১০ হাজার কোটির ‘বিলাসী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কী হবে? by পিয়াস সরকার
২০১৬ সালে সংসদে বিশ্ববিদ্যালটি স্থাপনের আইন হয়। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক সংলগ্ন এলাকায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন হয়। ‘বিডিইউ’-এর পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের জুনে। যার লক্ষ্যের কথা বলা হয়, রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অংশগ্রহণ। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পৌঁছানোতে ভূমিকা রাখা, বাংলাদেশে অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি অন্যতম উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়া। উন্নত সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা এবং উদ্ভাবনীতে উৎকর্ষ সাধন। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের প্রথম প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হবে হাইটেক পার্কের পাশে। হাইটেক পার্ককেন্দ্রিক সকল প্রকল্প মূলত নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।
২০১৪/১৫ সালে প্রযুক্তি খাতে উৎকর্ষ সাধনের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি রিলেটেড বিশ্ববিদ্যালয়ে কারিকুলাম আপগ্রেডেশনের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়। সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম, রোবটিক্স, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন, এডুকেশনাল টেকনোলজি, সফটওয়্যার অ্যান্ড মেশিন ইন্টেলিজেন্স, ডাটা সাইন্স বিশেষ করে সিকিউরিটি অ্যান্ড কমিউনিকেশন এই বিষয়গুলো প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যুক্ত করার গুরুত্বারোপ করা হয়। তবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি সূত্র জানায়, এই বিষয়গুলো যুক্ত করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব আসে ২০১৫ সালে আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে। এরপর কারিকুলাম আপগ্রেডেশনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদে আসে। নাম প্রস্তাব করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের সময় ছিল না কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ছিল না মাস্টাপ্ল্যান। এমনকী কোনো ধরনের কাঠামো ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি ছাড়াই শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। শুরুতে ঢাকায় ভাড়া করা ভবনে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য বিলাসী বাজেট প্রণনয়ন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হয়েছিল নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ একর। কিন্তু গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় মাত্র ৫০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি স্থাপনের জন্য বাজেট দেয়া হয় ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল (ডিপিপি) জমা দেয়া হয়। জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। বাকি টাকার বেশির ভাগই খরচ হওয়ার কথা কেনাকাটায়। এই বিপুল ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সর্বোচ্চ পড়তে পারবেন ৪ হাজার শিক্ষার্থী। তৎকালীন ইউজিসি সদস্য ড. মোহাম্মদ আলমগীর ২০২২ সালে মানবজমিনকে বলেছিলেন, আমরা ডিপিপি সংশোধন করতে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তেমনভাবে কোনো পরিবর্তন করেননি। পরে আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণসহ সেই ডিপিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। প্রকল্প কার্যক্রমের জন্য মোট ক্রয় পরিকল্পনা-পণ্যের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা।
এই বিপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট মানবজমিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। সে সময় এনিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়। এটি বাতিল করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর মুনাজ আহমেদের স্থলে ভিসির দায়িত্ব পান অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। এরপর পরের বছর তিনি ডিপিপি আংশিক বাজেট পেশ করেন ৬৯৩ কোটি টাকার। এটি নিয়ে একনেকে রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এই রিভিউ কমিটির রিপোর্ট আসার আগেই পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের।
বিশ্ববিদ্যালয়টির নামে ডিজিটাল হলেও সাধারণ সুযোগ-সুবিধাও নেই। বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী ৪৫৯ জন। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টি পায়নি নিজস্ব ভবন ও ক্যাম্পাস। কার্যক্রম চলছে দুটি ভাড়া করা ভবনে। শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে বাসা ভাড়া নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে শ্রেণিকক্ষের সংকট। ছোট ছোট কক্ষে গাদাগাদি করে নেয়া হয় ব্যবহারিক ক্লাস। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এখনো নির্মাণ হয়নি কোনো ভবন। কোনো ভবন বা সুবিধা না পেয়েই একটি ব্যাচ এ বছরের শেষের দিকে অনার্স শেষ করতে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ মাসের সেমিস্টার ফি সাত হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। কেউ অকৃতকার্য হলে এখন ২১ হাজার টাকা দিয়ে আবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। তাদের দাবি প্রযুক্তিগত শিক্ষার বাইরে তাদের নগণ্য প্রাকটিক্যাল কার্যক্রম। ২০২২ সালের ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় দেখানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। আগের বছর যা ছিল নয় লাখ ২৫ হাজার টাকা।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিগত কারিকুলাম আপডেট জরুরি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটি করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষা ও গবেষণার উপর পিএইচডি করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অমিত হাসান। তিনি বলেন, আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরি হবার আগে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো উচিত নয়। এতে এই শিক্ষার্থী যেমন ঘাটতি নিয়ে বের হবে সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে হীনমন্যতাতেও ভুগে। বাংলাদেশের জন্য এখন যে বিশ্ববিদ্যালয় আছে এগুলোই অধিক। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের প্রয়োজন নেই। আমাদের নজর দেয়া উচিত রুট লেভেলে।
তিনি বলেন, গত সরকার শিক্ষার মান উন্নয়ন বলতে বুঝতো নতুন ভবন নির্মাণ। এটা শুধুমাত্র দৃশ্যমান উন্নয়ন। এটাতে শিক্ষার কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না বরং তৈরি হচ্ছে আত্মবিশ্বাসবিহীন গ্রাজুয়েট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, তারা শুধুমাত্র অর্থ লোপাটের জন্যই এটা করেছে। সত্যিকার অর্থে যদি তারা দেশ ডিজিটাল করতে চাইতো তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা ছড়িয়ে দিতো। প্রতিটি জেলায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা জরুরি। আমাদের বিপুল পরিমাণ মানুষ প্রবাসে যাচ্ছে আনস্কিলড হয়ে। কারিগরি শিক্ষাপ্রসার করতে হবে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু করা হয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে সেগুলোকে অকার্যকর রেখে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ মানেই টাকা।
তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য আপার লেভেলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগে রুট লেভেলে আপডেট করা জরুরি। চলমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়ন না করে আগের সরকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে চাইতো লুটপাটের জন্য।
No comments