তথ্যপ্র্রযুক্তি-ডিজিটাল বাংলাদেশের সালতামামি by মুনির হাসান

আর একটি ক্যালেন্ডার বছর গেল। বিগত বছরগুলোর সঙ্গে ২০০৯-এর একটি বিশেষ পার্থক্য হলো বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি। ২০২১ সালের মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, ব্যবসা ও পরিবেশের উন্নয়ন, পরিবারপ্র্রতি অন্তত একজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটিয়ে দেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকার।
একটি ডিজিটাল সমাজের জন্য প্র্রয়োজন আইনি কাঠামো ও নীতিমালা। চারদলীয় জোট সরকার তাদের শাসনামলের একেবারে শেষ সময়ে দেশে ইলেকট্রনিক লেনদেন, কম্পিউটার অপরাধ-সংক্রান্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্র্রযুক্তি আইন, ২০০৬ প্র্রণয়ন ও জারি করে। কিন্তু আইন প্র্রণয়নের তিন মাস পরই আইনটি অকার্যকর হয়ে যায়। ৯ জুলাই ২০০৯ বিজ্ঞান ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় সংসদে প্র্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটি কার্যকর করা হয়েছে। এতে ডিজিটাল লেনদেন ও সাইবার অপরাধের আইনি কাঠমো গড়ে উঠেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেটে ক্রেডিট কার্ড লেনদেনের দ্বার উন্মোচন করতে পেরেছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্র্রত্যন্ত অঞ্চলে প্র্রবাসীদের আয় তাঁদের পরিজনের কাছে পাঠানো সহজ হবে। গত ৮ অক্টোবর সরকার এই আইনের আওতায় ডিজিটাল স্বাক্ষর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রককে নিয়োগ দিয়েছে।
এরও আগে এপ্র্রিল ২০০৯ সালে সরকার জাতীয় তথ্য ও প্র্রযুক্তি নীতিমালা, ২০০৯ গ্রহণ করে। এই নীতিমালার আওতায় ৩০৬টি কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে। বছর শেষে দেখা যাচ্ছে এই কর্মপরিকল্পনায় বিধৃত অনেকগুলো স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, পাবনা, কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলার গ্রাহকদের বিদ্যুত্ বিল ঘরে বসে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বা মোবাইল অপারেটরের নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে প্র্রদান করতে পারা, বিদ্যুতের পাশাপাশি ঢাকার গ্যাস ও টেলিফোন বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে একই সেবার সুবিধা। বাংলাদেশ রেলওয়ের কয়েকটি আন্তনগর ট্রেনের সময়সূচি, ভাড়া ও আসনপ্রাপ্যতার খবর, সিরাজগঞ্জ ও কক্সবাজারে দুর্যোগের আগাম খবর এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ কম্পিউটার সরবরাহ ও প্র্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
বছরের শুরুতে দেশে ফাইবার অপটিকের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকার একটি প্র্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি সাশ্রয়ী মূল্যে টেলিযোগাযোগ সেবা প্র্রদানের সুবিধার্থে আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) প্র্রতিষ্ঠানগুলোয় আইপি টেলিফোনি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। দেশে ইন্টারনেট সেবার বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে প্র্রাপ্ত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথডের মূল্য ৩৩ ভাগ কমানো হয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছয় মাসে ৩০ ভাগ বেড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৫০ লক্ষাধিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৪৬ লাখ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন।
ডিজিটাল প্র্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্র্রমিতকরণের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় ওয়েব পোর্টালসহ বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা যোগ হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল প্র্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ হিসেবে একটি থানায় ডিজিটাল জরিপের পাইলট প্রকল্প হচ্ছে আর ঢাকা জেলার জমির সব তথ্য ওয়েবসাইটে প্র্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট তালিকা ওয়েবসাইটে প্র্রকাশ করা হয়েছে।
এ বছর শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্র্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। ২০০৯ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্র্রকাশে মোবাইল ফোন ও ওয়েবসাইটের পাশাপাশি শিক্ষাপ্র্রতিষ্ঠানগুলোর ই-মেইলে ফল পাঠানো হয়েছে। সব সরকারি কলেজে ইন্টারনেট সংযোগ ও ই-মেইল চালু করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের তথ্য ব্যবহার করে মোবাইল ফোনে ভর্তি পরীক্ষার নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্র্রথমবারের মতো মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা, প্র্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল ইত্যাদি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্র্রকাশ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে বিনামূল্যে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার জন্য সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে ওয়াইফাই জোন স্থাপন করা হয়েছে। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছানো নিশ্চিত করার জন্য এরই মধ্যে পাঠ্যপুস্তক ইন্টারনেটে প্রকাশ শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান ও আইসিটি মন্ত্রণালয় ৬৪টি জেলার ১২৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করার পাশাপাশি সেখানে তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের নিয়োগ দিয়েছে।
দেশের ৮০০ হেলথ সেন্টারে ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ দেওয়া হয়েছে। একাধিক টেলিমেডিসিন সেন্টার গড়ে উঠেছে। বেসরকারি উদ্যোগের মোবাইল স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও অনুরূপ সেবা চালু হয়েছে। সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য এলাকা ভিত্তিতে কমিউনিটি ই-সেন্টার/টেলিসেন্টার গড়ে তোলার কার্যক্রমে শরিক হয়েছে সরকার। দেশে বর্তমানে দুই হাজার ৩০০টির বেশি তথ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে কোম্পানি নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনলাইন করা হয়েছে। ফলে ব্যবসা চালুর প্রথম ধাপের কাজটি হয়রানি ছাড়া করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নভেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অটোমোটেড ক্লিয়ারিং হাউস পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।
সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিজিটাল উত্সব, আইটি মেলা, এমনকি বাগেরহাটে একটি জ্ঞান উত্সবের আয়োজন করা হয়েছে। এসব আয়োজনে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস), বেসিস ও বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে নজরে এসেছে। বিসিএসের উদ্যোগে নভেম্বরে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্মেলন হয়েছে। সরকারের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে একটি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে বিসিএস। এসব কর্মকাণ্ড তৃণমূল পর্যায়ে কম্পিউটারের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেকখানি বাড়িয়েছে। বিডিএএসএনের ওয়েবসাইট থেকে মাত্র এক দিনে ওপেন অফিস ও উবুন্টুর বাংলা ভাষার সহায়িকা ১০ হাজারের বেশিবার ডাউনলোড উন্মুক্ত সোর্সকোডভিত্তিক সফটওয়্যারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির জানান দিয়েছে।
অনেক ভালো উদ্যোগ থাকলেও বেশ কিছু কাজ হতে পারত, যা হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মতো অটোমেশনের সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পর সেটি চালু না হওয়া। অথচ অর্থমন্ত্রী এই কার্যক্রমের উদ্বোধনও করেছেন। যথারীতি উন্মুক্ত হয়নি ভিওআইপি। এমনকি টেলিযোগাযোগ খাতের একটি বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক দূর টেলিযোগাযোগ নীতিমালা, ২০০৭ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। চালু হয়নি সচিবালয়ের ব্যাকবোন নেটওয়ার্কটি। মাস তিনেকের মতো পিছিয়ে যাওয়ায় সরকারের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ‘বাংলা গভনেট’-এর কাজ শুরু হয়নি। শুরু হয়নি জাতীয় উপাত্ত কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ। বছর শেষের প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ওয়েবসাইটগুলো এখনো অনেক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
এই বছর সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সম্ভবত এই খাতের সমন্বয়ক হিসেবে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সামনে আসা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পয়াড কমিটি

No comments

Powered by Blogger.