সংশয় পেরিয়ে নতুন সুযোগ -ব্রিটিশ নির্বাচন

(ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন ২০১০ নিয়ে গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমস-এর দুটি সম্পাদকীয় ছাপা হলো।)

সংশয় পেরিয়ে নতুন সুযোগ: গার্ডিয়ান
গত বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে যে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়েছে, একে ব্রিটেনের জন্য আশঙ্কাজনক বা জাতীয় দুর্বলতার কোনো লক্ষণ হিসেবে দেখা উচিত নয়। এই নির্বাচন এক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এবারের নির্বাচন থেকে প্রতিটি দলের জন্য যেমন কিছু পুরস্কার মিলেছে, তেমনি কিছু সমস্যাও তৈরি হয়েছে। ব্রিটেন ক্রমে ক্রমে যে বহুমাত্রিক, বহুদলীয় সমাজে পরিণত হয়েছে, সাম্প্রতিক অন্য নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের নির্বাচনে তার বেশ ভালো প্রতিফলন পাওয়া গেছে। অবশ্য এই প্রতিফলনও পুরো বাস্তবতাকে হাজির করে না। এ দেশের নাগরিকেরা হয় লেবার, নয় কনজারভেটিভ সমর্থক—এমনটা আর বলা যাবে না। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে প্রথমবারের মতো বড় দুই দল দুই-তৃতীয়াংশের কম ভোট পেল। সুতরাং বিকৃত প্রতিনিধিত্বের যে ব্যবস্থা চলে আসছে, তা মেরামতের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। এই সুযোগ সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে যথার্থ ও টেকসই করে তোলার। এমন মুহূর্ত খুব সহজে আসে না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
ডেভিড ক্যামেরন ও গর্ডন ব্রাউন তাঁদের নির্বাচন-উত্তর বক্তব্য দিয়েছেন। দেরিতে হলেও তাঁরা স্থিতিশীল সরকার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। উভয়ের বক্তব্যে আকর্ষণীয় নানা দিক ছিল। একটি স্থিতিশীল সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে ক্যামেরন স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার নানা সম্ভাবনার কথা বলেছেন। ব্রাউনের বক্তব্যও ছিল অনেক সুসংহত। লেবারের জন্য জায়গা তৈরির চেষ্টা আছে। সন্দেহাতীতভাবে উভয়ের বক্তৃতায় পুরোনো ব্যবস্থা থেকে নতুন ব্যবস্থা অভিমুখে যাত্রার দৃঢ় অঙ্গীকারের আভাস পাওয়া যায়: সেই পুরোনো ব্যবস্থায় প্রধান দুই দল মনে করত, দেশের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব শুধু তারাই করে, যেখান থেকে নতুন ব্যবস্থার দিকে তাদের এই যাত্রা, যেখানে প্রতিটি দল বহুমাত্রিক বাস্তবতায় একে অপরকে শ্রদ্ধা করতে এবং পরিপক্ব সমঝোতা ও আপস-মীমাংসায় পৌঁছার চেষ্টা চালাতে বাধ্য হয়। নির্বাচনের রাতের নানা হতাশাব্যঞ্জক দিকের মধ্যে এটিই ছিল উদ্দীপক একটি বিষয়।

তারা একে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট বলে: নিউইয়র্ক টাইমস
ব্রিটেনে লেবার পার্টিকে টানা চতুর্থবারের মতো পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে নেতৃত্ব দিতে গর্ডন ব্রাউন ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু এ নির্বাচনে কোন দল জিতেছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ব্রিটেনের নির্বাচনের এ ফল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। ব্রাউন এবং কনজারভেটিভ নেতা ডেভিড ক্যামেরন উভয়ই আফগানিস্তান বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার কৌশলের সমর্থক। তবে নির্বাচনের এ অনিশ্চিত ফল ব্রিটেনের রুগ্ণ অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ হতে পারে। এই সময়ে ব্রিটেনে শক্তিশালী এবং দৃঢ় নেতৃত্বের বড় প্রয়োজন।
পার্লামেন্টে এখন সর্ববৃহৎ দল কনজারভেটিভ পার্টি, কিন্তু তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় আসন লাভ করতে পারেনি। এ অবস্থায় একটি দুর্বল সংখ্যালঘুর সরকার অথবা মধ্য বামপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের অধিক কিছু তারা আশা করতে পারে না। লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কোয়ালিশন কনজারভেটিভদের জন্য অস্বস্তির। কারণ, কর সংস্কার, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, ব্যয় সংকোচনের সময় নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দলের অবস্থান স্পষ্টত ভিন্ন।
কনজারভেটিভরা নতুন সরকার দাঁড় করাতে ব্যর্থ হলে লেবার নিজে একটি কোয়ালিশন গঠনের চেষ্টা চালাতে পারে। নির্বাচনে বাজে প্রদর্শনীর পর তাদের পক্ষে নানা ছাড় দিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো কর্মসূচি হাজির করা আরও কঠিন। এমনকি লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও লেবারের কোয়ালিশন যদি হয়ও, তবু তা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে না। এটা হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিতে পারে। সরকার চালানোর স্পষ্ট জনসমর্থন পেতে আরেকটি নির্বাচনের প্রয়োজন পড়তে পারে।
সরকারের নেতৃত্বে যে-ই আসুক না কেন, তাদের প্রধান অগ্রাধিকার হবে ব্রিটেনের ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা। এ জন্য সরকারি সেবা খাতগুলোর বরাদ্দ কমানো আবশ্যক হবে।
১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে লেবারের চিন্তা, শক্তি ও সৌভাগ্য এখন নিঃশেষিত। এটি নির্বাচনে লেবারের খারাপ ফলের কারণ। কনজারভেটিভরা প্রয়োজনীয়সংখ্যক সমর্থন পায়নি; কারণ, থ্যাচারের সময়ের তিক্ত অতীত থেকে দলটির রূপান্তরের গভীরতা কতটুকু, সে বিষয়ে ভোটাররা সন্দিহান ছিলেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক নেতা নিক ক্লেগ সত্যিকারের উদ্দীপনা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ ভোটার কোনো অনভিজ্ঞ দলকে সুযোগ দিতে নারাজই থাকলেন। অবশ্য নীতির প্রশ্নে দলটির সারগর্ভ অবস্থানেরও ঘাটতি ছিল।
ভোটদাতাদের ২৯ শতাংশের ভোট যখন লেবারকে ২৫০টির বেশি আসন এনে দেয় আর অন্যদিকে ২৩ শতাংশ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ৫০টির কিছু বেশি আসন পায়, তখন নিশ্চয়ই নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে গলদ আছে। নির্বাচনী সংস্কার দরকার। আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা কোয়ালিশনের শর্ত হিসেবে এ দাবি তুলবে। এ মুহূর্তে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এমন এক সরকার, যেটি বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারে, আর তা করতে পারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিরুৎসাহিত না করে এবং বোঝা বহনের সামর্থ্য যাদের সবচেয়ে কম, তাদের ওপর সবচেয়ে ভারী বোঝা না চাপিয়ে।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: আহসান হাবীব।

No comments

Powered by Blogger.