উইকেটে কী আসে যায়

ব্যাটিংয়ের মতো কথাবার্তায়ও বরাবরই সোজাসাপ্টা বীরেন্দর শেবাগ। নিজে যেটা মনে করেন, সেটাই বলে ফেলেন। ডাম্বুলায় পরশু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর সেঞ্চুরিটি না হলে দলের কী অবস্থা হতো? শেবাগের উত্তর, ‘আগামীকালই আমাদের দেশের ফ্লাইট ধরতে হতো।’ অন্যরা রান পাচ্ছে না বলে কি বেশি দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন? ‘যেহেতু আমি ফর্মে আছি, ভাবলাম আমারই বেশি রান করা উচিত। আমি যদি বেশি স্ট্রাইক নিয়ে খেলি, তাহলে অন্যদের আউট হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়!’
পরিকল্পনায় কতটা সফল শেবাগ, সেটা তো সবাই দেখেছেন। ভারতের ২২৩ রানের ১১০-ই এসেছে সেদিন শেবাগের ব্যাট থেকে। নিউজিল্যান্ড করেছিল ১১৮, শেবাগের ইনিংসটি বাদ দিলে ভারতকে টপকেই যায় নিউজিল্যান্ড। কিন্তু ওই ব্যবধানটা গড়ে দেওয়ার জন্যই তো আছেন শেবাগ। ‘একাই দলকে জিতিয়েছেন’—কতজনের সম্পর্কেই তো কতবার বলা হয়েছে। এই টুর্নামেন্টের শেবাগের ক্ষেত্রে এটা শতভাগ সত্যি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি পর্যন্ত ভারতের ফাইনাল খেলার আশা বেঁচে ছিল শেবাগের জন্যই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৯৯ করে জিতিয়েছেন দলকে। দুই ম্যাচে শেবাগের ব্যাটে রান নেই, ভারতের জয় নেই। ‘অঘোষিত সেমিফাইনালে’ আবার শেবাগের ব্যাটে রান, জিতে ফাইনালে উঠল ভারত।
সতীর্থদের তো অবশ্যই, পুরো টুর্নামেন্টেই অন্যসব ব্যাটসম্যানকে বিব্রতকর অবস্থা ফেলে দিয়েছেন শেবাগ। মহেন্দ্র সিং ধোনি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘বল এত বেশি মুভ করলে খেলা কঠিন।’ নিউজিল্যান্ডের সিমিং উইকেটে খেলে বড় হওয়া রস টেলরের কাছেও ডাম্বুলার উইকেটকে মনে হচ্ছে দুর্বোধ্য। মুখ ফুটে যারা কিছু বলছে না, তাদের হয়ে কথা বলছে পারফরম্যান্স। অথচ এই উইকেটেই শেবাগকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যাটিংয়ের চেয়ে সহজ কাজ আর নেই। টুর্নামেন্টে শেবাগের রান ২৪০, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিলকরত্নে দিলশানের রান ১২৯। ভারতে শেবাগের পরে সর্বোচ্চ ধোনির ৭৩, পুরো টুর্নামেন্ট মিলেই ৫০ করতে পারেননি আর কেউ!
এবারই অবশ্য প্রথম নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক যুগ কাটিয়ে দেওয়ার পরও বিশুদ্ধবাদীরা প্রায়ই যাঁর ব্যাটিংয়ে নানা ফাঁক খুঁজে পান, সেই শেবাগ কিন্তু বরাবরই কঠিন উইকেটে দারুণ সফল। ২০০২-০৩ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সেই সিরিজটার কথা কে ভুলতে পারে? যে সিরিজ থেকে ০.৬৬ গড় নিয়ে ফিরেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলীর গড় ছিল ৮.২৮, লক্ষ্মণের ১৩.০০, সেই সিরিজেই অসাধারণ দুটি সেঞ্চুরি করেছিলেন শেবাগ। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে তাঁর সর্বোচ্চ গড় সুইং বোলারদের স্বর্গ নিউজিল্যান্ডেই, ৫৪.৩৬!
নিউজিল্যান্ডকে পেলেই অবশ্য চওড়া হয়ে যায় তাঁর ব্যাট। ২০০১ সালে কিউইদের বিপক্ষেই ৬৯ বলে সেঞ্চুরি করে বিশ্ব ক্রিকেটকে আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন, ২০০২-০৩ সিরিজের ওই সেঞ্চুরি দুটি তো আছেই, গত বছরই হ্যামিল্টনে করেছেন ৭৪ বলে অপরাজিত ১২৫। সব মিলিয়ে তাঁর ১৩ ওয়ানডে সেঞ্চুরির ৬টিই কিউইদের বিপক্ষে। শেবাগের সেঞ্চুরি মানেই প্রতিপক্ষের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৩ সেঞ্চুরির ১২টিতেই জিতেছে ভারত।
৯৩ বলে ১১০—পরশুর ইনিংসটাও ‘শেবাগীয় ইনিংস’। তবে শুরুতে ছিলেন বেশ সাবধানী। কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন, ‘এদিন উইকেটের আচরণ অন্যদিনগুলোর চেয়ে একটু ভালো ছিল। বুঝতে পারছিলাম প্রথম কয়েকটা ওভার সতর্কভাবে পার করে দিতে পারলেই উইকেট ব্যাটিং উপযোগী হয়ে যাবে। এ জন্যই শুরুতে একটু ধরে খেলে পরে শট খেলা শুরু করেছি। জানতাম, শট খেলা শুরু করলেই বোলাররা আলগা বল করতে শুরু করবে।’
ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও নিশ্চয়ই এমন খেলতে চাইবেন শেবাগ। দলের জয়, শিরোপা এসবের সঙ্গে সেই ‘অপরাজিত ৯৯’-এর হিসাব চুকানোর ব্যাপারটাও তো আছে!

No comments

Powered by Blogger.