ত্রিভুজ প্রেমের বলি কলেজছাত্র রনক

ত্রিভুজ প্রেমের বলি কলেজছাত্র মো. রনক (১৮)। প্রেমিকা লিজা আক্তার ওরফে মাইশা আলমের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন। তারপর তুহু নামের অপর এক প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলা। তুহুকে ভালোবাসে অপর এক তরুণ। ওই তরুণ তা মেনে নিতে পারে নি। এই নিয়ে রনকের সঙ্গে কয়েকবার বাগবিতণ্ডায় জড়ায়। দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। তারপর রনকের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করে। একত্র করে বন্ধু-বান্ধবদের। বেছে নেয় গত ১লা মার্চ শাঁখারীবাজারে জনাকীর্ণ হোলি উৎসব। সম্পর্ক ছিন্ন করায় রনকের ওপর ক্ষুব্ধ প্রেমিকা মাইশার মাধ্যমে সেখানে তাকে ডেকে নেয়। হোলি উৎসবের কিছুটা আড়ালে নিয়ে ওই দিন সকালে সেই যুবকের ১০-১৫ জন বন্ধু মিলে গায়ে পড়ে তার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধায়। এরপর এলোপাতাড়ি কিলঘুষি। ঊরুতে ছুরিকাঘাত করে ওই তরুণের সহযোগী রিয়াজ আলম ওরফে ফারহান ও অপর একজন। এতে রক্তক্ষরণে ওই দিন দুপুরে মারা যায় রনক। হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৫ সহযোগী সোমবার গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি ওই তরুণ। গ্রেপ্তারকৃত ৫ জনের ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত গতকাল প্রত্যেকের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৫ আসামির প্রাথমিক স্বীকারোক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানের বক্তব্য ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা যায়। গতকাল সকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিসি সাংবাদিকদের তা বলেন। এই ঘটনায় গত সোমবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- ওই তরুণের সহযোগী ছুরিকাঘাতকারী রিয়াজ আলম ওরফে ফারহান (১৯), কবি নজরুল কলেজের ছাত্র ফাহিম আহম্মেদ ওরফে আব্রো (১৯), ফলের দোকানি মো. ইয়াসিন আলী (১৮), কয়েল বিক্রেতা আল আমিন ওরফে ফারাবী খান (১৮) এবং নিহত রনকের কিছু দিনের প্রেমিকা লিজা আক্তার ওরফে মাইশা আলম।
গ্রেপ্তারকৃতদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডিএমপি লালবাগ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান বলেন, এইচএসসি পড়ুয়া মাইশার সঙ্গে ইতিপূর্বে কিছুদিন প্রেম ছিল আজিমপুর নিউ পল্টন লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী রনকের। তিনি ওই সম্পর্ক ছিন্ন করে তুহু নামে অপর এক তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। তুহুর সঙ্গে আবার আরেক তরুণের প্রেম ছিল। ওই তরুণ এ বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে রনককে ফেসবুকে ও মুখোমুখি কয়েকবার হুমকি দেয়। শেষ পর্যন্ত তাকে দেখে নেয়ার পরিকল্পনা করে বেছে নেয় হোলি উৎসবকে। ওই তরুণ আবার রনকের মাইশার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানতো। সম্পর্ক ছিন্ন করায় রনকের ওপর মাইশারও ক্ষোভ ছিল। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ব্যবহার করে মাইশাকে। মাইশা ওই যুবকের কথা মতো রনককে মোবাইল করে হোলি উৎসবে আসতে বলে। তবে মাইশা তার সঙ্গে মারামারি হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানলেও তা যে হত্যাকাণ্ডে রূপ নেবে তা জানতো না বলে জানায়। তবে ঘটনার সময় ঢাকার বাইরে গ্রামের বাড়িতে থাকায় রনকের প্রেমিকা তহু এতসব ঘটনা জানতো না বলে জানা গেছে। এদিকে ওই তরুণ ২৫ থেকে ৩০ জন ফেসবুক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডার পর রনকের ওপর প্রতিশোধ নিতে সবাই মিলে হোলি উৎসবে যায়। তারা ঘটনার আধ ঘণ্টা আগে লক্ষ্মীবাজারের কেএফসির সামনে একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে। সংগ্রহ করা চারটি ছুরি চারজনে মিলে ভাগ করে নেয়।
এদিকে রনক তার আট বন্ধুকে নিয়ে দুই রিকশায় চেপে হোলি উৎসবে যায়। রনকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাকে একদিকে ডেকে নিয়ে যায় প্রতিশোধ স্পৃহায় থাকা ওই যুবকরা। এরপর শনি মন্দিরের দিকে কিছুটা নির্জন স্থানে নিয়ে তার সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে গায়ে পড়ে বাগবিতণ্ডা শুরু করে ঝগড়া বাঁধায়। এরপর ১০ থেকে ১৫ জন মিলে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মারতে থাকে। এর মধ্যে কয়েকজন ছিল অতি উৎসাহী। একপর্যায়ে উরুতে ছুরি মারে ফারহান। এরপর তাকে ফেলে তারা চলে যায়। পরে রনকের বন্ধুরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। ওই দিন দুপুরের দিকে ঢামেক হাসপাতালে পৌঁছার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ওই দিনই রনকের মা হেনা বেগম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
গ্রেপ্তারকৃত ফারহান মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার কাশমহল বালুচর এলাকার পাইনার চরের এনায়েত আলমের, আব্রো শ্রীনগর থানার আল আমিন বাজারের (বাগ্রা বাজার) হারুন অর রশিদ ও ইয়াসিন আলী টংগীবাড়ী থানার আয়রন বাজার মোল্লাবাড়ির মো. সেলিমের পুত্র। আর আল আমিন ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার সাবান ফ্যাক্টরি ইমাম বাড়ির শওকত আলীর পুত্র। নিহত রওনকের এক সময়ের প্রেমিকা মাইশা আলম টাঙ্গাইল জেলার টাঙ্গাইল থানার মধুপুর এলাকার মো. শাহজাহান সাজের মেয়ে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানে আলম মুনশী মানবজমিনকে বলেন, অন্তত ২৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ঘটনার রহস্য উন্মোচন হতে থাকে। ত্রিভুজ প্রেমের বলি হলো রনক। তার প্রেমিকা তহুর অপর প্রেমিক ও তার বন্ধুরা প্রতিশোধ গ্রহণ ও প্রয়োজনে মারামারি করার জন্য ছুরিসহ প্রস্তুতি নিয়ে আসে। মারামারিতে ১০ থেকে ১৫ জন অংশ নেয়। তবে চার পাঁচজন অতি উৎসাহী বেশি মারধর করে। দু’জন ছুরি দিয়ে দু’টি আঘাত করে। তাদের একজন ফারহান গ্রেপ্তার হয়েছে। তার হাতে থাকা ছুরিটিও উদ্ধার হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আসামিদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বাকিদের বিষয়েও জানা যাবে। তিনি মূল হোতা তহুর প্রেমিকসহ বাকিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার সম্ভব হবে বলে জানান।

No comments

Powered by Blogger.