সুখ, টাকা এবং ঝরে যাওয়া আইনস্টাইনরা by জাহেদ আহমদ

টাকায় সুখ মেলে? বহু পুরনো প্রশ্ন এটি। তবে আজ অবধি নিরর্থক হয়ে যায়নি। এ প্রশ্নের উত্তর সবার একইরকম হবে না; তথাপি বেশিরভাগ মানুষ একমত হবেন যে, ‘জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই, সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই, ভ্রাতা ভগ্নীর নিকট কথাটার প্রত্যাশা নাই’ (বিষাদ সিন্ধু, মীর মশাররফ হোসেন)।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, সুখী হতে হলে ঠিক কত টাকা দরকার, মানে অঙ্কের হিসাবে পরিমাণটা কত? আমার ধারণা ছিল এ প্রশ্নের উত্তর কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়; কিন্তু পত্রিকা পড়ে জানলাম আমার ধারণা ভুল। ২০১০ সালে আমেরিকায় এক গবেষণায় জানা গেছে, সুখী স্বছন্দ জীবন চালাতে বছরে আয় চাই ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার। এই পরিমাণের বেশি আয় হলে অবশ্যই কোনো ক্ষতি নেই, তবে এই পরিমাণের বাইরে সুখ-শান্তির সূচক টাকার সঙ্গে সঙ্গে ওভাবে ওঠানামা করে না। মানুষের স্বাভাবিক চাহিদাগুলো একবার পূরণ হয়ে গেলে বেশি টাকা মানেই কিন্তু বেশি সুখ নয়, বলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোবিদ ড্যানিয়েল গিল বার্ট। ২০১৫ সালের আরেক গবেষণায় প্রকাশ, অনেক টাকাকড়ি যে হারে দুঃখ কমাতে কাজে লাগে, সেই হারে সুখ বাড়াতে কাজে আসে না। খেয়াল রাখবেন, কেউই এ কথা বলছেন না যে, আপনার বেতন বা টাকার পরিমাণই সুখ-দুঃখ যাচাইয়ের একমাত্র নিয়ামক। টাকার বাইরে সুখের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে- সুস্বাস্থ্য, আপনজন, পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের কোয়ালিটি ইত্যাদি। এবার হালের সাড়া জাগানো সামাজিক অর্থনীতির একটি গবেষণার দিকে চোখ ঘুরানো যাক। ধরুন আপনি আমেরিকায় নিম্ন মধ্য আয়ের একজন পিতা বা মাতা। আপনার সন্তান একজন জিনিয়াস। গণিতে আপনার সন্তানের টেস্ট স্কোর সব সময় হান্ড্রেড পারসেন্ট। মনে করুন আপনার রয়েছে বিত্তশালী একজন বন্ধু যার সন্তান ও আপনার সন্তানের মতোই গণিতে জিনিয়াস। হালের আমেরিকায় আপনার সন্তানের চেয়ে আপনার বন্ধুর সন্তান সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। এর কারণ একটু পরে বোঝা যাবে।
২. রাজ শেঠি আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। পাবলিক পলিসি নির্ধারণে তার গবেষণা ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। শেঠি এবং তার দল সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মেধার তারতম্য না থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া একজন শিশুর চেয়ে বিত্তশালী পরিবারের একজন শিশুর আমেরিকায় উদ্ভাবন বা রহহড়াধঃরড়হ ফিল্ডে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। উদ্ভাবনকে এ গবেষণায় গুরুত্ব দেয়ার কারণ হল আমেরিকার বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির অর্ধেক আসে ইনোভেশন বা উদ্ভাবন ফিল্ড থেকে (যেমন- বিজ্ঞানী, প্রযুক্তি গবেষক, ওষুধ আবিষ্কারক, এন্ট্রেপ্রিউনরের কাজের ক্ষেত্র)। আমেরিকায় কীভাবে আরও বেশি করে উদ্ভাবন ও মেধার ব্যাপ্তি বাড়ানো যায় এ প্রশ্নকে সামনে রেখে রাজ শেঠি এবং তার দল (এলেক্স বেল, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি; জেভিয়ার জেরাভেল, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স; নিভিয়ানা পেটকোভা, ইউএসএট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট; জন ভেন রিনেন, এমআইটি) ‘সুযোগের সমতা প্রজেক্ট’ ('Equality of Opportunity Project')-এর ব্যানারে কয়েক বছর ধরে গবেষণাটি সম্পন্ন করেছেন। তিন ধরনের উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছে শেঠির দল :
এক. ১.২ মিলিয়ন আমেরিকান ইনভেন্টর যাদের প্রত্যেকের রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের প্যাটেন্ট।
দুই. উল্লিখিত ইনভেন্টরদের ফেডারেল ট্যাক্স এবং ইনকাম রেকর্ড।
তিন. থার্ড গ্রেড থেকে এইট গ্রেড পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটিপাবলিক স্কুলে পড়ুয়াদের স্ট্যান্ডারাইজড পরীক্ষার ম্যাথ স্কোর। এ ছাড়া সবার কলেজ এবং এডাল্ট জীবনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ গবেষণায় নজর কাড়ার মতো কিছু বিষয় সামনে উঠে এসেছে-
* শিশুবেলা থেকে গণিতে অতি পারদর্শী ছেলেমেয়েদের ইনভেন্টর হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি। বলা বাহুল্য, ম্যাথ জিনিয়াস এসব শিশু এসে থাকে সব ধরনের ইনকাম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে (অর্থাৎ মেধার ডিস্ট্রিবিউশন সাধারণত সসম)। কিন্তু টপ ম্যাথ স্কোরই যথেষ্ট নয়; টপ ম্যাথ স্কোরওয়ালাদের যারা টপ ইনকাম ফ্যামিলি থেকে এসেছে কেবল তাদের রয়েছে ইনভেন্টর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
* নিু আয়ের পরিবারের ম্যাথ জিনিয়াস ছেলেমেয়েদের (যারা থার্ড গ্রেডের টপ ফাইভ পারসেন্টের মধ্যে) ইনভেন্টর হওয়ার সম্ভাবনা বিত্তশালী পরিবারের মেধায় সাধারণের নিচে থাকা ছেলেমেয়েদের চেয়ে বেশি নয়।
* মধ্য আয়ের পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েদের উদ্ভাবন হার দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েদের উদ্ভাবন হারের কাছাকাছি।
* উদ্ভাবনে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়ে আছে সাউদ ইস্টার্ন আমেরিকান স্টেটস, মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা, নারীরা, হিস্পানিক এবং আফ্রিকান আমেরিকান বা কালোরা। যেমন- প্যাটেন্টের স্বত্বাধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা একজন হোয়াইট শিশুর তিন গুণ বেশি একজন ব্ল্যাক শিশুর তুলনায় এবং প্যাটেন্ট হোল্ডারদের কেবল আঠারো শতাংশ নারী।
* উদ্ভাবন, প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার সুপ্ত সম্ভাবনা নিয়ে আমেরিকায় জন্ম নেয়া লাখ লাখ শিশু কেবল সুযোগ আর উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অকালে হারিয়ে যাচ্ছে। এদের আমেরিকান মিডিয়ায় বলা হচ্ছে ঝরে যাওয়া আইনস্টাইন (Lost Einstein's)। তবে উদ্ভাবনে এই গ্যাপ বা অসমতার একমাত্র কারণ কেবল বিত্ত বা টাকা দিয়ে ব্যাখ্যা করলে তা হবে অতি সরলীকরণ। বিত্তের সঙ্গে সুযোগ এবং উপযুক্ত পরিবেশের রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যেমন- এটা সম্ভব যে উদ্ভাবক এবং গবেষক-বিজ্ঞানীবেষ্টিত পরিবেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ওইসব ফিল্ডের প্রতি একটা আকর্ষণ ফিল করে। শেঠির গবেষণায় তাই এও ফুটে উঠেছে যে, কোনো এক বিশেষ ধরনের গবেষক বা গবেষণার আবহে বেড়ে ওঠা শিশুদের ওই ফিল্ডের দিকে ঝোঁকার চান্স বেশি। আবার নারী উদ্ভাবকের আধিক্য রয়েছে আমেরিকার এমন এলাকায় (যেমন- সেন্ট্রাল নিউ জার্সি, হনলুলু) বেড়ে ওঠা একজন মেয়ের ইনভেন্টর হওয়ার সম্ভাবনা আমেরিকার অন্য অঞ্চলের সমমেধার আরেকজন মেয়ের চেয়ে বেশি। উদ্ভাবনে মেয়েদের উপস্থিতি নগণ্য। এসব পর্যবেক্ষণ সমস্যার সমাধানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যেমন- উদ্ভাবনে লিঙ্গবৈষম্য কমাতে অনেক পদক্ষেপের একটি হতে পারে গণিতে মেধাবী মেয়েদের শৈশবে আইডেন্টিফাইড করে নারী উদ্ভাবকের সাহচর্যে নিয়ে আসা। আমেরিকায় উদ্ভাবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে যদি এ দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য আর সুযোগের ঘাটতি কিছুটা হলেও কমানো যায়। উদ্ভাবনে নারী, সংখ্যালঘু শ্রেণী (যেমন- আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানিক পপুলেশন) এবং লোয়ার ও মিডল ক্লাসের মেধাবী ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ যদি বিত্তশালী হোয়াইট ছেলেমেয়েদের সমান করা যায়, তাহলে রাজ শেঠির হিসেবে আমেরিকায় উদ্ভাবকের সংখ্যা বর্তমানের চার গুণ হবে। শেঠি এক জায়গায় বলেছেন, ‘সুযোগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা আপনি অসমতা বা সমাধিকার নিয়ে মাথা না ঘামালেও, নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের উত্তম প্রশিক্ষণ এবং আরও ভালো সুযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তারা হয়তো অর্থনীতিতে শেষ অবধি আরও বেশি মাত্রায় অবদান রাখবে আর সেটা হবে সবার জন্য হিতকর।’ রাজ শেঠির কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন, সে আপনি আমেরিকান হোন বা না হোন।
জাহেদ আহমদ : নিউইয়র্ক স্টেট গভর্নমেন্টে কর্মরত
humanistnyc@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.