চীনকে চাপে রাখতে ফ্রান্সকে নৌঘাঁটি খুলে দিচ্ছে ভারত

অন্যথাটা হয়েছিল শুধুমাত্র কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষেত্রেই। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনকে স্বাগত জানাতে ফের পুরনো মেজাজে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুক্রবার রাতে দিল্লি বিমানবন্দরে নিজে গিয়ে তাকে স্বাগত জানান মোদি। সঙ্গে চিরাচরিত ‘জাদু কি ঝাপ্পি’। শনিবার সকালে হায়দরাবাদ হাউসে স্বাগত জানানোর সময়ও ফের ম্যাক্রনকে জড়িয়ে ধরেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে পাশে নিয়ে মোদির মন্তব্য, ‘মাটি থেকে আকাশ—এমন একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এই দুই দেশের সমঝোতা নেই। হতে পারে ২০ বছর ধরে আমাদের কৌশলগত বন্ধুত্ব, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের।’ ম্যাক্রনের পাল্টা, ‘এশিয়ায় আমরা যেমন ভারতকে প্রথম কৌশলগত বন্ধু হিসেবে চাই, তেমনই ইউরোপ তথা পশ্চিমী বিশ্বে ভারতের প্রথম কৌশলগত বন্ধু হয়ে উঠতে চাই।’ সত্যিই তাই। এদিনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দু’দেশ রেল, পরমাণুশক্তি, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রসহ যে ১৪টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তারপর একথা বলতেই পারে নয়াদিল্লি ও প্যারিস। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এবার থেকে দু’দেশের রণতরী একে অপরের নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। ওয়াকিবহাল মহলের মত, এই চুক্তির পরোক্ষ লক্ষ্য নিশ্চিতভাবে চীন। পাকিস্তানের গদরে বন্দর নির্মাণ, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয়া এবং মালদ্বীপের একাধিক ছোট দ্বীপকে নিজের কব্জায় নিয়ে ইতিমধ্যে পানিসীমানায় নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে শুরু করেছে বিইজিং। দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বজায় রেখে ভারত মহাসাগরে যেভাবে নজর দিয়েছে চীন, তাতে বেজায় উদ্বিগ্ন দিল্লি। সেই চাপ চীনকে ফিরিয়ে দিতেই ফ্রান্সের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল ভারত। এর ফলে ভারত যেমন চীনের নৌবন্দর ব্যবহার করতে পারবে, তেমনই ফ্রান্সও ভারতের নৌবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এখানেই চাপ হতে পারে চীনের। কৌশলগত বন্ধু হওয়ায় জরুরি পরিস্থিতিতে ভারতের পাশে দাঁড়াতে যে ফ্রান্স বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না, সেটা ভালোমতোই জানে বেইজিং।
ইতিমধ্যে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যৌথভাবে মহড়া চালিয়েছে। চলছে প্রশিক্ষণও। বাস্তবে এই উদ্যোগ আসলে চীনের সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রয়াসের প্রতি ইউরোপিয়ান দুই দেশের সমর্থন। কারণ, দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে নৌ চলাচলে স্বাধীনতা বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফ্রান্স ও ব্রিটেন। চীনের দক্ষিণ চীন সাগরের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভিয়েতনাম। সিঙ্গাপুর ওই সাগরের মালিকানা দাবি না করলেও আমেরিকা ও ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনা সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যেই জোট গঠন করেছে। এতে এবার ফ্রান্স ও ব্রিটেনও যোগ দিতে পারে। এবার ভারত ও ফ্রান্সের নতুন এই চুক্তিতে চাপ আরও বাড়ল চীনের। তবে এখানেই শেষ নয়। স্করপিন সাবমেরিন এবং রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়েও এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। ২০১৬ সালের ৩৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ভারত। ২০১৯ সাল থেকে সেগুলো আসার কথা। এই প্রসঙ্গে ম্যাক্রন শনিবার বলেন, ‘রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার যে সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে, তা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের। ভারতের প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। কৌশলগত বন্ধুত্বের অন্যতম দিক এটি।’ এই প্রসঙ্গে শোনা যাচ্ছে, আরও ৩৬টি রাফায়েল কেনা নিয়ে ভারত যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে যাতে দ্রুত কথাবার্তা শুরু হয়, সেজন্য ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে চিঠি দিয়েছেন ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি। তাতে বলা হয়েছে, ‘২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ফরাসি প্রেসিডেন্ট চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে আরো ৩৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান দেয়া হয়। আমরা চাই ফরাসি প্রেসিডেন্টের চলতি ভারত সফরে সেই আলোচনা শুরু হোক।’ কিন্তু প্রথম রাফায়েল না আসা পর্যন্ত এনিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনা শুরু করতে চাইছে না বলেই সূত্রের খবর। তবে ফরাসি প্রেসিডেন্টের চারদিনের সফরে এটা নিয়ে জল অন্য খাতে বইতেই পারে। কারণ, ভুললে চলবে না এই রাফায়েল চুক্তির জন্য মোদি নিজে গিয়েছিলেন প্যারিসে।

No comments

Powered by Blogger.