পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ ‘মা’ by শিখ্তী সানী

সকালে ঘুম ভাঙে আম্মুর ডাকে। তার পর থেকে দৌড়। এত বড় হয়েছি, তবু খাওয়া নিয়ে পেছন পেছন ছুটতে থাকেন আম্মু। এরই মধ্যে এ কাগজ খুঁজে পাই না, সে কাগজ খুঁজে পাই না। হাতের কাছে জিনিস রেখেও ‘আম্মু আম্মু’ করি। তারপর ঘর উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে অগোছালো করে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ভুলেই গেছি মাকে ফোন করার কথা। একলা মা আমার খাবার নিয়ে তখনো বসে। ঘরে ঢুকে দেখি সবকিছু টিপটপ। ফিটফাট। মা আগ্রহী হয়ে শুনতে চাইবেন, কী করলাম সারা দিন। অকৃতজ্ঞ আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত। এই আমার মা। ‘মা, আজকে খুব খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।’ বলেই ব্যস। অস্থির মন সে কথা কখন হজম করে ফেলেছে। কিন্তু খাওয়ার টেবিলে গরম খিচুড়ি দেখে চোখ ভিজে যায় জলে।
গল্পটা বেশ পুরোনো। শাহবাগে হাজারো গাড়ির ভিড়ে হঠাৎ চোখ চলে গেল হতদরিদ্র এক নারীর দিকে। আলুথালু চুল, রক্তবরণ চোখ। ঊর্ধ্বশ্বাসে রাস্তার এ-পাশ ও-পাশ ছুটছেন। ফুটপাতের ওপর আছড়ে পড়ছেন। আবার জলদি উঠে রমনা পার্কের ভেতর ঢুকছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক আর কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমি মলিন চেহারার নারীটির কাণ্ডকীর্তি দেখছিলাম। হঠাৎ পার্কে হারিয়ে গেলেন, আবার হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। এবার সঙ্গে আরও কজন উৎসুক মানুষ। কজন নারী জোর করে আটকে ধরে রাখলেন তাঁকে। গগনবিদারী চিৎকারে ভেঙে পড়লেন তিনি, চিৎকার আর কান্নার রেশটা চরমভাবে আঘাত হানে বুকের মধ্যে। ওই নারী তাঁর শিশুসন্তানটিকে শুইয়ে রেখে ফুল বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। চোখের আড়াল হতেই হারিয়ে গেছে শিশুটি। পরের ঘটনাগুলো খুব সাধারণ—থানায় জিডি হয়েছিল। ব্যস, এতটুকুই। বেশ কদিন পর আবার খোঁজ করে নারীটিকে জিজ্ঞেস করলাম, খোঁজ পেয়েছেন কি না। নীরবতা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে চলে গেলেন। হঠাৎ মনে পড়ল আমার নানুমণির পোষা বিড়ালটার কথা। নানুমণি মহা বিরক্ত বিড়ালটার ওপর। প্রতিবছর চার-পাঁচটা বাচ্চা দিয়ে সব কটি হারিয়ে ফেলে বিড়ালটা। তারপর গোঙাতে থাকে সারা বেলা। বিড়ালটার কাতর আওয়াজের সঙ্গে নারীটির আর্তনাদের কোথায় যেন একটা মিল আছে। পার্থক্য শুধু একটাই—একজন মানুষ আর অন্যটি প্রাণী। কিন্তু উভয়ই মা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ ‘মা’। শব্দটা যেন এক মহৌষধ! তাই রোগে-শোকে-দুঃখে চরম বিপদে স্বভাবতই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘মা’। আজ বিশ্ব মা দিবস। বিশ্বের সব মাকে সম্মান আর ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যই এ আয়োজন। তবে একটা দিনে কি কিছু হয়? মায়ের জন্য যে বাঁধভাঙা ভালোবাসা, সেটা তো সারা জীবনেও পুরিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের সব অর্জন, সব সফলতা আর সব প্রাপ্তি—সবটুকুই তো ‘আমাদের আদরের আম্মুর জন্যই’। আমাদের দিন শুরু সেই আম্মুকে ঘিরে, দিনের শেষও আম্মুকে ঘিরে। যাঁকে ঘিরেই আমাদের পুরো জীবন। প্রথম বোলটিও তাই—‘মা’। আমাদের প্রথম হাসিটাও সেই মায়ের জন্যই। হাসলে মায়ের কাছে আদর পাওয়া যায়, এটা হলো আমাদের প্রথম শেখা পাঠ। তার পর থেকে হাঁটতে শেখা, বড় হওয়া, প্রথম অক্ষর শেখা—সবকিছুতে মায়ের উপস্থিতি সারাক্ষণ, সারাবেলা। শুধু কি তাই, রাজ্যের রাগ, অভিমান আর কষ্ট—সবকিছুতে মা। বিপদে পড়েছি, সেখানেও মা। মায়ের কথা মনে না থাকলেও অবুঝ মা যেন সব বুঝতে পারেন, মনে রাখেন সবকিছু। মায়ের সঙ্গে এই আমাদের সম্পর্ক। কত ভুল করেও শেষ আশ্রয় হয়েছে মায়ের কাছেই। অপরাধ করেছি, বকা খেয়ে গাল ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে টের পেয়েছি, চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন সেই কোমল মা। মাকে ঘিরে সবার সব গল্পই তাই সব সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায় পানিতে। প্রতিবছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালন করা হয় ‘মা দিবস’। মা দিবস উদ্যাপনের ধারণাটি প্রথম মাথায় আসে মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের। তবে প্রবর্তক হিসেবে খেতাবটা যায় আনা জার্বিসের নামে। ১৯০৮ সালের ১০ মে জার্বিসের পরিচালনায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনে সর্বপ্রথম দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি মানুষের মনে ঠাঁই করে নেয়। শেষমেশ ১৯১৪ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই থেকেই শুরু। নয় বছর পর অবশ্য খোদ জার্বিস রাষ্ট্রীয়ভাবে মা দিবস পালনের বিরোধিতা করে আদালতের দ্বারস্থ হন। তাঁর বক্তব্য ছিল, দিবসটি পালন করা উচিত পারিবারিকভাবে। তবে তাঁর বক্তব্য টেকেনি। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে মহা আড়ম্বরে পালন হয়ে আসছে মা দিবস। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ঢাকের শব্দে প্রতিবছর দিবসটি পালনে হাজির হয় নানা উপহার আর অসংখ্য ফুলের রাজি। নিন্দুকেরাও থেমে নেই। তবে বাণিজ্যের লাগামকে তো আর ধরে রাখা যাবে না। এ বাণিজ্য যেখানে জায়গা পায়, সেখানেই জোর দখল করে বসে। কিন্তু শুধু বাণিজ্য দিয়েই তো মাকে স্পর্শ করা যায় না। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন হলেই সার্থক হয় মা দিবস।
তাই বিশ্ব মা দিবসে পৃথিবীসমান ভালোবাসা আমাদের সব মায়ের জন্য। সেই মা আমার হোক না দরিদ্র কিংবা ধনী। হোক না পথের কিংবা অট্টালিকার। এই সীমাহীন ভালোবাসা আমার মায়ের জন্য, তাঁর মায়ের জন্য; যে মা কখনো মা হতে পারেননি, তাঁর জন্য; যে মাকে সবাই ভুলে গেছে, তাঁর জন্য; রত্নগর্ভা মায়েদের জন্য, ম্যাক্সিম গোর্কির মায়ের জন্য, সাহিত্যে স্থান পাওয়া সব মায়ের জন্য। মায়ের কি কোনো শ্রেণীবিভাগ আছে। মা তো মা-ই! সারা বছর তো বলি, মন দিয়েও তো অনুভব করি, তবু আজকের দিনটিতে সময় দিই আমার সেই মমতাময়ী মাকে, তাঁকে বলি—মা, তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি।

No comments

Powered by Blogger.