পপুলিজম কী? by মাহমুদ ফেরদৌস

ডনাল্ড ট্রাম্প, জেরেমি করবিন ও রড্রিগো দুতের্তে। এ তিন নেতার মধ্যে মিল কী? অজস্র মতপার্থক্য সত্ত্বেও, এ তিন জনের প্রত্যেককেই ‘পপুলিস্ট’ বা জনতোষণবাদী বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
মূলত, ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন জয় ও ইউরোপে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর উত্থানের পর থেকেই ‘পপুলিজম’ বা জনতোষণবাদ শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছে। বলা হচ্ছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে জনতোষণবাদ জনপ্রিয় হচ্ছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প।
ইতালিতে ফাইভ স্টার মুভমেন্ট নামে একটি পপুলিস্ট দল ও অভিবাসন-বিরোধী ‘লীগ’ সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পেয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এ ঘরানার দলগুলো সাম্প্রতিককালে সাফল্য পেয়েছে।
কিন্তু ‘জনপ্রিয়’ (পপুলার) ও ‘জনতোষণবাদী’ (পপুলিস্ট) এই শব্দ দু’য়ের মধ্যে তফাৎ আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘পপুলিজম’ বলতে বোঝায়, সমাজ যখন ‘নিষ্কলুষ জনগণ’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত’- এই পরস্পরবিরোধী দু’টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয় তখন পপুলিজমের জন্ম নেয়। এমনটিই বললেন ‘পপুলিজম: অ্যা ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ বইয়ের লেখিকা কাস মাডে।
তবে পপুলিজম শব্দটি অনেক সময় রাজনৈতিক আক্রমণ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। বৃটেনের লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন যখন দলের শ্লোগান হিসেবে ‘ফর দ্য মেনি, নট দ্য ফিউ’ (অনেকের জন্য, গুটিকয়েকের জন্য নয়) ব্যবহার করেন, তখন তাকে পপুলিস্ট নেতার তকমা দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই এমন নয়।
‘দ্য গ্লোবাল রাইজ অব পপুলিজম’ বইয়ের লেখক অধ্যাপক বেঞ্জামিন মফিট লিখেছেন, ‘এই শব্দটির প্রায়ই ভুল ব্যবহার হয়, বিশেষ করে ইউরোপের প্রেক্ষিতে।’
প্রকৃত পপুলিস্ট একজন নেতা মূলত ‘জনগণের ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছা’র প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করে থাকেন। কোনো এক শত্রুর বিপক্ষে তিনি নিজেকে জনগণের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থায় প্রোথিত কোনো চক্র যেমন, ‘উদারপন্থী অভিজাত’দের হটানোর কথা বলেন। মফিট বলেন, ‘সাধারণত, এই শব্দটি ইউরোপিয়ান প্রেক্ষিতে ডানপন্থীদের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু এটিই অকাট্য নিয়ম নয়।’
রাজনৈতিক মতবাদের যেকোনো অংশেই থাকতে পারে পপুলিস্ট নেতারা। লাতিন আমেরিকায়, ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট শ্যাভেজকে বলা হতো পপুলিস্ট নেতা। স্পেনে পদেমোস দল ও গ্রিসে সিরিজিয়া দলকে পপুলিস্ট দল বলা হয়। এরা সবাই বাম ঘরানার।
কিন্তু অধ্যাপক মফেট বলেন, এখন সবচেয়ে সফল পপুলিস্টরা সবাই ডান, বিশেষ করে উগ্র ডান ঘরানার। তিনি বলেন, ফ্রান্সে মেরিন ল্য পেন, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওরবান ও যুক্তরাষ্ট্রে ডনাল্ড ট্রাম্প পপুলিজমের সঙ্গে অভিবাসন বিরোধিতা, স্বজাত্যবাদ ও কর্তৃত্ববাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যবেক্ষকরা ডানপন্থী পপুলিজমের উত্থান নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি একেবারেই নতুন কোনো বিষয় নয়।
অধ্যাপক মফেট বলেন, গত ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, এখন পপুলিজমের বিস্তার ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বহুসংস্কৃতিবাদ ও বিশ্বায়নের মতো সামাজিক পরিবর্তন ও বিভিন্ন সংকটকে ইউরোপে পপুলিস্ট দলগুলোর উত্থানের জন্য দায়ী করেন। কিন্তু ইউরোপিয়ান কনসোর্টিয়াম অব পলিটিক্যাল রিসার্চের পরিচালক মার্টিন বুল বলেন, ইউরোপে পপুলিস্ট দলগুলোর উত্থান হয়েছে এই শতাব্দির শুরুর দিক থেকে। তবে তখন বেশ ক’ বছর তারা স্বল্প আকারে ছিল। তাদের সমর্থন ফুলে ফেঁপে উঠে সম্ভবত ২০০৮ সাল থেকে। বিশেষ করে ২০১১ সাল থেকে এই উত্থান প্রকট আকার ধারণ করে। তখন ইউরোপের ব্যাংকিং সংকট ধীরে ধীরে স্বার্বভৌম ঋণ সংকটে রূপ নেয়।
এই সংকটের জন্য ধন্যাঢ্য ব্যাংকাররা দায়ী বলে কমবেশী শনাক্ত করা হয়। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে এমন একটি সংকটের জন্য একটি বিশেষ অভিজাত গোষ্ঠীকে দায়ী করার এমন ঘটনা বেশ বিরল।
নিজের বই ‘দ্য গ্লোবাল রাইজ অব পপুলিজমে’ অধ্যাপক মফিট যুক্তি দেখিয়েছেন যে, গড়পড়তা একজন পপুলিস্ট নেতার আরও অনেক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন, তাদের আচার আচরণ খুব সুবিধার থাকে না। গড়পড়তা রাজনীতিকের মতো তারা আচরণ করেন না। রাজনৈতিক সুলভ আচরণ না করার কৌশল প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প ও ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে। পপুলিস্ট নেতাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো সংকটকালীন সময়কে জিইয়ে রাখা। এরা সবসময়ই যুদ্ধংদেহী অবস্থায় থাকেন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাদিয়া আরবিনাতি বলেন, ‘কোনো পপুলিস্ট নেতা যদি ক্ষমতায় যান, তাহলে তাকে সার্বক্ষণিকভাবে জনগণকে বোঝাতে হয় যে, তিনি ‘শাসন ব্যবস্থা’ বা এস্টাবলিশমেন্টের অংশ নন ও হবেনও না।’ তিনি যুক্তি দেখান, পপুলিস্ট ধ্যানধারণার আকার দেওয়া হয় নেতিবাচকতার ভিত্তিতে। সেটি হতে পারে, রাজনীতি-বিরোধীতা, বা বুদ্ধিবৃত্তি বা অভিজাত-বিরোধীতার আঙ্গিকে। পপুলিজমের এই একটি বড় শক্তি। এটি বিভিন্ন ধাঁচের হতে পারে। অধ্যাপক নাদিয়া বলেন, পপুলিজম ভীষণ শক্তিশালী একটি ধারণা, কারণ এটি সব ধরণের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
অধ্যাপক বুল বলেন, পপুলিস্ট নেতাদের আরেকটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো, তারা আধুনিক সরকারব্যবস্থার ‘জটিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’কে অপছন্দ করেন। এ কারণে পপুলিজমের সঙ্গে স্বৈরতন্ত্রের এক ধরণের সংশ্লেষ আছে। পপুলিজম মানেই প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাসহীনতাকে নির্দেশ করে, যার ফলে ‘স্ট্রংম্যান’ ঘরানার নেতার প্রয়োজন হয়।
অধ্যাপক বুল বলেন, ‘এ ধরণের নেতারা এমনভাবে সিদ্ধান্ত নেন, যেটি প্রচলিত গণতন্ত্রে নেওয়া সম্ভব হতো না।’ এই বক্তব্য সম্ভবত বেশি প্রযোজ্য ভেনেজুয়েলার বাম-ঘরানার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের ব্যাপারে। তিনি একসময় বলেছিলেন, ‘আমি কোনো ব্যক্তিবিশেষ নই। আমিই জনগণ।’
অধ্যাপক মফিট বলেন, এই ধরণের একনায়কসুলভ কথাবার্তা মানুষের মধ্যে এক ধরণের ধারণা জন্মায় যে, এই নেতা বুঝি অমোঘ। তাদেরকে কোনো অবস্থাতেই লঙ্ঘন করা যাবে না। ফলস্বরূপ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুনভাবে ও বেশ ভীতিকরভাবে আবর্তিত হয়। কারণ, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায় যে, আপনি যদি ‘জনগণ’ না হন, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আমাদের বিরুদ্ধে।
এ কারণেই পপুলিস্ট নেতাদেরকে প্রায়ই সংশয়ের চোখে দেখা হয়। যেসব নেতা জনগণকে বেশি প্রতিশ্রুতি দেন তাদেরকে অনেকটাই পপুলিস্ট হিসেবে আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করা হয়। অধ্যাপক বুল বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সমর্থন পাওয়ার জন্য এ ধরণের নেতারা খুব দ্রুতই প্রতিশ্রুতি দেন। যেটা হয়তো গড়পড়তা রাজনৈতিক দলের নেতারা পারেন না। পপুলিস্ট নেতারা সব পাল্টানোর প্রতিশ্রুতি দেন, যেটি কিনা বাস্তবে করা সম্ভব নয়।’ তিনি যোগ করেন, ‘এ কারণেই আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, পপুলিজম গণতন্ত্রের জন্য কতটা উপকারী।’
(বিবিসি অবলম্বনে)

No comments

Powered by Blogger.