উভয় পক্ষই অশান্তির দাবানলে জ্বলছে! by মো: মনিরুজ্জামান মনির

ব্রিটিশ হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল অ্যাক্ট-১৯০০ মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের সত্তা, নিজস্বতা, স্থিতিশীলতা ও প্রথাগত রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল। দেশের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যারা উপজাতি কিংবা বাঙালি অথবা অন্য ধর্মের বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তাদের দেখভাল করাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশেষ দায়িত্ব। বাস্তবেও সেটা করা হচ্ছে, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে দু-চারটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ব্যত্যয় ঘটেছে। বাঙালি বীরের জাতি। ’৭১ সালে বর্বর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বীর মুক্তিসেনারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছেন। অথচ এখন কিছু লোক বাংলাদেশের মানচিত্রকে খামচে ধরতে চায়, দেশের এক দশমাংশ ছিনিয়ে নিতে চায়, ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের দামে কেনা বাংলাদেশের এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রামকে চায় আলাদা করতে। যাদের আমরা বিশ্বাস করি, যাদের আমরা নিরীহ সরলপ্রাণ সহজ সরল (আদিবাসী) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে সম্মান করি, তাদের নেতাদের একাংশের এ কী রূপ? পার্বত্যাঞ্চলে কেন বারবার বন্দুকযুদ্ধ? অথচ হতদরিদ্র বাংলাদেশের সরকার অজস্র সমস্যার মাঝেও পাহাড়ের উন্নয়নে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। বঙ্গবন্ধুর ‘তোরা সব বাঙালি হয়ে যা’ উক্তি ঘোষণার পেছনে সন্তানসম জনগণের প্রতি ভালোবাসাই ছিল মূল কথা। কিন্তু এম এন লারমারা তা বুঝলেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে দীঘিনালায় শান্তিবাহিনীর হামলায় শতাধিক বাঙালি হত্যার ঘটনায় দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। যখন জানতে পারলেন, পাহাড়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আড়ালে হাজার হাজার উপজাতি যুবককে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, জুম্মল্যান্ডের ছবক পাচ্ছে তারা, বাংলাদেশের মানচিত্রের বিরুদ্ধে উপজাতীয় নতুন প্রজন্মকে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে, তখনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পাহাড়ে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছিল। এরপর তিন দশক ধরে কথিত শান্তিবাহিনীর নির্যাতন, সন্ত্রাস, গেরিলা যুদ্ধের নামে বাঙালি হত্যা চলছিল, অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ছিল। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা হয়। ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যাকে কেউ কেউ বলেন, ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি। বাঙালি স্বার্থবিরোধী, বৈষম্যমূলক, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, এর বিভিন্ন ধারা-উপধারা বাতিলের দাবিতে পার্বত্যবাসী বাঙালিরা এটাকে বলেছেন ‘পার্বত্য কালোচুক্তি’। অবশ্য সরকার (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বিশেষে) সব বাধা ও সমালোচনা উপেক্ষা করে পাহাড়ি জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে ধাপে ধাপে শান্তিচুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছে সেটাও পছন্দ হচ্ছে না। দুই দশক আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পাহাড়ে বন্দুকযুদ্ধ, জেএসএস বনাম ইউপিডিএফ আধিপত্যের লড়াই (এটা ‘জুম্মজাতি’র কল্যাণের লড়াই নয়), চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা, ডিসি, এসপি, ইউএনওদের হেনস্তা ইত্যাদি বন্ধ হয়নি। শান্তিচুক্তির মূল কনসেপ্ট ছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সব অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়া এবং বাংলাদেশের সংবিধানকে মেনে চলা।
কিন্তু সেই শর্ত সন্তু লারমারা বারবার শুধু লঙ্ঘনই করে চলছেন না, দেশ-বিদেশে লবিস্ট পাঠিয়ে এবং হীন প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ দিকে, সরকার একের পর এক শান্তিচুক্তির শর্ত পূরণ করে চলছে। তবু শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন করে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ বাঙালি হত্যায় লিপ্ত হচ্ছে কেন?বিগত তিন যুগে সন্তু লারমারা বারবার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও দেশী-বিদেশী কোনো মানবাধিকার সংস্থাই এর বিরুদ্ধে কথা বলেনি। বরং বাঙালিবিদ্বেষী, সেনাবিদ্বেষী, সরকারবিরোধী ন্যূনতম গন্ধ পেলেও সেগুলোকে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। মূলত এ জন্য সরকার ও বাঙালিদের নীরবতাই দায়ী। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘লাইফ ইজ নট আওয়ার্স’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট লিখে একতরফা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ও সেনাবাহিনীকে হেয় করেছিল, যদিও পরে এর ৯০ ভাগই বানোয়াট প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্যবাসী বাঙালিরা একেবারেই কোণঠাসা। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেএসএস ও ইউপিডিএফের একক আধিপত্য বজায় থাকাতে বাঙালিরা মূলত তাদের হাতে জিম্মি। তবে জেএসএস ও ইউপিডিএফের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা পুলিশ, বিজিবি, আনসারদের ‘বাগে আনতে’ পারলেও সেনাবাহিনীর অভিযানকে ভয় পায়। কারণ, অপারেশনের আগেই যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অ্যামবুশের মাধ্যমে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ঘেরাও দিয়ে ন্যূনতম রক্তপাত ও ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পাহাড়ি ক্যাডারদের ধরা হয়ে থাকে। এ থেকে বাঁচার জন্য উপজাতীয় নারীদের ব্যবহার করা তাদের একটি পুরনো কৌশল, যা খুবই কার্যকর। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে সন্তু লারমার সুপারিশে রাঙামাটির বিতর্কিত মহিলা নিরূপা দেওয়ানকে সদস্য করা হয়েছিল। বর্তমানে আরো বেশি বিতর্কিত ও বাঙালিবিদ্বেষী বাঞ্ছিতা চাকমাকে সদস্য বানিয়ে পাহাড়ে বাঙালি ও সেনাবাহিনীকে হেয় করতে ওই দুই নারীকে ব্যবহার করার অভিযোগ এসেছে। জেএসএস ও ইউপিডিএফ নেতাদের একান্ত বিশ্বস্ত বলেই তারা ওই পদে গেছেন বলে মনে করা যায়।সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল থেকে দুই উপজাতীয় তরুণীকে (তারা মারমা সহোদরা) মাসব্যাপী সুস্থাবস্থায় বেডে থাকার পর নিজ নিজ অভিভাবকের জিম্মায় হস্তান্তর করা হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় তাদের ওপর ধর্ষণ বা নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানানো হয়েছে। রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে ওই দুই তরুণীর আবাস। সেখানে চার-পাঁচটি ঘর থেকে অ্যাম্বুশ করে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা জেএসএস ও ইউপিডিএফ ক্যাডারদের হাতেনাতে অস্ত্রশস্ত্রসহ আটক করেছিল। এ সময় ভয়ে চিৎকার করেছিল ওই তরুণীরা এবং এরপর তিন-চার দিন তারা নিখোঁজ ছিল। পরে জেএসএস, ইউপিডিএফ, হিল ওম্যান ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ দুই তরুণীকে দিয়ে ‘ধর্ষণের নাটক’ সাজায় বলে অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য প্রশাসনের ত্বরিত পদক্ষেপের ফলে বিভ্রান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেছে। চাকমা চিফ দেবাশিস্ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়েন ইয়েনকেও এতে জড়ানো হয়েছে। তাকে নাকি নিরাপত্তাবাহিনী নির্যাতন করেছে, যা জেলার পুলিশ সুপার অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, ওই পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় উপজাতীয়দের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত এবং তারা তার প্রতি আস্থাশীল।
রাঙ্গামাটিতে আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল, যার সুনাম সর্বত্র। বাঙালি ও উপজাতি নেতৃত্বের সমন্বয়ে জেলা আওয়ামী লীগকে সাজানো হলেও সন্তু বাবুদের তা পছন্দ নয়। তারা প্রায়ই জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে থাকেন। বিগত নির্বাচনে দীপঙ্কর তালুকদার শহরে বিপুল ভোটে জিতলেও দুর্গম এলাকায় সশস্ত্র জেএসএস ও ইউপিডিএফ ক্যাডাররা উষাতন তালুকদারের পক্ষে কাজ করেছিল, ফলে নৌকা মার্কার বিজয় ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। এরপর রাঙ্গামাটি কলেজ শাখা ছাত্রলীগকে ‘উপজাতি সদস্যমুক্ত’ করতে একাধিকবার প্রয়াস চলে। বিলাইছড়িতে একাধিক আওয়ামী নেতাকে হতাহত এবং রাঙ্গামাটি শহরে আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ঝর্ণা চাকমাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেও সন্ত্রাসীরা শান্ত হয়নি। রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি জেলা ছাত্রলীগ নেতা দীপায়ন চাকমাকে জেএসএস ‘পাছা’ পরিষদের উপজাতি যুবকেরা গুরুতর আহত করে বলে জানা যায়। এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগের ডাকে হরতাল পালিত হয়। রাঙ্গামাটিতে প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব বাঙালিদের বিস্মিত করেছে। রাঙ্গামাটির বড় পুলিশ কর্মকর্তার সাহসী ভূমিকার জন্য শহর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে এবার রক্ষা পেয়েছে। আশার কথা ওই পুলিশ অফিসারই বলেছেন, রাঙ্গামাটি হাসপাতাল থেকে স্বেচ্ছায় উপজাতি দুই তরুণীকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে এবং চাকমা রানীকে কেউ আক্রমণ করেনি। রাঙ্গামাটিতে যেসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক। চাকমা চিফ কিংবা তার স্ত্রীকে সবাই ভালোবাসে। তারা বিশেষ কোনো সংগঠনের সম্পদ নন। ‘কল্পনা ড্রামা’য় তাদের ব্যবহার করা দুঃখজনক। গৌতম দেওয়ানদের মতো নেতারাও যখন এতে সম্পৃক্ত হন, তখন আমাদের খুবই কষ্ট হয়। যিনি একদা সন্তু লারমাকে তুলোধুনা করতেন, শান্তিবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, রাঙ্গামাটির মেয়র ছিলেন, জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান হয়ে কিলিং লিস্টের ১ নম্বর সদস্য ছিলেন; তিনি আজ এভাবে পাল্টে গেলেন কেন? আমরা আশা করি, শান্তিচুক্তির উভয়পক্ষই সহনশীল হবে। কেননা, শুধু সরকারকেই বলা হবে শান্তিচুক্তির শতভাগ পূরণ করতে, নিজেরা মোটেও পূরণ করবেন না, সেটা তো হতে পারে না। রাঙ্গামাটির সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল একটি বার্তা পাবেন এবং এবার সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবেন এটাই সমগ্র জাতি প্রত্যাশা করে। নারীদের সন্ত্রাসীরা আর যাতে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে এবং কথায় কথায় ‘ধর্ষণ’ নাটক সাজিয়ে বিভ্রান্ত করতে না পারে, সে জন্য মিডিয়া জগৎ ও মানবাধিকার সংগঠনসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক : রাঙ্গামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক
zaman7472@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.