে অপর পাশে আমার আম্মা, দাদী এবং চাচাকে লক্ষ্য করলাম। ড্রয়ার থেকে দড়ি বের করে বলটাকে বেঁধে যতটুকু সম্ভব গোল করার চেষ্টা করল বাকির। এর তীক্ষ্ন ধারগুলোকে নরম করার জন্যে সে একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে সেটাকে হালকা করে মুছে দিল। তারপর সেটাকে আবার চাপল। আমার ভাই সেটাকে স্পর্শ না করে থাকতে পারল না।
'উফ! পাথরের মতো শক্ত যে।'
'এখানে নিচে তোমার আঙ্গুল রাখ।' যেখানে শেষ গিঁটটা বাঁধা হবে সেখানে সাবধানতার সঙ্গে আঙ্গুল রাখল আমার ভাই। বাকির কষে গিঁট বাঁধল এবং বল তৈরী হয়ে গেল। সে সেটাকে বাতাসে ছুঁড়ে দিল এবং আমরা লাথি মেরে খেলতে শুরু করে দিলাম।
'বড় বারান্দায় গিয়ে খেল। এখানে খেললে কিছু-না-কিছু ভাঙ্গবেই।'
অনেকক্ষণ ধরে আমরা আমাদের সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে খেললাম। আমি ফেনারবেস-এ লেফটারের ভাব করতে লাগলাম, তার মতো করে বল ঘোরালাম এবং ঘুরলাম। যখনই আমি দেওয়াল ঘেঁষে পাস দিচ্ছিলাম তখনই আমি ভায়ের বাহুর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম। সে-ও আমাকে আঘাত করছিল, কিন্তু তাতে আমি ব্যথা পাচ্ছিলাম না। আমরা দুজনেই ঘামছিলাম এবং বলটা টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। আমি যখন পাঁচ-তিন গোলে এগিয়েছিলাম তখন আমার ভায়ের বাহুতে জোরে আঘাত করলাম। সে মেঝেতে উল্টে পড়ে কাঁদতে লাগল।
'আমার ডানাটা ভাল হোক তখন দেখিস আমি তোকে শেষ করে ফেলব,' শুয়ে শুয়েই বলল সে।
তার রাগের কারণ সে হেরে গেছে। আমি হলঘর ছেড়ে সিটিংরুমে চলে গেলাম। আমার দাদী, আম্মা, এবং চাচা, সবাই পড়ার ঘরে চলে গেছেন। দাদী ফোন ঘুরাচ্ছিলেন।
'হ্যালো, বাছা,' তিনি বললেন, আমার আম্মার সঙ্গে যেভাবে বলেন সেইভাবে কথা বললেন তিনি। 'এটা কি ইয়াসিলকয় এয়ারপোর্ট? শোনো, বাছা, একজন যাত্রী সম্পর্কে আমরা জানতে চাচ্ছিলাম, সে আজ কিছু আগে ইউরোপ গেছে।' তিনি আমার আব্বার নাম বললেন, অপেক্ষা করার সময় তিনি ফোনের কর্ড আঙ্গুলে পেঁচাচ্ছিলেন। 'আমার সিগারেট দাও তো', চাচাকে বললেন তিনি। চাচা রুম থেকে চলে গেলে তিনি রিসিভারটা কানের কাছ থেকে দূরে সরালেন।
'দয়া করে বলো মা,' দাদী আমার আম্মাকে বললেন। 'তোমার জানার কথা। এর ভেতরে অন্য কোনও মেয়ে আছে কি?'
আমি আম্মার উত্তর শুনতে পেলাম না। দাদী তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন তিনি কোনও কিছু বলেননি। তখন টেলিফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি কিছু বলল, তাতে তিনি রেগে গেলেন। 'ওরা আমাদের বলতে চাচ্ছে না,' তিনি বললেন। তখন চাচা তার সিগারেট ও অ্যাশট্রে নিয়ে উপস্থিত হলেন।
আমার আম্মা দেখলেন চাচা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, কেবল তখনই তিনি লক্ষ্য করলেন যে আমি সেখানে হাজির হয়েছি। আমার ডানা ধরে তিনি আমাকে টানতে টানতে হলঘরে নিয়ে গেলেন। আমার পিঠে এবং ঘাড়ের পেছনে হাত পড়তে তিনি বুঝতে পারলেন আমি কতটা ঘেমেছি, কিন্তু তিনি রাগলেন না।
'আম্মা, আমার ডানায় যন্ত্রণা হচ্ছে,' আমার ভাইটি বলল।
'তোমরা দুজন এখন নিচতলায় যাও, তোমাদের আমি বিছানায় শুইয়ে দেব।'
নিচের তলায় আমাদের ফ্লোরে আমরা তিনজন অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। বিছানায় যাওয়ার আগে পাজামা পরে আমি রান্নাঘরে গেলাম এক গস্নাস পানি পান করার জন্যে, তারপর সিটিংরুমে গেলাম। আম্মা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলেন, প্রথমে তিনি আমার আসার শব্দ টের পাননি।
'খালি পায়ে তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে,' তিনি বললেন। 'তোমার ভাই শুয়েছে?'
'ও ঘুমে কাদা। আম্মু, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।' জানালার ধারে আমার জন্যে আম্মা একটু জায়গা করে দেবেন এই অপেক্ষায় রইলাম। যখন তিনি আমার জন্যে সেই মধুর জায়গা বের করে দিলেন তখন আমি তার পাশ ঘেঁষে তার মধ্যে ঢুকলাম। 'আব্বা প্যারিস গেছেন,' আমি বললাম। 'আর তিনি কোন সু্যটকেসটা নিয়ে গেছেন, জান?'
তিনি কিছু বললেন না। রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিস্নাত রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
।। ৩ ।।
আমার নানীর বাড়ি সিস্লি মসজিদ এবং স্ট্রিটকার লাইন যেখানে শেষ হয়েছে তার পরে। এখন জায়গাটা মিনিবাস এবং পৌর বাস স্টপেজে ভর্তি; এছাড়া রয়েছে উঁচু কদাকার দালান এবং চিহ্ন-আঁকা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর; যে অফিসগুলো রয়েছে তার কর্মীরা দুপুরের খাওয়ার সময় পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে রাস্তায় নেমে আসে, কিন্তু সেকালে এটা ছিল ইউরোপীয় নগরীর তুল্য। নুড়িপাথরের সেই প্রাঙ্গণে পায়ে হেঁটে পেঁৗছতে আমাদের পনর মিনিট সময় লাগল, লেবু এবং তুঁত গাছের নিচ দিয়ে যখন মায়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হাঁটছিলাম তখন আমাদের অনুভব হচ্ছিল আমরা যেন গ্রামের পথে চলেছি।
আমার নানী একটা চারতলা পাথর ও কংক্রিটের তৈরি বাড়িতে বাস করতেন, সেটাকে দেখাত একপাশে উল্টে থাকা দিয়াশলাই বাক্সের মতো। তার পশ্চিমে ইস্তাম্বুল, পেছনে পাহাড়ে তুঁত গাছের বন। তার স্বামীর মৃতু্য এবং তিন মেয়ের বিয়ের পর তিনি একটিমাত্র ঘরে বাস করতে শুরু করেছেন, সেটা ওয়ার্ডরোব, টেবিল, ট্রে, পিয়ানো এবং অন্যান্য সব আসবাবপত্রে ঠাসা। আমার খালা তার জন্যে খাবার রান্না করে নিজেই আনেন অথবা কনটেইনারে প্যাক করে ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়ে দেন। নানী যে শুধু দু'ধাপ নিচে রান্নাঘরে রান্না করতে যাবেন না তা-ই নয়, তিনি এমনকি অন্য সব ঘরেও যেতে চান না। সেসব ঘর পুরু ধুলো এবং রেশমী মাকড়সার জালে ঢাকা পড়ে আছে। আমার নানীর মা-ও জীবনের শেষ বছরগুলি একটা বিশাল কাঠের প্রাসাদে একাকী কাটিয়েছেন, মায়ের মতো তিনিও একটা রহস্যজনক নৈঃসঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি এমনকি একজন কেয়ারটেকার কিংবা দৈনিক ঝাড়-দারকেও বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেন না।
আমরা যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন আমার আম্মা অনেকক্ষণ ধরে বেল টিপেই যেতে থাকলেন এবং লোহার দরজায় করাঘাত করলেন। অবশেষে আমার নানী তৃতীয় তলার মসজিদমুখী লোহার জানালার মরচেপড়া শাটার খুললেন এবং আমাদের দেখার জন্যে উঁকি দিলেন। তিনি তার চোখকে বিশ্বাস করেন না, তিনি বেশি দূরের জিনিস ভাল দেখতে পান না, সে কারণে তার দিকে আমাদের হাত নাড়াতে বললেন।
'বাছারা, তোমরা দরজা থেকে বাইরে বেরিয়ে এস, যেন তোমাদের নানী তোমাদের দেখতে পান,' আমার আম্মা বললেন। আমাদের নিয়ে বাইরে রাস্তার মাঝখানে এসে তিনি হাত নাড়লেন এবং চীৎকার করে বললেন, 'মা গো, আমি, আর আমার ছেলেরা; আমরা, তুমি শুনতে পাচ্ছ?'
তার মিষ্টি হাসি দেখে আমরা বুঝলাম তিনি আমাদের চিনতে পেরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জানালা থেকে সরে ঘরে গেলেন, বালিশের নিচে রাখা বিশাল চাবিটা বের করলেন এবং সেটা খবরের কাগজে জড়িয়ে নিচে ছুঁড়ে দিলেন। আমার ভাই আর আমি সেটা ধরার জন্যে ছুটলাম এবং ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলাম।
আমার ভাইয়ের বাহুতে তখনও ব্যথা ছিল, সেটা তাকে শস্নথ করে দিল। সে কারণে চাবিটা আমিই প্রথম ধরলাম এবং আম্মার হাতে দিলাম।
একটু পরিশ্রম হলো কিন্তু আম্মা বিশাল লোহার দরজাটার তালা খুলতে সক্ষম হলেন। আমাদের তিনজনের ঠেলাঠেলিতে দরজাটা আস্তে আস্তে সরে গেল, এবং অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল সেই গন্ধ যা আমি সারা জীবনে আর কখনও পাইনি: সেটা ধ্বংস, ছাতলা ময়লা, ধুলা, বার্ধক্য এবং বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। দরজার পরে ডানপাশে একটা কোট-র্যাক- সেটা রাখা হয়েছে প্রায়-আসা চোরদের বোঝাতে যে বাড়িতে একজন পুরুষ মানুষ আছে- আমার নানী তাতে ঝুলিয়ে রেখেছেন নানার ফেল্ট-হ্যাট এবং পশুর লোমের কলারওয়ালা কোট, এক কোণে রাখা আছে বুটজোড়া যা আমার মধ্যে খুব ভয় জাগায়।
একটু পরে, কাঠের সিঁড়ির খাড়া দুটো ধাপির প্রান্তে, দূরে, অনেকটা দূরে, শাদা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের নানীকে দেখা গেল। তাকে দেখাচ্ছিল একটা ভূতের মতো, লাঠি ধরে প্রকৃত অর্থেই অনড় দাঁড়িয়ে আছেন, জীর্ণ আর্ট ডেকো দরজার মধ্যে দিয়ে তার ওপর আলো এসে পড়ছিল।
ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আমার আম্মা নানীকে কিছু বললেন না। (কখনও কখনও তিনি বলতেন, 'কেমন আছ, প্রিয় মা?' কিংবা 'মা গো, তোমার জন্যে খুব মন পোড়ে; আজ এত ঠাণ্ডা, মা!') সিঁড়ির মাথায় উঠে আমি নানীর হাতে চুমু খেলাম, কিন্তু তার মুখ, কিংবা কব্জির বিশাল আঁচিলের দিকে তাকালাম না। তবুও আমরা ভয় পেলাম তার মুখের একমাত্র দাঁত, লম্বা চিবুক এবং মুখের দাড়ি দেখে। তাই ঘরে ঢুকেই আমরা আম্মার পেছনে লুকনোর জন্যে ঠেলাঠেলি করলাম। নানী তার বিছানায় ফিরে গেলেন, যেখানে তিনি তার লম্বা নাইটগাউন আর উলের ফতুয়া পরে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন, যেন বলতে চান, বেশ, এবার আমাকে আনন্দ দাও।
'তোমার স্টোভ তো ভাল কাজ করছে না, মা,' আম্মা বললেন। তিনি আগুন উসকানোর নাড়-নি দিয়ে কয়লা নেড়ে দিলেন।
নানী একটুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, 'স্টোভ রেখে এস, আমাকে খবর শোনাও। কী হচ্ছে পৃথিবীতে?'
'কিচ্ছু না,' আমাদের পাশে বসে বললেন তিনি।
'আমাকে বলার মতো কিছুই নেই তোমার?'
'কিছুই নেই, মা জননী আমার।'
একটু নিরবতার পর নানী জিজ্ঞেস করলেন, 'কারো সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?'
'তুমি তো সেটা আগে থেকেই জান, মা।'
'খোদার দোহাই, বলো, তোমার কাছে কোনও খবরই নেই?'
নিরবতা ব্যাপ্ত হয়ে থাকল।
'নানী, স্কুলে আমাদের টিকা দেয়া হয়েছে,' আমি বললাম।
'তাই নাকি?' নানী বললেন তার নীল চোখ বড় বড় করে, যেন তিনি অবাক হয়েছেন। 'লাগেনি?'
'আমার ডানায় এখনও ব্যথা আছে,' আমার ভাই বলল।
'ওহ, প্রিয়,' হেসে বললেন নানী।
তারপর আবার দীর্ঘ নিরবতা। আমার ভাই এবং আমি উঠলাম এবং জানালা দিয়ে বাইরে দূরের পাহাড়, তুঁত গাছ এবং পেছনের বাগানে মুরগির পুরনো খাঁচা দেখতে লাগলাম।
'আমার জন্যে কোনও খবরই নেই তোমার কাছে?' নানী পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। 'তুমি ওপরে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে যাও। আর কেউ আসে না?'
'গতকাল বিকেলে দিলরুবা হানিম এসেছিলেন,' আমার আম্মা বললেন। 'তারা তাস খেলেছিলেন।'
আমরা যেটা আশা করেছিলাম সেভাবেই নানী উৎফুলস্ন কণ্ঠে বললেন, 'সেই প্রাসাদের মহিলা!'
আমরা জানি রূপকথা এবং সে সময়কার খবরের কাগজে যেসব ঘিয়ে রঙের প্রাসাদের কথা আমরা পড়তাম নানী তার কথা বলছেন না, তিনি দলমাবাসে প্রাসাদের কথা বলছেন। আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছি যে আমার নানী দিলরুবা হানিমকে ঘৃণা করতেন, কারণ তিনি এসেছেন শেষ সুলতানের হারেম থেকে এবং একজন ব্যবসায়ীকে বিয়ে করার আগে তিনি উপপত্নী ছিলেন। আর এই মহিলার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার কারণে তিনি আমার দাদীকেও ঘৃণা করতেন। তারপর তারা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন যা তারা নিয়মিত করেন আমার আম্মা বেড়াতে এলেই। সপ্তাহে একবার আমার নানী বিয়োগ্লুতে আপতুলস্নাহ আফেন্দি নামক এক নামকরা দামী রেস্টুরেন্টে একাকী দুপুরের খাবার খেতে যান, এবং খাওয়ার পর যা কিছু খেয়েছেন তার সম্পর্কে লম্বা অভিযোগ পেশ করেন। তিনি তৃতীয় যে রেডিমেড বিষয়ের অবতারণা করেন সেটা হলো একটা প্রশ্ন: 'তোমাদের দাদী কি তোমাদের পার্সলি শাক রেঁধে খাইয়েছে?'
আমরা একবাক্যে বলি, যা আমাদের আম্মা বলতে শিখিয়ে দিয়েছেন, 'না, নানী, তিনি খাওয়াননি।'
সব সময় যেমনটা করেন, নানী আমাদের সেই গল্পটা শোনান, যে, কীভাবে তিনি একবার এক বাগানে পার্সলি শাকের ওপর বিড়ালকে প্রস্রাব করতে দেখেছেন, কীভাবে সেই পার্সলি শাক অ-ধোয়া হয়ে কিছু বোকা লোকের খাদ্যের মধ্যে গিয়ে পেঁৗছে, এবং কীভাবে তিনি এটা নিয়ে সিস্লি এবং নিসানতাসির সবজিবিক্রেতাদের সঙ্গে এখনও ঝগড়া করে চলেছেন।
'প্রিয় মা,' আমার আম্মা বললেন, 'বাচ্চাদের একঘেয়ে লাগছে, ওরা অন্য সব ঘরগুলো ঘুরে দেখতে চায়। আমি সামনের দরজার ঘরটা খুলে দিচ্ছি।'
আমার নানী বাড়ির সবগুলো ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখেন, যেন কোনও চোর জানালা দিয়ে ঢুকলেও বাড়ির অন্য কোনও ঘরে যেতে না পারে। আম্মা বিশাল ঠাণ্ডা ঘরটা খুললেন, সেটার মুখ রাস্তার স্ট্রিটকার লাইনের দিকে। সেখানে আমাদের নিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ালেন তিনি, দৃষ্টির সামনে ধূলোর চাদরে ঢাকা হাতলওয়ালা চেয়ার ও ডিভান, মরচে-ধরা ধূলোময় বাতি, ট্রে এবং চেয়ার, পুরনো খবরের কাগজের বাণ্ডিল, ছেঁড়া দোলনা, এবং কোণে পড়ে থাকা মেয়েদের বাইসাইকেলের মুখ-থুবড়ে পড়া হ্যান্ডেল-দণ্ড। তবে তিনি ট্রাঙ্ক খুলে আমাদের কিছু দেখালেন না, অন্য সব আনন্দময় দিনে যেটা করতেন। ('তোমাদের আম্মা ছোটবেলায় এইসব স্যান্ডেল পরত, বুঝছ বাছারা। এই দেখ- তোমাদের খালার স্কুল ইউনিফর্ম, বাছারা। তোমরা তোমাদের মায়ের ছেলেবেলার টাকার ব্যাংক দেখতে চাও, বাছারা?')
'তোমাদের ঠাণ্ডা লাগলে আমাকে বোলো,' বলে তিনি চলে গেলেন।
আমার ভাই এবং আমি দৌড়ে জানালার কাছে গেলাম সামনের প্রাঙ্গণের মসজিদ এবং স্ট্রিটকার দেখার জন্যে। তারপর আমরা পুরনো খবরের কাগজে ফুটবল ম্যাচের খবর পড়লাম। 'আমার বিরক্ত লাগছে,' আমি বললাম। 'ওপর-অথবা-নিচ খেলা খেলি।'
'পরাজিত কুস্তিগীর এখনও লড়তে চায় দেখছি,' আমার ভাই বলল, খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলে। 'আমি পেপার পড়ছি।'
আমরা সেদিন সকালে আবার খেলেছিলাম, এবং আবার আমার ভাই জিতেছিল।
'পিস্নজ।'
'আমার একটা শর্ত আছে: যদি আমি জিতি তাহলে তুই আমাকে দু'টো ছবি দিবি, আর যদি তুই জিতিস তাহলে আমি তোকে একটা ছবি দিব।'
'না, একটা।'
'তাহলে আমি খেলছি না,' আমার ভাই বলল। 'দেখছিস তো আমি খবরের কাগজ পড়ছি।'
সমপ্রতি অ্যাঞ্জেল থিয়েটারে আমরা যে শাদা-কালো ফিল্ম দেখেছি তার ইংরেজ গোয়েন্দার মতো সে কাগজটা ধরে আছে। কিছুক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে আমি আমার ভায়ের শর্তে রাজি হলাম। আমরা পকেট থেকে ফেমাস পিপল সিরিজের কার্ডগুলো বের করে খেলতে শুরু করলাম। প্রথমে আমি জিতলাম, কিন্তু তারপরে আমি আরো সতরটা কার্ড হারলাম।
'এইভাবে খেললে আমি সব সময় হারি,' আমি বললাম। 'পুরনো নিয়মে ফিরে না গেলে আমি আর খেলছি না।'
'ঠিক আছে,' আমার ভাই বলল, গোয়েন্দাটির অনুকরণ করে। 'আমি ওইসব খবরের কাগজগুলো পড়তে চাই।'
আমি কিছুক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। আমি সতর্কতার সঙ্গে আমার ছবিগুলো গুণলাম: আর ১২১টা অবশিষ্ট আছে। একদিন আগে, যখন আমার আব্বা চলে যান, সেদিনও ছিল ১৮৩টা! কিন্তু সেজন্যে আমি উদ্বিগ্ন হলাম না। আমি আমার ভায়ের শর্তে রাজি হলাম।
শুরুতে আমি জিতছিলাম, কিন্তু পরে আবার সে জিততে লাগল। আনন্দ লুকাতে সে আমার কার্ড নেয়ার সময় হাসছে না, সেগুলি তার প্যাকে ভরে নিচ্ছে।
'তুই চাস তো আমরা অন্য নিয়মেও খেলতে পারি,' একটু পরে বলল সে। 'যেই জিতুক সে একটা কার্ড পাবে। যদি আমি জিতি তাহলে তোর কোন কার্ডটা নিব সেটা আমি পছন্দ করব। কারণ সেগুলোর কোনও কোনওটা আমার নেই, আর সেগুলো তুই আমাকে কখনও দিবি না।'
আমি জিততেও পারি ভেবে রাজি হলাম। আমি জানি না কীভাবে এটা ঘটল। একাধারে তিনবার হারলাম, আমি টের পাওয়ার আগেই আমার দু'টি গ্রেটা গার্বোই (২১) এবং একমাত্র রাজা ফারুক (৭৮) হারালাম। আমি সেগুলো সব একবারে ফিরে পেতে চাইলাম, সুতরাং খেলা বড় হয়ে উঠল। এভাবেই আমার বড় বড় কার্ডগুলো, যা তার নেই- আইনস্টাইন (৬৩), রুমি (৩), ম্যাম্বো চুয়িংগাম-ক্যানডিড ফ্রুট কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সার্কিস নাজারিয়ান (১০০), এবং ক্লিওপেট্রা (৫১), মাত্র দু' রাউন্ডেই তার হাতে চলে গেল।
আমি এমনকি ঢোক গিলতেও পারছিলাম না। কেঁদে ফেলব এই ভয়ে আমি জানালার কাছে দৌড়ে গেলাম এবং বাইরে তাকালাম- মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই সব কিছু কেমন সুন্দর দেখাচ্ছিল- স্ট্রিটকারগুলো টারমিনাসের দিকে যাচ্ছে, পাতাঝরা ডালপালার মধ্যে দিয়ে দূরে অ্যাপার্টমেন্ট দালানগুলো দৃশ্যমান, নুড়িপাথরের ওপর শুয়ে কুকুরটা অলসভাবে গা চুলকাচ্ছে! কেবল যদি সময় থেমে যেত। হর্স রেস ডাইস খেলার সময় আমরা যা করি সেইভাবে যদি স্রেফ পাঁচটা ঘর পিছিয়ে যেতে পারতাম! আমার ভায়ের সঙ্গে আর কখনো আমি ওপর-অথবা-নীচ খেলা খেলব না।
'চলো, আমরা আবার খেলি,' আমি বললাম, জানালার কাঁচ থেকে আমার কপাল না সরিয়ে।
'আমি খেলছি না,' আমার ভাই বলল। 'তুই শুধু কাঁদবি।'
'সিভাত, আমি ওয়াদা করছি, আমি কাঁদব না,' তার দিকে যেতে যেতে আমি চাপ দিলাম। 'কিন্তু শুরুতে আমরা যেভাবে খেলেছিলাম সেই পুরনো নিয়মে খেলতে হবে।'
'আমি পত্রিকা পড়ব।'
'ঠিক আছে,' আমি বললাম। আমি আমার পাতলা গাদার তাস গোছাতে লাগলাম। 'পুরনো নিয়মে। ওপর-অথবা-নীচ।'
'নো কান্নাকাটি,' সে বলল। 'ঠিক আছে, ওপরেরটা।'
আমি জিতলাম এবং সে আমাকে তার একটা ফিল্ড মার্শাল ফেভজি স্যাকম্যাক দিল। আমি সেটা নিলাম না। 'পিস্নজ, আমাকে আটাত্তর নম্বরের রাজা ফারুকটা দাও।'
'না,' সে বলল। 'এ রকম কথা হয়নি আমাদের মধ্যে।'
আমরা আরো দুই রাউন্ড খেললাম, এবং আমি হারলাম। যদি তৃতীয় রাউন্ডটা না খেলতাম! আমার ৪৯ নম্বর নেপোলিয়ন দিতে গিয়ে আমার হাত কাঁপতে লাগল।
'আর খেলব না,' আমার ভাই বলল।
আমি পীড়াপীড়ি করলাম। আরো দুই রাউন্ড খেললাম আমরা, সে যেসব ছবি চাইল তা দেয়ার পরিবর্তে আমি আমার অবশিষ্ট কার্ডগুলো তার মাথায় এবং বাতাসে ছুঁড়ে দিলাম। এসব কার্ড আমি আড়াই মাস ধরে সংগ্রহ করেছি, এদের প্রত্যেকের সম্পর্কে প্রত্যেক দিন ভেবেছি, এবং তটস্থ হয়ে সযত্নে জমা করে রেখেছি_ নম্বর ২৮ মাঈ ওয়েস্ট, নম্বর ৮২ জুলভার্ন, নম্বর ৭ দিগ্বিজয়ী মোহাম্মদ, নম্বর ৭০ রাণী এলিজাবেথ, নম্বর ৪১ কলামিস্ট সেলাল সালিক, এবং নম্বর ৪২ ভলতেয়ার_ বাতাসে ভাসতে ভাসতে গোটা মেঝেময় ছড়িয়ে পড়ল।
আমি যেন সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়, সম্পূর্ণ অন্য জীবনে রয়েছি। নানীর ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে আমি কঁ্যাচকুচ সিঁড়ি বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে শান্তভাবে নামলাম। তখন একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কথা আমার মনে পড়ল, তিনি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করতেন, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। আমার আব্বার আম্মা আমাকে বলেছিলেন আত্মহত্যকারীদের আবাস হবে মাটির নীচে অন্ধকার জায়গায়, এবং কখনও বেহেস্তে যেতে পারবে না। সিঁড়ির বেশ খানিকটা নেমে আমি অন্ধকারে দাঁড়ানোর জন্য থামলাম। আমি ঘুরে ওপরে গেলাম এবং আমার নানীর ঘরের আগের শেষ ধাপিতে বসলাম।
'আমি তোমার শাশুড়ির মতো সম্পদশালী নই,' আমি আমার নানীকে বলতে শুনলাম। 'তুমি তোমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করো এবং অপেক্ষা করো।'
'কিন্তু মা, সোনা আমার, আমি ভিক্ষা চাইছি। আমি বাচ্চাদের নিয়ে এখানে ফিরে আসতে চাই,' আমার আম্মা বললেন।
'দুটো বাচ্চা নিয়ে তুমি এখানে বাস করতে পারবে না, এইসব ধূলো, ভূত আর চোরের মধ্যে,' নানী বললেন।
'প্রিয় মা,' আমার আম্মা বললেন, 'তোমার কি স্মরণ হয় না কী সুখে আমরা এখানে বাস করেছি? স্রেফ আমরা দুইজন? আমার বোনদের বিয়ে এবং আব্বার মৃতু্যর পর?'
'আমার প্রিয় মাবরুরা, তুমি সারাদিন যা করতে তাহলো তোমার পিতার ইলাস্ট্রেশন-এর মতো পুরনো বিষয় নিয়ে কাসুন্দি ঘাটা।'
'নীচতলায় আমি বড় স্টোভ জ্বালালে এই বাড়িটা দুদিনের মধ্যে আরামদায়ক ও গরম হয়ে উঠবে।'
'ওকে বিয়ে করতে আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম। করিনি?' আমার নানী বললেন।
'আমি যদি একটা চাকরানি আনি তাহলে এই ধূলো থেকে মুক্ত হতে মাত্র দুদিন সময় লাগবে,' আম্মা বললেন।
'আমি ওইসব চোর মেয়েদের বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারি না,' আমার নানী বললেন। 'যাই হোক, এইসব ধুলো ও মাকড়সার জাল সরাতে ছ' মাস লাগবে। ততদিনে তোমার বিপথগামী স্বামী আবার বাড়ি ফিরে আসবে।'
'এটাই তোমার শেষ কথা, প্রিয় মা?' আম্মা জিজ্ঞেস করলেন।
'মাবরুরা, প্রিয় বাছা আমার, তুমি যদি দুটো বাচ্চা নিয়ে এখানে বাস করতে আস তাহলে আমরা কী খেয়ে বাঁচব? আমরা চারজন?'
'প্রিয় মা, আমি কতবার তোমাকে বলেছি, পীড়াপীড়ি করেছি, বাবেক-এর ওই জমিগুলো বেহাত হওয়ার আগেই বেচে দাও।'
'আমার ছবি আর স্বাক্ষর দেয়ার জন্যে আমি ওই নোংরা দলিল অফিসে যেতে চাই না।'
'প্রিয় মা, পিস্নজ, একথা বোলো না। আমি আর বড় আপা মিলে একজন নোটারিকে ডেকে আনব তোমার কাছে,' আম্মা একটু কণ্ঠ চড়িয়ে বললেন।
'আমি ওই নোটারিকে কক্ষনো বিশ্বাস করি না,' আমার নানী বললেন। 'তুমি তার মুখ দেখেই বুঝতে পারবে সে একজন জোচ্চোর। এমনকি এমনও হতে পারে যে সে নোটারিই নয়। আর আমার সামনে ও রকম চেঁচিয়ে কথা বোলো না।'
'ঠিক আছে, তাহলে, প্রিয় মা আমার, আমি আর কিছু বলছি না!' আমার আম্মা বললেন। তিনি আমাদের ঘরে ডাকলেন। 'ছেলেরা, এই ছেলেরা, এখনি আয় বাবা, তোদের জিনিশপত্র গুছিয়ে নে, আমরা চলে যাব।'
'অত তাড়াহুড়ো করছ কেন!' আমার নানী বললেন। 'আমাদের এখনও দুটো কথাও হলো না।'
'তুমি আমাদের চাও না, মা,' আমার আম্মা ফিসফিস করে বললেন।
'এটা নাও, বাচ্চাদের কিছু টার্কিশ আনন্দ দাও।'
'লাঞ্চের আগে ওদের এটা খাওয়া উচিত হবে না,' বললেন আমার আম্মা, এবং ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে পেছনে ফেলে বিপরীত দিকের ঘরে ঢুকলেন। 'মেঝে জুড়ে এসব ছবি ছড়িয়ে রেখেছে কে? এক্ষণি তুলে নাও সব। তুমি সাহায্য করো,' আমার ভাইকে বললেন আম্মা।
আমরা যখন ছবিগুলো জড় করছিলাম আমার আম্মা তখন পুরনো ট্রাঙ্কের ঢাকনা তুলে তার শৈশবের পোশাক, ব্যালে নাচের কসটিউম এবং বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। পা-চালিত সেলাই মেশিনের কালো কঙ্কালের নীচের ধুলোয় আমার নাসারন্ধ্র ভর্তি হয়ে গেল, অশ্রুতে চোখ-নাক একাকার অবস্থা। ছোট্ট স্নানাগারে আমরা যখন হাত ধুতে লাগলাম, তখন আমার নানী মৃদু স্বরে বললেন, 'প্রিয় মাবরুরা, এই টি-পটটা তুমি নাও, তুমি এটা খুব পছন্দ কর, তোমার অধিকার আছেঃ,' নানী বললেন। 'আমার নানা যখন দামেস্কের গভর্নর ছিলেন তখন তিনি এটা আমার প্রিয় মায়ের জন্যে এনেছিলেন। এটা চীন থেকে আসা। পিস্নজ এটা নাও।'
'প্রিয় মা, এখন থেকে তোমার কাছ থেকে আমি আর কিছুই নিতে চাই না,' আমার আম্মা বললেন। 'এটা তোমার কাপবোর্ডে তুলে রাখ, তা নাহলে ভেঙ্গে যেতে পারে। চলো, ছেলেরা, তোমার নানীর হাতে চুমু খেয়ে নাও।'
'আমার ছোট্ট মাবরুরা, সোনার মেয়ে আমার, দয়া করে তুমি তোমার অসহায় মায়ের ওপর রাগ কোরো না,' আমার নানী বললেন, আমাদের তার হাতে চুমু খেতে দিয়ে। 'পিস্নজ, আমাকে এখানে এমনভাবে ফেলে যেও না যে, আমাকে কেউ দেখতে আসবে না।'
আমরা প্রতিযোগিতা করে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগলাম, আমরা যখন ভারি ধাতব দরজা ঠেলে খুললাম তখন উজ্জ্বল সূর্যালোক আমাদের অভিনন্দন জানাল, আমরা মুক্ত বাতাসে শ্বাস টানলাম।
'পেছনে দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করো!' আমার নানী চেঁচিয়ে বললেন। 'মাবরুরা, এই সপ্তাহে আবার আমাকে দেখতে এস, আসবে তো?'
আমরা হাত ধরাধরি করে আম্মার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম, কারো মুখে কথা নেই। নীরবতার মধ্যে আমরা স্ট্রিটকারের জন্যে অপেক্ষমাণ অন্য সব লোকের কাশি শুনতে পেলাম। যখন আমরা সত্যিকার অর্থেই চলতে শুরু করলাম তখন আমার ভাই আর আমি বললাম, আমরা কন্ডাক্টরকে পর্যবেক্ষণ করতে চাই, সেজন্যে পেছনের সারিতে গেলাম। আমরা ওপর অথবা নীচ খেলা শুরু করলাম। প্রথমে আমি কিছু কার্ড হারলাম, এবং তারপর কয়েকটা জিতলাম। আমি দানের দর বাড়ালাম, এতে সে সানন্দে সম্মতি দিল, আমি আবার দ্রুত হারতে লাগলাম। আমরা যখন ওসমানবে চূড়ায় পেঁৗছলাম, তখন আমার ভাই বলল, 'তোর কাছে যেসব ছবি অবশিষ্ট আছে তার বদলে এই রইল পনরটা, যত ইচ্ছা নিতে পারিস।'
আমি খেললাম এবং হারলাম। কার্ডগুলো আমার ভায়ের কাছে হস্তান্তরের সময় তার অলক্ষ্যে দুটো কার্ড সরিয়ে রাখলাম। আমি পেছনের সারিতে মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। আমি কাঁদছিলাম না। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলাম, স্ট্রীটকারটা গোঙাতে গোঙাতে ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছিল, আমি সরে যেতে দেখছিলাম সেইসব মানুষজন এবং জায়গাগুলোকে যা চিরকালের জন্যে চলে গেছে- ছোট্ট সেলাইয়ের দোকান, বেকারি, সামিয়ানা টাঙানো পুডিং-এর দোকান, ট্যান সিনেমা হল যেখানে আমরা প্রাচীন রোম সম্পর্কিত ছবিগুলো দেখেছিলাম, পুরনো কমিকস বিক্রেতার সামনে ছেলেমেয়েদের ভিড়, ধারালো কাঁচি হাতে নাপিত যাকে আমার খুব ভয় লাগে, এবং অর্ধ-উলঙ্গ প্রতিবেশি পাগল লোকটি, যে সবসময় নাপিতের দোকানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমরা হারবিয়ে-তে নামলাম। বাড়ির দিকে হেঁটে চলার পথে আমার ভায়ের তৃপ্তিকর নীরবতা আমাকে পাগল করে তুলছিল। আমি পকেটে লুকিয়ে রাখা লিন্ডবার্গটা বের করলাম।
এই প্রথম এটা দেখল সে। 'একানব্বই: লিন্ডবার্গ!' সে সপ্রশংস কণ্ঠে পড়ল। 'পেস্ননে চড়ে সে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে! এটা কোথায় পেলি?'
'গতকাল ওরা আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়নি,' আমি বললাম। 'আমি আগেভাগে বাড়ি গিয়েছিলাম, আব্বা চলে যাওয়ার আগে আমি তাকে দেখেছি। আব্বু আমাকে এটা কিনে দিয়েছেন।'
'তাহলে এর অর্ধেক আমার,' সে বলল। 'বাস্তবে, আমরা যখন শেষ দান খেলি তখন কথা ছিল তোর কাছে যে কটা ছবি অবশিষ্ট রয়েছে তার সব কটা আমাকে দিবি।' সে আমার হাত থেকে ছবিটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সে আমার কব্জি ধরল, এবং এমন জোরে মোচড় দিল যে আমি তাকে পা দিয়ে লাথি কষলাম। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে লাগলাম।
'থাম!' আমার আম্মা বললেন। 'থাম! আমরা এখন রাস্তার মাঝখানে!'
আমরা ক্ষান্ত দিলাম। একজন সু্যটপরা লোক ও একজন হ্যাটপরা মহিলা আমাদের পেরিয়ে গেল। রাস্তায় মারামারি করার জন্যে আমি লজ্জা পেলাম। আমার ভাই দুই ধাপ এগিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। 'খুব লেগেছে,' সে পা চেপে ধরে বলল।
'দাঁড়াও,' আম্মা চাপা কণ্ঠে বললেন। 'এখন এস, দাঁড়াও। সবাই এদিকে তাকিয়ে আছে।'
আমার ভাই দাঁড়াল এবং ফিল্মের আহত সৈনিকের মতো রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল। সে সত্যিকারের আঘাত পেয়েছে ভেবে আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম, তারপরেও তাকে এই অবস্থায় দেখে আমার খুশি লাগছিল। নীরবে খানিকক্ষণ হাঁটার পর সে বলল, 'বাড়িতে আগে পেঁৗছি তারপর দ্যাখ্ কী হয়। আম্মা, আলী গতকাল ইঞ্জেকশন নেয়নি।'
'আমিও নিয়েছি আম্মুু।'
'চুপ করো!' আম্মা চেঁচিয়ে বললেন।
আমরা এখন আমাদের বাড়ির এপাশে। রাস্তা পার হওয়ার আগে আমরা ম্যাসকা থেকে আসা একটা স্ট্রীটকার পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলাম। এরপর এল একটা ট্রাক, ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলি ছড়িয়ে একটা হড়বড়ে বেসিকটাস বাস এল, এবং বিপরীত দিক থেকে এল একটা হালকা বেগুনি রঙের দ্য সোতো। সেই সময় আমার নজরে পড়ল আমার চাচা জানালা দিয়ে নীচে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আমাকে দেখতে পাননি, তিনি তাকিয়েছিলেন ধাবমান গাড়িগুলোর দিকে। অনেকক্ষণ ধরে আমি তাকে দেখলাম।
রাস্তা ফাঁকা হতে অনেক সময় লাগল। আমার আম্মা এখনও কেন আমাদের হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে যাচ্ছেন না অবাক হয়ে সে কথা ভেবে আমি তার দিকে ঘুরলাম, এবং দেখলাম তিনি নীরবে কাঁদছেন।
=======================
স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান  আলোচনা- 'বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা' by বেলাল চৌধুরী  আলোচনা- 'শিল্প সৃষ্টি ও নান্দনিকতা' by আহমদ রফিক  আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল by মুহম্মদ সবুর  বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ  নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী  গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক  গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু  গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার  গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ  গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট  গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস  গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান  কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন 


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ  অরহ্যান পামুক
অনুবাদঃ নাজিব ওয়াদুদ


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.