ঋণগ্রহীতার মান নির্ণয় করতে হবে ২০১০ সালের প্রথম প্রান্তিক থেকে -ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নে ঢুকে পড়ল বাংলাদেশ by মনজুর আহমেদ


নতুন বছর থেকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বতন্ত্র ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি দিয়ে ঋণগ্রহীতার মান (বরোয়ার রেটিং) নির্ণয় করতে হবে। এ মান অনুসারে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
কোনো ঋণগ্রহীতার মান নির্ধারণ করা না হলে সেই ঋণকে ১২৫ শতাংশ হারে ঝুঁকি বিবেচনা করে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ন্যূনতম ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। এটি ব্যাংকের মোট আবশ্যিক মূলধনে যুক্ত হবে।
অর্থাত্ ‘ক’ কোম্পানির কাছে কোনো ব্যাংকের ১০ কোটি টাকার ঋণ থাকলে, কোম্পানিটি কত শতাংশ হারে ঋণ ফেরত দিতে সক্ষম, সেই মান নির্ধারণে কোনো ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির মূল্যায়ন না থাকলে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঝুঁকি বিবেচনা করতে হবে। এই ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে অর্থাত্ এক কোটি ২৫ লাখ টাকার মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে ব্যাংকটিকে।
আগামী মার্চ প্রান্তিক শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এভাবে অন্তত বড় ও মাঝারি ঋণগ্রাহকদের রেটিং শেষে প্রয়োজনীয় মোট মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। এপ্রিলের মধ্যে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মানসংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ, ব্যাসেল-২ অনুসারে মূলধন সংরক্ষণে এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের মধ্যে ঢুকে পড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাসেল-১ ও ২ সমান্তরালভাবে বাস্তবায়নের কাজ পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু গত সপ্তাহের বৈঠকে সরাসরি ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এই কমিটির প্রধান হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা। কমিটিতে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা রয়েছেন।
নজরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দেশই ব্যাসেল-২-এ প্রবেশ করেনি। কিন্তু আমরা মনে করি, সরাসরি ব্যাসেল-২ বাস্তবায়ন শুরু করলে অগ্রগতিটা হবে। প্রয়োজনে ঝুঁকিনির্ভরতার হারের বিষয়ে কিছু শিথিলতা এনে আমরা বিবেচনা করে দেখতে পারি।’
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মানসংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে কোনো ব্যাংকের আর্থিক সংকট দেখা দিলে মূলধন দিয়ে তা উত্তরণের সুযোগ তৈরি হয়। এতে ব্যাংকের মৌলভিত্তি শক্তিশালী হয়।
ব্যাসেল-২-তে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি নির্ণয় করে মূলত মূলধন সংরক্ষণের বিষয়টি রয়েছে। ঋণ ঝুঁকির বাইরে অন্য যেসব ঝুঁকি এখানে বিবেচনা করা হবে সেগুলো হলো—পরিচালন ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি, বৈদেশিক লেনদেনে ঝুঁকি, দেশভিত্তিক ঝুঁকি ইত্যাদি।
সমস্যা হলো, বাংলাদেশে মাত্র দুটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে। ফলে বিপুলসংখ্যক ঋণগ্রহীতার ঋণমান নির্ণয় করা নিয়ে ব্যাংকাররা সংশয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, পাকিস্তানেও মাত্র দুটি রেটিং এজেন্সি আছে। তবে তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি। বাংলাদেশে ক্রিসেল ও ক্র্যাব—এই দুটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্রিসেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ব্যাংকগুলোকে অন্তত ৬০ ভাগ ঋণগ্রহীতার রেটিং শেষ করতে হবে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে; যেগুলোকে বড় ও মাঝারি মানের গ্রুপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে। মাঝারি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বলতে বাণিজ্য ও সেবা ঋণের ক্ষেত্রে ৫০ লাখ থেকে ১০ কোটি টাকা এবং উত্পাদন খাতে দেড় কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণকে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি অঙ্কের ঋণকে বড় ঋণগ্রহীতা বিবেচনা করা হবে।
উল্লেখ্য, কোনো বড় গ্রুপের যে কয়টি ঋণ থাকবে, প্রতিটি ঋণের রেটিং করাতে হবে। রেটিংক্রম অনুসারে ন্যূনতম ২০ শতাংশ হারে ঝুঁকি বিবেচনায় রাখতে হবে এবং এই ঝুঁকির ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।
ওপরে উল্লিখিত ঝুঁকির পাশাপাশি কোনো ঋণের জন্য আদালতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংরক্ষণ করা হয়নি বলে আদালত মত দেন। এসব ঝুঁকিও বিবেচনায় নিতে হবে। আবার সংরক্ষিত জামানতের আর্থিক মূল্যেও কিছু ঝুঁকি থাকে, তার বিপরীতেও মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।
ঝুঁকির পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ঝুঁকির বিভিন্ন দিক প্রকাশ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.