‘ছেলে এত লম্বা না হলে হয়তো গুলিটা মাথায় লাগত না, বেঁচে যেত’

সাবরিনা শাবন্তি ফেসবুকে মাহামুদুর রহমানের (সৈকত) প্রথম জন্মদিনের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘আজ ১১ সেপ্টেম্বর, টুনার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজকে আমার ভাইটার ২০ বছর হতো।’

সাবরিনা আফরোজ ফেসবুকে সাবরিনা শাবন্তি নামে পরিচিত। তিনি মাহামুদুর রহমানের বড় বোন। তিনি ও তাঁর বোন শাহরিনা আফরোজ তাঁদের আদরের একমাত্র ভাইকে টুনা, টুনাপোকা বলে ডাকতেন। এ নিয়ে ভাই অভিমানও করতেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মাহামুদুর রহমান।

মাহামুদুরের বড় বোন স্নাতকপড়ুয়া সাবরিনা আফরোজের সঙ্গে আজ বুধবার মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন থেকে কেক বানানো শিখেছি, তখন থেকে ভাইয়ের জন্মদিনের কেকটা আমি বানাতাম। ও কেকের জন্য বসে থাকত। কেক বানানোর আগেই বাটিতে লেগে থাকা চকলেট চেটে চেটে খেত। কিন্তু গত বছর ব্যস্ততার জন্য কেকটা বানাতে পারিনি। এক বাটি আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলাম। আজ খুব আফসোস হচ্ছে, গতবার কেকটা কেন বানালাম না। এই জীবনে হয়তো আমি আর কখনোই কেক বানাতে পারব না।’

সাবরিনা বলেন, ভাইয়ের জন্মদিন সেভাবে ঘটা করে আয়োজন করা হতো না। তবে পারিবারিকভাবে নিজেরাই ভাইয়ের জন্মদিন উদ্‌যাপন করতেন। বেশি করে চকলেট দেওয়া কেক তার পছন্দের ছিল। আর ঈদ বা অন্য সময়ও কিছু কেনার জন্য এক হাজার টাকা দিলে ৫০০ টাকা চেয়ে নিয়ে বলত, এটা তার জন্মদিনের গিফট। মারা যাওয়ার আগেও এবার তার জন্মদিনে কেমন কেক বানাব, তা জানতে চাইত।

আজ সাবরিনার কেক বানানোর কোনো আয়োজন নেই। জানালেন, ভাইয়ের জন্মদিনে তাঁদের কান্নাকাটি করা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই। একবার ভাইয়ের কবরে যাবেন। ভাইয়ের স্মৃতি হিসেবে তার রক্তমাখা পোশাকগুলোও হয়তো নেড়েচেড়ে দেখবেন।

সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছিলেন মাহামুদুর রহমান। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে এখন কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি।

১৯ জুলাই স্বজনেরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মাহামুদুরের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছিলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল ‘গান শট’।

মাহামুদুর রহমানের বাবা মাহাবুবের রহমান ও মা আফরোজা রহমান ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক হতে পারছেন না। নূরজাহান রোডে বাসার কাছেই ‘দই ঘর’ নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে মাহাবুবের রহমানের। ছেলে তাঁকে ব্যবসায় সহায়তা করতেন। দোকানে বসতেন। ১৯ জুলাই পারিবারিক কাজে মাহাবুবের রহমান চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। সেদিনও মাহামুদুর সকাল থেকে দোকান সামলান। দুপুরে জানতে পারেন তাঁর এক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে বাসায় গিয়ে মাকে সে কথা জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটের দিকে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

সাবরিনা আফরোজের মুঠোফোনে অনেকের কাছ থেকে পাওয়া ১৯ জুলাইয়ের ছোট ছোট কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ জমা হয়েছে। সেই ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী, মাহামুদুর বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটের দিকে মারা গেছেন। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মাহামুদুর রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ধরাধরি করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

সাবরিনা জানালেন, তাঁর ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা দোকানে গেলেও সেখানে বসেই কান্নাকাটি করতে থাকেন। দোকান থেকে ভাই যে জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, সেই জায়গায় গিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকেন।

১৯ জুলাই ৬৪ বছর বয়সী মাহাবুবের রহমান সন্দ্বীপ থেকে বারবার ছেলেকে ফোন করে খবর নিচ্ছিলেন। একসময় অচেনা একজন ছেলের ফোন ধরে মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছিলেন। ফোন ধরে বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলে মরে গেছে।’ এই খবর পেয়েই সন্দ্বীপ থেকে ঢাকায় রওনা দিয়েছিলেন তিনি। ছেলের ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে একসময় গর্ব করলেও ছেলের মাথায় গুলি লাগার পর এই বাবার মনে হয়েছে, ছেলে এত লম্বা না হলে হয়তো গুলিটা মাথায় লাগত না। শরীরের অন্য কোনো জায়গায় গুলিটা লাগলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।
মাহামুদুর রহমানের জন্মদিনে এমন কেক তৈরি করতেন বড় বোন সাবরিনা আফরোজ। এবার আর এসবের কিছু করছেন না

এ ঘটনা নিয়ে ২৮ জুলাই প্রথম আলো অনলাইনে ‘একজন ফোন ধরে বলল, আপনার ছেলে মরে গেছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।

হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে ছেলে মারা যাওয়ার পর প্রথম দিকে মাহাবুবের রহমান মামলা করতে চাননি। তবে আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় গত ২৫ আগস্ট এই বাবা বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ছেলের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করেছেন। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও পুলিশ সদস্যদের আসামি করা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত এ মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই জানিয়ে সাবরিনা আফরোজ বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আগামী শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) যে সভা হবে, সেখান থেকে যদি মামলাগুলো ত্বরান্বিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়, পরিবারগুলো কেমন আছে, তা জানার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ভালো হবে। তবে সভা যদি লোক দেখানো বা টাকা খরচের উপলক্ষ হিসেবে করা হয়, তা কখনোই মেনে নেওয়া যাবে না।

মাহামুদুর রহমান (সৈকত) গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন

No comments

Powered by Blogger.