বিধ্বস্ত হাইতির গল্প ও একটি অনাগত আশঙ্কার কথা -সুমন রহমান |

যত যা-ই হোক, হাইতির ভূমিকম্প নিয়ে কিছু লিখব না, ভেবে রেখেছিলাম। কী আর লিখব, যেখানে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার এক ভূকম্পনে পোর্ট অ প্রিন্স শহরটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ৫০ হাজারের মতো মানুষকে গণকবর দেওয়া হয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে জ্যান্ত কবর হয়েছে আরও কমপক্ষে ৫০ হাজার কি এক লাখ মানুষের। এত বড় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে কি-ই বা বলার আছে, ব্যথিতচিত্তে চুপ করে থাকা ছাড়া? তার ওপর, আপনি যদি এমন কোনো শহরের অধিবাসী হোন, যেটি একই ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কার ওপর দাঁড়িয়ে, তাহলে হাইতির ভূমিকম্প আপনার কাছে কিছু বাড়তি বার্তা বহন করবে নিশ্চয়ই। অর্থাত্, এই দুর্ঘটনা শুধু দূর থেকে দেখে যাওয়ার নয়, বরং আশঙ্কার সঙ্গে বাস্তবের ফারাককে কমিয়ে দেয় অনেক। নয়া উদরনৈতিক অর্থনীতির মন্ত্রে যেসব শহর দরিদ্র গ্রামবাসীর অসহায় অভিবাসনে ফুলে-ফেঁপে টইটম্বুর হয়ে উঠছে, একটা প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ সেখানে কত বড় মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, হাইতির ভূমিকম্প তারই নমুনা।
সত্যি বলতে কি, ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুনামি কিংবা ২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পও এত গল্প, এত অভিঘাত তৈরি করতে পারেনি। যদিও চীনের মতো দেশ সিচুয়ানের ভূমিকম্প সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে। আর সুনামির ধাক্কাটা বিভিন্ন দেশ ভাগ করে নেওয়ায় এর বিপর্যয়টুকু একসঙ্গে দৃশ্যমান হয়নি। হাইতির ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে—ভূমিকম্পে হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্স বিধ্বস্ত হলো। এই এক শহর, যেটি তার ঔপনিবেশিক সংগ্রামের ঐতিহ্য সত্ত্বেও বিকশিত হয়েছে মার্কিন মদদপুষ্ট অর্থনীতির গিনিপিগ হিসেবে; যে অর্থনীতি হাইতির গ্রামীণ কৃষিকে অনেক আগেই ধ্বংস করেছে, ফলে শহরমুখী মানুষের ঢল সামাল দিতে পোর্ট অ প্রিন্স বেড়ে উঠেছে নিদারুণ অপরিকল্পনায়। আবার চীনের ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয়নি, ভূমিকম্প-উত্তর হাইতিতে গণমাধ্যম পৌঁছাল তড়িত্গতিতে। ত্রাণসামগ্রীরও বহু আগে। আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রীয় ভবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় মার্কিন সাংবাদিক হাইতির প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করছেন, তিনি আজ রাতে কোথায় থাকবেন? প্রেসিডেন্ট বিব্রতমুখে বললেন, তাঁর থাকার ব্যবস্থা কিছু একটা হবে, কিন্তু এ শহরের অনেকেরই হবে না—সেটা নিয়ে তিনি ভাবছেন। সে সময় হাইতির প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই মার্কিন মুল্লুককেই ত্রাতা হিসেবে ভাবছিলেন, নয়তো এমন নির্দয় প্রশ্নের জবাব আরও অন্যরকম হতে পারত। সত্যি বলতে কি, এমন ধ্বংসস্তূপের ওপরে গণমাধ্যমের দাপাদাপি আমাদের হয়তো অনেক তথ্যের জোগান দিয়েছে, কিন্তু কখনো কখনো অনেক নির্দয় লেগেছে ভ্রাম্যমাণ টিভি ক্যামেরাগুলোকে। খোদ হাইতিবাসী অনেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, দোহাই আর গণমাধ্যম নয়, দরকার সত্যিকারের ত্রাণ, সত্য উদ্ধার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ‘সুইফট অ্যান্ড অ্যাগ্রেসিভ’ ত্রাণ সহায়তার আশ্বাস এই বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের ডামাডোলে ফাঁকা বুলিতে পরিণত হলো। একমাত্র বিমানবন্দরটিরও কাঠামো ভেঙে পড়েছে, জোড়াতালি দিয়ে একে ন্যূনতম কাজের উপযোগী করে তোলা হয়েছে পরে। প্রাথমিক ত্রাণ বলতে খাদ্য, ওষুধসামগ্রী আর কাপড়চোপড়। কিন্তু সেগুলো কোথায় কীভাবে যাবে? সব কটি হাসপাতাল ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। বাড়িঘরেরও বেশির ভাগ। আফটার শক হতে পারে এই আশঙ্কায় বেঁচে যাওয়া মানুষ রাস্তায় বা খোলা জায়গায় অবস্থান করছে। জ্যান্ত মানুষ আর লাশের মধ্যে ফারাক করা যাচ্ছে না, পাশাপাশি পড়ে আছে সব। ভূগর্ভস্থ পানির লাইন বা বিদ্যুত্ব্যবস্থা সবই অতীতের স্মৃতিমাত্র। বিদ্যুত্হীন, পানিহীন, যোগাযোগ-ব্যবস্থাহীন একটি শহরের তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া ভবনগুলোর ভেতরে আটকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে তরিয়ে যাচ্ছে প্রায় এক লাখ মানুষ। অসম্ভব ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসছে সন্ধ্যাবেলাতেই, অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ, আর তাকে ভারী করে তুলছে এখানে ওখানে মানুষের আহাজারি, আর্ত চিত্কার। জ্যান্ত কবর খুঁড়ে মুমূর্ষু বা মৃত মানুষকে বের করে নিয়ে আসার মতো ভারী যন্ত্রপাতি বা বুলডোজার নেই একটাও। আবার শহরের কারাগার ভেঙে যাওয়ায় সেখান থেকে পালিয়ে গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে পাঁচ হাজারের মতো দাগী অপরাধী। একদিকে জীবিত মানুষদের একটি দল জড়িয়ে পড়েছে লুটতরাজ, ছিনতাইয়ের মতো কর্মে; অন্যদিকে মানুষ মরছে, শহরময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশের গন্ধ তৈরি করছে নারকীয় এক পরিস্থিতি। আলবেয়ার কাম্যুর দ্য প্লেগ উপন্যাসে প্লেগের মহামারিতে গোটা শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বর্ণনা, কিংবা হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস উপন্যাসে যেভাবে একটা শহরের সব মানুষ প্রায় একসঙ্গে অন্ধ হয়ে যাওয়ার কাহিনি বলা হয়েছে, তার থেকেও নারকীয় যেন পরিস্থিতি! পৃথিবীতে এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতির কথা ভাবা যায়?
পড়ছিলাম কানাডাপ্রবাসী হাইতিয়ান এক গায়িকার লেখা: হাইতি থেকে তাঁর মা তাঁকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছিল হাইতির সামরিক জান্তা। হাইতি তাঁর কাছে শৈশবের এক দুঃস্বপ্নমাত্র। তবু এই ভূমিকম্প তাঁকে ব্যাকুল করে তুলেছে। তিনি হয়তো কোনো দিনই ফিরবেন না সে শহরে। তবু সে শহরটার বেঁচে থাকা তাঁর অনাবাসী সত্তাকে কোথাও নোঙর করতে দেয় নিশ্চয়ই! ভূমিকম্পের পর পোর্ট অ প্রিন্সের কোনো হোটেলে আটকে থেকে টুইটার ব্লগম্যাসেজ লিখছিলেন একজন শিল্পী। তিনি লিখেছেন, যতক্ষণ তাঁর ল্যাপটপে ব্যাটারি সাপোর্ট ছিল, কীভাবে একের পর এক ‘আফটার শক’ হলো, মানুষ আটকে পড়ল ধ্বংসস্তূপে, আর মরতে থাকল রাস্তায়, ঘরে, বাইরে, চার্চে কি হোটেলে—সর্বত্রই লাশ, লাশ, লাশ, লাশ আর লাশ! একসময় চার্চের এক ফাদার তাঁর হোটেলে এলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ঈশ্বরের আরাধনার জায়গা হয়েও চার্চগুলো কেন ধসে গেল? ফাদার কী জবাব দিয়েছিলেন, সেটা লেখেননি তিনি। শুধু লিখেছেন, ঈশ্বরের লীলা বোঝা ভার!
দুটো উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে: লর্ড লিটনের লেখা দ্য লাস্ট ডে’জ অব পম্পেই নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে ইতালির পম্পেই শহর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এক নাটকীয় কাহিনি সাজিয়েছেন তিনি। সেই কাহিনি কিন্তু প্রচলিত ভালো-মন্দের ধারণা, অর্থাত্ দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন-জাতীয় আবহের ওপরই দাঁড়ানো। হতে পারে, লেখক লর্ড লিটনের উনবিংশ শতকের বাস্তবতা থেকে প্রথম শতকের পম্পেই শহরের বাস্তবতা যোজন যোজন দূরে ছিল। তুলনায় ভলতেয়ারের আলোচিত কাহিনি কাঁদিদ বেড়ে উঠেছে উনবিংশ শতকের লিসবন শহরের ভূমিকম্পকে কেন্দ্রে রেখে। সেই ভূমিকম্পে লক্ষাধিক লোক নিহত হয়। কাঁদিদ উপন্যাসে ভলতেয়ার লর্ড লিটনের মতো ঐতিহাসিক দূরত্বের মহিমা গ্রহণ করেননি। কারণ হয়তো এটা, তিনি ঘটনার সমসাময়িক ছিলেন। ভূমিকম্পের আঁচ তাঁর গায়েও লেগেছিল। উপন্যাসে তিনি বারবারই যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটা হলো, এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের কোনো ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা নেই, কোনো নৈতিক ব্যাখ্যা নেই। বিজ্ঞান এখানে প্রায় প্রতিবন্ধী, ঈশ্বর এখানে নিয়তির হাতে বন্দী। হাইতির ভূমিকম্প সে কথাই বলে। কখনো কোনো ঔপন্যাসিক নিশ্চয়ই হাইতির ভূমিকম্প নিয়েও ঢাউস উপন্যাস ফাঁদবেন। তিনি যদি কার্যকারণ আর ব্যাখ্যাসন্ধানী হন, তাহলে এই ভূমিকম্পের অছিলায় নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতি আর অপরিকল্পিত নগরায়ণকে একহাত নেবেন। আবার তিনি যদি ভলতেয়ারের মতো ভাবেন, হয়তো দেখবেন যে এত বড় বিপর্যয়ের সামনে মানব সভ্যতা, এর ভাবনাপদ্ধতি, এর রাজনীতি, এর অগ্রগতির ধ্যানধারণা কত ঠুনকো, কতখানি অসহায়!
তবু নানারকম গল্প তো তৈরি হতেই থাকে। এই যেমন, ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পর বেঁচে যাওয়া পিতা এভয়েল কর্মেইলে তাঁর পোর্ট অ প্রিন্সের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ বেপরোয়াভাবে খোঁড়ার চেষ্টা করছেন। কারণ, সেখান থেকে তাঁর স্ত্রীর স্যুটকেসটি বের করতে হবে, যেখানে আছে তাঁদের পরিবারের সবার পাসপোর্ট আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ভিসা! এভয়েল যখন তাঁর বাড়ি খোঁড়ার চেষ্টায় রত, অদূরেই তখন ছিনতাইকারীরা জুতা, টিস্যু পেপার, এমনকি ক্যাসেট প্লেয়ার পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে, যেখানে যা পাচ্ছে। তবু এভয়েল বেপরোয়া, কারণ, তিনি বুঝেছেন, একমাত্র মার্কিন ভিসাই তাঁর পরিবারকে এই মৃত্যুপুরী থেকে রক্ষা করতে পারে। এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরটার আর কোনো ভবিষ্যত্ নেই। বুলডোজারহীন শহরে তিনি নিজের ধসে যাওয়া বাড়িটা খালি হাতেই খুঁড়ে চলেছেন, যা কিছুই মিলছে, সুযোগসন্ধানীরা সেসব নিয়ে পালাচ্ছে। এই যেমন শ্যাম্পুর একটা বোতল নিয়ে দৌড়াল এক যুবা দম্পতি। সেসবে থোড়াই ভ্রুক্ষেপ করছেন এভয়েল, কারণ, তাঁকে হাতছানি দিচ্ছে ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকত!
হাইতির পোর্ট অ প্রিন্সের কথা এটুকুই লিখলাম, আরেকটি শহরের এ ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় কাঁপতে কাঁপতে। যে শহরটি পৃথিবীর দ্রুত বর্ধিষ্ণু শহরগুলোর চূড়ার দিকে অবস্থান করছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণকে যে তার শিরোভূষণ বানিয়ে নিয়েছে কয়েক দশক ধরে, যেখানে নদী ভরাট করে মধ্যবিত্তের আবাসন আর খালপাড়ে নিম্নবর্গের বস্তিবিকাশ ঘটছে বিরামহীনভাবে, আবার প্রাকৃতিকভাবেও যে শহর বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে বলে সবাই জানেন—প্রায় দেড় কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে এ ধরনের একটি বিপর্যয়ের চেহারা কেমন হতে পারে? আমাদের নগরনির্মাতারা কি তাঁদের কল্পনাকে এতদূর পর্যন্ত এখনো বিন্যস্ত করতে পারছেন না?
সুমন রহমান: কবি ও গল্পকার।
sumanrahman@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.