গাজীপুরের বনাঞ্চলে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য by ইকবাল আহমদ সরকার

যৌন ব্যবসা, মাদক, জুয়া, দখল, বনজ সম্পদ নিধনসহ নানা ধরনের অপরাধীরা গাজীপুরের এলাকার বনাঞ্চলকে অপরাধের স্বর্গরাজ্য করে তুলেছে। মাঝে মাঝে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েও অপরাধীচক্রকে কোনোভাবেই দমন করতে পারছেন না। সন্ধ্যায় জুয়ার আসরে আগুন ধরায় তো রাতেই আবার চালু হয়। কোথাও কোথাও মাঠে নেমে রহস্যজনক কারণে বন অপরাধীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন বনকর্মকর্তাগণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের কোনো কোনো রিসোর্ট বা শুটিং স্পটে যৌনকর্মীদের রেখে ঘণ্টা হিসেবে ব্যবসা চলছে। এরই মাঝে বিগত সময়ে সিটি করপোরেশন, সদর উপজেলা ও কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন রিসোর্ট শুটিং স্পট থেকে মাদকদ্রব্যসহ যৌনকর্মী ও খদ্দের আটক করা হয়েছে। এরপরও বন্ধ হয়নি এসব। বরং, বনের ভিতর অবৈধভাবে আবাসিক হোটেল খুলে এই অবৈধ ব্যবসা শুরু হয়েছে। তেমনি একটি হোটেলে গত শনিবার অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের নির্দেশনায় শনিবার বিকালে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা এলাকায় শালবনের ভেতর অবৈধভাবে স্থাপিত বন্ধু আবাসিক হোটেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় আটককৃত ৭ নারী এবং ২ জন পুরুষকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বি এম কুদরত-এ-খুদা, মো. রাসেল মিয়া এবং মো. জুবের আলম। বনাঞ্চলকে ঘিরে এবং বনের ভেতরে প্যান্ডেল বসিয়ে জুয়া আর অশালীন নৃত্যের আসর চলছে বছরের পর বছর। জুয়ার আসরে বিশৃঙ্খলার পর পালাতে গিয়ে গর্তে পড়ে দুজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কয়েকবার জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব আসরে অভিযান চালিয়ে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পরও থেমে থাকেনি জুয়াড়িরা। এমনও হয়েছে, সন্ধ্যায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর আবার রাতেই চলেছে জুয়ার আসর। সর্বশেষ গত শনিবার রাজেন্দ্রপুর এলাকায় জুয়ার আসরে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত জুয়ার আসরে ব্যবহৃত স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদ করে আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে বন বিভাগের জমিতে কিভাবে এসব অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে বছরের পর বছর। জেলা প্রশাসকের ফেসবুক স্ট্যাটাসে গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি উল্লেখ করা হয়েছে, শালবনের পাশেই মনোরম পরিবেশে অনেকটা গল্প-উপন্যাস থেকে উঠে আসা ভাওয়াল গাজীপুরা গ্রাম। গ্রামটি গল্প উপন্যাসের মতো আদর্শ সুন্দর হলেও গ্রামের মানুষ কিছু দুষ্টু লোকের বুদ্ধিতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়েছিল। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের নির্দেশক্রমে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে তিতাস গ্যাস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ ২৮শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় গ্রামটিতে পৌঁছলে এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামটি হয়ে পড়ে জনমানবহীন। অনেকটা ভোজবাজির মতো অথবা বিখ্যাত কোনো জাদুকরের জাদুর কাঠির ছোঁয়াতে সব উধাও। অনেকে বাসাবাড়ি খোলা রেখেই উধাও, অনেকের চুলার আধা ভাজা বেগুন রেখে উধাও, উপচে পড়া আধা সেদ্ধ ভাতের হাঁড়ি রেখে, তালা দিয়ে উধাও, তালা না দিয়ে উধাও! পরে বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইশতিয়াক আহমেদ ৪ জন আবাসিক অবৈধ ব্যবহারকারীকে ৬ হাজার করে ও বাণিজ্যিক অবৈধ ব্যবহারকারী ঠঋঝ ঞঐজঊঅউ উণঊওঘএ খঞউ. কে ১ লাখ টাকাসহ সর্বমোট ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
মাত্র মাস খানেক আগে গাজীপুরের গভীর গজারি বনে অভিযান চালিয়ে দেশীয় চোলাই মদ তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেছেন র‌্যাব সদস্যরা। এ সময় ৪ শতাধিক ড্রামে ভর্তি প্রায় ১০ হাজার লিটার চোলাই মদ ও মদ তৈরির কাঁচামাল ও সরঞ্জমাদিসহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত একজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও অপরজনকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। গাজীপুরের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরিফুল ইসলাম মাদকবিরোধী এ টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা করেন।
কুমারখাদা এলাকার গভীর গজারি বনে একটি চক্র চোলাই মদের কারখানা গড়ে তুলে। এসব কারখানায় চোলাই মদ তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করে আসছিল তারা। চোলাই মদ উৎপাদন ও বাজারজাত করার অপরাধে কুমারখাদা এলাকার সুনন বর্মন ও সুদেব বর্মনকে গ্রেফতার করা হয়। ভাওয়ালের বনাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় শিল্পকারখানা, বাসাবাড়ি, বাগানবাড়ি, বিনোদনস্পটসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করে সরকারি বনবিভাগের হাজার হাজার একর জমি এরই মাঝে বেদখল হয়েছে। এই বেদখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। শ্রীপুরের তেমনি একটি বিনোদন কেন্দ্র ‘ড্রিম স্কয়ার’-এর অবৈধ দখলে থাকা প্রায় ৩ কোটি টাকা দামের প্রায় ২ বিঘা পরিমাণের সরকারি জমি দখলমুক্তকরণ প্রক্রিয়া গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি শুরু করেছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সোহেল রানা জানান, প্রাথমিক অবস্থায় সরকারি ভূমি চিহ্নিত করে তার ওপর লাল নিশানা টানানো হয়েছে। এখন অবৈধ দখলদাররা যদি নিজ দায়িত্বে তাদের সীমানা প্রাচীর ভেঙে সরকারি জমির দখল ছেড়ে না দেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অন্যদিকে, কাঠ কেটে এবং নানাভাবে অনেক এলাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস করেও বনবিভাগের জমি বেদখল হয়েছে। লুটপাট হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ। আবার গাছ কেটে কাঠ চুরিতে অনেক সময় বিপত্তি হওয়ায় চোর চক্র বেছে নেয় ভিন্ন পন্থা। বনাঞ্চলে গাছ পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে তা বিক্রির পথ বেছে নেয় এক শ্রেণির অপরাধী চক্র। তেমনি চক্রের কয়লা বানানোর ৩৮টি কারখানা ধরা পড়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কারখানাগুলো শনাক্ত করে সেদিনে জেলার কালিয়াকৈরের কুতুুবদিয়া এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামের নেতৃতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালানো হয়। এ সময় কারখানাগুলো ভেকু দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে জব্দ করা হয় ৮০০ মণ কাঠ, ৭০ হাজার ইট, ৩০ বস্তা কয়লাসহ বিভিন্ন মাল। পরে জব্দ করা মালগুলো নিলামে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। গত মাসের শেষ দিকে শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা বিট কর্মকর্তা সিদ্দিকুল ইসলাম বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় পেলাইদ এলাকার জব্বার মৃধার নামে থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, বনবিভাগের সৃজিত বাগান কেটে জমি দখল করছে। যাতে এক কোটি টাকার অধিক মূল্যের বনজ সম্পদ বেহাত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাধা দিলে সন্ত্রাসী কায়দায় বনবিভাগের লোকজনের ওপর হামলা চালানো হয়।

No comments

Powered by Blogger.