বিএনপি হরতাল চায়, সরকার কী চায় -রাজনৈতিক সংস্কৃতি

২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের মে মাস—প্রায় সাড়ে তিন বছর। এত দীর্ঘ সময় হরতাল ছাড়া থাকার সুযোগ দেশবাসী আর পায়নি। দেশবাসী না হয় এক মহা ‘সুযোগ’ ভোগ করেছে, কিন্তু যাঁরা হরতাল ডাকেন, তাঁরা তো দীর্ঘদিন হরতাল ডাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হরতাল ছাড়া আর কত দিন! বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হরতাল ডাকার ‘সুযোগ’ থেকে বঞ্চিত মাত্র সাড়ে তিন বছর। কিন্তু বর্তমান বিরোধী দলের অবস্থা তো আরও খারাপ। তারা ক্ষমতায় থাকাকালে (২০০১-০৬) পাঁচ বছর, এরপর আরও সাড়ে তিন বছর—সব মিলিয়ে সাড়ে আট বছর কোনো হরতাল ডাকতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকার ‘মজা’ হরতাল ডাকার ‘মজা’র চেয়ে অনেক বেশি। তাই ক্ষমতায় থাকলে হরতাল ডাকার দরকার পড়ে না। কিন্তু বিরোধী দলে থাকা ও হরতাল না ডাকা—দুটি তো একসঙ্গে যেতে পারে না! বর্তমান বিরোধী দল বিএনপি ও এর নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলে থেকে প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করেছেন, হরতাল ডাকেননি। আর কত!
রাজশাহীতে গত বুধবার বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা অনুমান করছি, হরতাল আসছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার মনে সংশয়, হরতাল সফল হবে তো! কর্মীদের কাছ থেকে তাই তিনি প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন। জানতে চেয়েছেন, ‘হরতাল দিলে সফল করতে পারবেন তো?’ অনুমান করা যায়, এই সংশয়ের পেছনে গত সোমবার নির্বাচন কমিশন অভিমুখে বিএনপির পদযাত্রার অভিজ্ঞতা কাজ করেছে। এই পদযাত্রা নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘বাংলামোটরে থেমে গেল বিএনপির “বাধাহীন” পদযাত্রা।’ প্রতিবেদন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন অভিমুখে বিএনপির এই পদযাত্রায় বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। না পুলিশ, না সরকারি দলের কর্মী। এর পরও মিছিল কেন বাংলামোটরে এসে থেমে গেল? ‘সমাবেশ শেষে বিকেল সোয়া চারটার দিকে মুক্তাঙ্গন থেকে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর বিশাল মিছিলটি নির্বাচন কমিশন অভিমুখে রওনা হয়। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে কিছু দূর যেতে না যেতেই মিছিলের আকার ছোট হতে থাকে। কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাও মিছিল ছেড়ে চলে যান। একপর্যায়ে সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিকেল পাঁচটার দিকে মিছিলটি বাংলামোটর এসে পৌঁছালে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।’ গরমের কাছে সব পরাজিত!
ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনের ফলাফল বাতিল, পুনর্নির্বাচন ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য দুই কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচির যে পরিণতি হয়েছে, তাতে দলের চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়ার চিন্তিত হওয়ারই কথা। রাজশাহীর সমাবেশে উপস্থিত কর্মীদের কাছ থেকে খালেদা জিয়া সে কারণেই হরতাল ডাকলে তা সফল করার প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, কর্মীরা খালেদা জিয়াকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতএব হরতাল আসছে! বিএনপি যদি প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে আধাবেলা হরতালের ডাক দেয়, তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে ছয় ঘণ্টার কর্মসূচি। দেড় ঘণ্টার মিছিলে যদি দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও কর্মীরা ক্লান্ত হয়ে মিছিল ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন, তবে ছয় ঘণ্টার কর্মসূচি সফলের ভরসা কই? আগামী অক্টোবর-নভেম্বরের আগে তো গরম কমবে না! বিএনপি কী তবে হরতাল ডাকার জন্য সামনের শীত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? এতে কর্মীদেরও সুবিধা। আর হরতালের সময় যাঁরা হেঁটে কর্মস্থলে যান, তাঁদের কষ্টও কিছুটা কমবে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করবে, তা জানার জন্য ১৯ মে ঢাকার মহাসমাবেশ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
হরতালের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক। যারা বা যে দল হরতাল ডাকে, হরতাল শেষ হওয়ার পর তারা ‘হরতাল সফল’ করার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানায়। আর সরকার বা সরকারি দল হরতালে ‘সাড়া’ না দেওয়ার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানায়। মানে হরতাল ‘সফল’ করা বা হরতালে ‘সাড়া’ না দেওয়া—দুটোর কৃতিত্বই জনগণের। কিন্তু খালেদা জিয়া আমাদের এই দীর্ঘ দিনের ‘বিশ্বাসে’ চিড় ধরিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর কর্মীদের কাছে জানতে চাইলেন ‘হরতাল দিলে সফল করতে পারবেন তো?’ কর্মীরা যেহেতু আশ্বাস দিয়েছেন, তাই অনুমান করতে পারি বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয়, তা ‘সফল’ করতে কর্মীদের ভূমিকাই বেশি থাকবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ কী করবে কে জানে! বিএনপির হরতালের ‘সফলতা’ ঠেকাতে ‘জনগণের’ ওপর ভরসা না করে তারাও যদি কর্মীনির্ভর হয়ে পড়ে, তবে জনগণ যে বড় বিপদে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিএনপি এরই মধ্যে আজ রোববার বগুড়ায় আধাবেলা হরতাল ডেকেছে। রাজশাহীতে খালেদা জিয়ার সমাবেশে যাওয়ার সময় বিএনপির নেতা-কর্মীদের গাড়িবহরে হামলা ও বিএনপির এক নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় এই হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে। পত্রপত্রিকার খবর বলছে, এই হামলার জন্য সরকারি দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা দায়ী। যুক্তির বিচারে এ ঘটনায় বিএনপির ডাকা হরতালের দায়টাও তাই সরকারি দল আওয়ামী লীগের। রোববার বগুড়ায় ডাকা হরতাল তাই ‘আওয়ামী লীগের হরতাল’। খালেদা জিয়ার রাজশাহী মহাসমাবেশের পর সামনে আরও হরতালের যে আশঙ্কা আমরা করছি, তা কার হরতাল হবে? বিএনপির না আওয়ামী লীগের? বগুড়ার মতো ‘আওয়ামী লীগের হরতাল’ হলে হরতাল নিয়ে খালেদা জিয়ার দুশ্চিন্তা অনেক কমে যাবে। হরতাল নিয়ে বিরোধী দলের নেত্রীর দুশ্চিন্তা কমাতে চাইলে সরকারি দল বগুড়ার মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির গাড়িবহর বা মিছিল-সমাবেশে হামলা বাড়িয়ে দিতে পারে! নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় বিএনপির সমর্থকদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে!
বিরোধী দল হরতাল ডাকতে চায়। কিন্তু সরকার কী চায়? হরতাল ডাকার কাজে বিরোধী দলকে সহায়তা করতে, না কাজটি কঠিন করে দিতে?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.