মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই কৃতিত্ব শুরু হয়েছিল যার

বাংলাদেশের ইতিহাসে যে ঐতিহাসিক ঘটনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে তা হচ্ছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং মানচিত্র পেয়েছি। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে এনেছে এ স্বাধীনতা। আমাদের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই চিরবিদায় নিয়ে এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যিনি তার লেখা, বক্তব্য এবং সাক্ষাৎকার দিয়ে আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরজাগ্রত রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার শাহ্রাস্তি উপজেলার নাওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ গ্রামের নাওড়া স্কুল, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায়, গোপালগঞ্জ মডেল স্কুল, পালং (বর্তমান শরীয়তপুর), কুমিল্লার চান্দিনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লেখাপড়া করেন এবং ১৯৫৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্সে পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ‘ইউপিপি’ সংবাদ সংস্থায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেয়ার পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। পরে তাকে আর্টিলারি কোরে নেয়া হয়।
১৯৬৮ সালে তিনি লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তার ইউনিট ‘২৪ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট’সহ যশোর ক্যান্টনমেন্ট আসেন এবং রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্টের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ডেপুটেশনে দিনাজপুরে ৮ উইং ইপিআরের অ্যাসিস্ট্যান্ট উইং কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চট্টগ্রাম হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ৮.৪০ মিনিটে তিনি তার অধীনস্থ ইপিআরের বাঙালি সৈনিক ও জেসিওদের নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং রাত ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে পুরো চট্টগ্রাম শহর দখল করতে সক্ষম হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ৫টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ১নং সেক্টরটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। মেজর রফিক চট্টগ্রামের রেলওয়ে পাহাড়ে ‘ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার’ স্থাপন করেন এবং বীরত্বের সঙ্গে পুরো ১নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রাম এলাকার ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর ১৩০০ জন বাঙালি সৈন্য নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হন। এদের প্রায় ৫০০ বাঙালি সৈনিক চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর হেডকোয়ার্টারে এবং ৮০০ বাঙালি সৈনিক সীমান্ত এলাকাগুলোয় কর্মরত ছিল। যুদ্ধের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি চট্টগ্রামে বহুবার রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনীর কয়েকজন বাঙালি সদস্যের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেন। হালিশহরে ইপিআর সৈনিকরা যুদ্ধ শুরুর এক মাস আগে চাইনিজ রাইফেল লাভ করে যা তাদেরকে পাকিস্তান সরকার দিয়েছিল বহু পুরনো ৩০৩ রাইফেল প্রতিস্থাপন করার জন্য। ফলে যুদ্ধ শুরু হলে ইপিআর সৈনিকদের হাতে ৩০৩ রাইফেল ও সমসংখ্যক চাইনিজ রাইফেল মিলে অস্ত্র ও গোলাবারুদে সংখ্যা ও পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। যুদ্ধকালীন তিনি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং, মেডিকেল কলেজ, নৌবাহিনী স্থাপনা, ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রামগড় ও বেলুনিয়া এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি ১০ জুলাই ১৯৭১ আগরতলা থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করেন সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য। সম্মেলন ১১-১৭ জুলাই পর্যন্ত চলে। সব সেক্টর কমান্ডার তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন।
সেই সম্মেলনে সম্মিলিত কাজের ধারা স্থির করা হয়। ১৫ জুলাই ১৯৭১ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সব সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডার দেখা করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ সময় কে ফোর্স, এস ফোর্স এবং জেড ফোর্স সংগঠিত করা হয় (তৎকালীন সামরিক বাহিনীতে বাঙালি সদস্যদের নিয়ে)। ওই সম্মেলনে সব সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ, যুদ্ধের রণকৌশল এবং সব সেক্টরের মধ্যে সমন্বয়ের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। ১০ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম এলাকায়। ৬০ জন নৌ-কমান্ডো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে কর্ণফুলী নদীর তীরে পাকিস্তানি জাহাজগুলোয় আক্রমণ পরিচালনা করে এবং ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়। মেজর রফিক তার সৈন্যদের দিয়ে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই একে একে এক নম্বর সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী নিরাপত্তা বেষ্টনী ক্রমান্বয়ে ভেঙে দিতে থাকেন। ১৩ এবং ১৪ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড ও কুমিরা এলাকা শত্র“মুক্ত করেন। ১৬ ডিসেম্বর যখন দেশ স্বাধীন হয়, তখনও চট্টগ্রাম ভাটিয়ারি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মেজর রফিক এবং তার মুক্তিপাগল সৈনিকরা যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। তাদের সঙ্গে অবশ্য ডিসেম্বরের ৩ তারিখ থেকে ভারতের দুটি ব্রিগেড সমন্বয় করে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য তাকে জীবিত ব্যক্তিবর্গের সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীর উত্তম’-এ ভূষিত করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুকাল তিনি চট্টগ্রামে সে সময়কার বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য পিপলস ভিউ’র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান হয়ে ১৯৮১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর হ্যান্ডলুম বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের প্রথম নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা (মন্ত্রীর পদমর্যাদা) হিসেবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়- এই দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৯১ সালে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা-২৬৪, চাঁদপুর-৫ থেকে সপ্তম জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আবার চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা-২৬৪, চাঁদপুর-৫ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং নবম জাতীয় সংসদে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হন এবং ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়’ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের পিতা (মরহুম) আশরাফ উল্লাহ ঢাকা জেলার ‘ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন অফিসার’ ছিলেন। তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। মাতা (মরহুমা) রহিমা বেগম চাঁদপুর জেলার সদর উপজেলার সক্দি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রয়াত স্ত্রী রুবি ইসলাম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার এক রক্ষণশীল ও সুপরিচিত পরিবারের সন্তান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত তার মূল গ্রন্থ ‘এ টেল অব মিলিয়নস্’ বইটি ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ সালে ‘এ টেল অব মিলিয়নস্’ বইটি পরিবর্ধিত আকারে এবং বইটির বাংলা অনুবাদ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ একই সময় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার করুণ ও বেদনাময় কাহিনী নিয়ে রচিত তার আরেকটি বই ‘মুক্তির সোপানতলে’ প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের জুলাইয়ে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সমকালীন বিষয়াদির ওপর তার বেশকিছু লেখা প্রকাশিত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিক শুধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নয়, পরবর্তীকালে সব সরকারি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অংশ নিয়ে দেশ এবং দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিঃস্বার্থভাবে পালন করেন যা ছিল দৃষ্টান্তমূলক। দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করা একটি বিরাট গৌরব এবং প্রশান্তির ব্যাপার, যা মেজর রফিক তার যৌবনে বীরত্বের সঙ্গে পালন করেছেন। দেশের সেই ক্রান্তিলগ্নে সামরিক, আধা সামরিক এবং বেসামরিক মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে দেশের জন্য বিজয় বয়ে আনতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকের অবদান কোনোদিন ভুলবে না।
রায়হানুল ইসলাম : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.