বাবার স্বপ্ন ছিল রাব্বি প্রকৌশলী হবে by ফাহিমা আক্তার সুমি

এখন আর কাঁদতে পারি না, চোখে পানি নেই। এক মাসের বেশি সন্তানটি আমাদের বুকে নেই। সে আর আমাকে বাবা বলে ডাকে না। আমি দিনমজুরের কাজ করি। সন্তানটিকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করেছিলাম। স্বপ্ন ছিল আমার সন্তান একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে, বিদেশ যাবে। বাবা-মায়ের দুঃখ ঘুচাবে। অনেক গর্ব হতো আমাকে একদিন সবাই ইঞ্জিনিয়ারের বাবা বলে ডাকবে। এই স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। সন্তানের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত ইসমাঈল হোসেন রাব্বির বাবা মিরাজ।

তিনি মানবজমিনকে বলেন, আর কোনো স্বপ্ন নেই। ২০২৪ সালে রাব্বি এসএসসি পাস করে এরপর তাকে শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করা হয়। সেখানে মেসে থাকতো। আমার দুই মেয়ের পর রাব্বির জন্ম হয়। সে ছিল আমার একমাত্র ছেলে সন্তান। আমি তো সবার কথা শুনতে পাচ্ছি কিন্তু আমার রাব্বি তো আমাকে এসে ডাকে না। আমি কার কাছে আমার দুঃখ বলবো, কে দেখবে এই কষ্ট। আমার ঘরে বাতি জ্বালানোর মানুষ চলে গেছে। অনেক আশা করে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি সে শ্বশুরবাড়ি থাকে আরেকটি মেয়েকে বিয়ে দিলে সেও চলে যাবে। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কাকে নিয়ে থাকবো। রাব্বিরও স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, কিন্তু সে স্বপ্ন গুলিতে কেড়ে নিলো।
যাত্রাবাড়ীর করাতিটোলা রাব্বিদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, চারিদিকে রাব্বির ব্যবহারিত জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তার বাবা-মা ও দুই বোন জিনিসগুলো হাতে নিয়ে কখনো কাঁদছেন, কখনো পাথর হয়ে বসে আছেন। অ্যালবামে রাখা রাব্বির ছবিগুলো উল্টিয়ে দেখছেন মা আসমা বেগম। আবার ছবিগুলো হাতে নিয়ে রাব্বির বাবা তার মোবাইলে ছবি ধারণ করছেন আর মুখ লুকিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। এ দৃশ্য যেন পুরো ঘরটিতে অন্ধকার নামিয়ে রেখেছে।

কাঁদতে কাঁদতে রাব্বির মা আসমা বলেন, আমার রাব্বি সবসময় বলতো শহীদ হবো, ওর মুখের কথাই সত্যি হলো। আমার বুকের ভেতরে অনেক কষ্ট। আমার ছোট রাব্বিকে বড় করেছি কত কষ্ট করে। আমার বাবা আজ কতোদিন হয়ে গেছে আমাকে মা বলে ডাকে না। আমার ঘরের আলো নিভে গেছে।
গত ৪ঠা আগস্ট রাতে রাব্বি বাসায় না ফেরায় বিভিন্ন এলাকাসহ হাসপাতালগুলোতে খুঁজতে থাকে তার পরিবারের সদস্যরা। রাতভর তাকে খুঁজে না পেয়ে ৫ই আগস্ট আবার ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মর্গে গিয়ে রাব্বির মরদেহ শনাক্ত করে তার দুই বোন মিতু ও মিম। মিম বলেন, গত ১৫-১৬ই জুলাই শরীয়তপুরে দুইবার আমার ভাই ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়। এটা শোনার পরে ১৭ই জুলাই ভাইকে ঢাকা নিয়ে আসি। ঢাকাতে এসে পরের দিন আবার আন্দোলনে যায়। ১৯শে জুলাই সে শাহবাগে গিয়ে বুকের বাম দিকে একটা ছররা গুলিবিদ্ধ হয়। সে সময় তিনদিন জ্বরে ভুগেছে। ৪ঠা আগস্ট আমি টিউশনি করাতে যাওয়ার আগে ওকে রেখে দরজা বন্ধ করে দেই পরে এসে দেখি ও বাসায় নেই। মোবাইলে কল দেই পরে রিসিভ করে না। মা-সহ যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, ধোলাইপাড় ও অন্যান্য জায়গা খুঁজে কোথাও পাইনি রাব্বিকে। সন্ধ্যার পর থেকে ওকে খুঁজতে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পাইনি। পরের দিন ভোরে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে কোনো ওয়ার্ড, কেবিন খুঁজতে বাকি ছিল না। একজন লোক বলে একটু মর্গে গিয়ে দেখার জন্য। তিনি বলেন, মর্গে আমার বোন একটা ছবি দেখে শনাক্ত করে। রক্তমাখা একটা স্ট্রেচারে মগজ বের হওয়া অবস্থায় মর্গে পড়ে ছিল আমাদের রাব্বি। এত রক্ত ছিল নাকে-মুখে চেনাই যাচ্ছিলো না। আমরা লাশ দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে বলি। তখন তারা বলেন, এটা আমরা দিতে পারবো না। এটা পুলিশ কেস। শাহবাগ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় রাব্বি। একেবারে কপালের মিডিলে গুলিটা লেগে পেছন দিক দিয়ে মগজসহ বের হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা শিক্ষার্থীরা আমাদের জানায়, একজন শিক্ষার্থীর পায়ে গুলি লাগে তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য রিকশায় উঠতে যায় এ সময় তার কপালে এসে গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় পড়ে মারা যায়। প্রায় বিকাল পাঁচটার দিকে গুলি লাগে। আমাদের লাশ দিতে চায়নি। পরে আমার দুই মামা যায় ধানমণ্ডি ঝিগাতলায় সেখানে গিয়েও কোনো কাজ হয়নি।

বড় বোন মিতু বলেন, ভাইয়ের বুকে সাদা কাগজে ‘আবদুল্লাহ’ ভুল নাম লিখে রাখে। মর্গ থেকে আমাদের বলে, এটা যে আপনার ভাই এটার প্রমাণ কি? তখন আমরা তাদের বলি কীভাবে আমরা আপনাদের প্রমাণ দিবো? ঢাকা মর্গে যে পুলিশ সদস্যরা ছিল তাদের পায়ে পর্যন্ত ধরে কান্না করেছি আমার ভাইয়ের লাশ দেয়ার জন্য কিন্তু দেইনি। আমরা দুই বোন মর্গের সামনে কান্নাকাটি করি। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ভাই মিছিল নিয়ে আসে তখন আমার ভাইসহ আরও তিনজন শহীদ ভাইয়ের লাশ মর্গ থেকে বের করে তারা। তখন আমরা রাব্বি আমাদের ভাই তাদের জানাই। এ সময় আমাদের কাছে দিয়ে দেয় রাব্বিকে। পুলিশ যেন আমাদের কাছ থেকে রাব্বিকে কেড়ে নিতে না পারে তখন স্ট্রেচারে লাশ কাঁধে নিয়ে আমরা দুই বোন দৌড় দেই। আমরা হাসপাতালে যাই সেখান থেকে একটা ডেড সার্টিফিকেট দেয় তাতে নাম সিরিয়াল নম্বর ছাড়া কিছুই লেখেনি। কুকুর-বিড়াল মারা গেলে রাস্তায় যেভাবে পড়ে থাকে সেভাবে মর্গে কয়েকশ’ লাশ পড়েছিল একজনের উপর আরেকজন। এত লাশ আগে কখনো এভাবে দেখিনি। শিক্ষার্থীরা আমার ভাইয়ের লাশ নিয়ে মিছিল করেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। মাদারীপুর গ্রামের বাড়িতে ওর দাফন করা হয়।

তিনি বলেন, আমার বাবা শ্রমিকের কাজ করে। মা আগে টিউশনি করাতো। ছোট বোন পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করায়। এভাবেই আমাদের সংসার চলে। আল্লাহর কাছে কতো চেয়ে একটা ভাই পেয়েছিলাম আমরা তাও নিয়ে নিলো। আমার বোন টিউশনি করে বাসা ভাড়া ও রাব্বিকে খরচ দিতো। বাবা ভ্যান চালিয়ে খাওয়ার খরচ দিতো। আর মা যখন টিউশনি করতো তখন সেই টাকা রাব্বির হাত খরচের জন্য পাঠাতো। এখন আব্বু আর ভ্যান চালাতে পারে না, মাও টিউশনি করে না। শুধু আমার ছোট বোনের টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার চলে। কবি নজরুল কলেজে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে ছোট বোন। আমাদের একটাই চাওয়া রাব্বি যেন শহীদি মর্যাদাটা পায়।

No comments

Powered by Blogger.