চীনা জাগরণের নতুন নায়ক শি জিনপিং

শি জিনপিং ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। এর পরই তিনি দেশটির ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে আত্মপ্রত্যয়, জবরদস্তি ও কর্তৃত্ববাদের একটি যুগের সূচনা করেন। পাশাপাশি তার হাত ধরে চীন এক নতুন জাগরণ দেখতে পেয়েছে। পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে চীনের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তিনিই এখন সামনে এবং কেন্দ্র থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাশাপাশি ভিন্নমতাবলম্বী ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড়ও শুরু করেন। একদিকে যেমন নিখুঁত রাজনৈতিক ঘুঁটি চালতে দক্ষ, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি জিনপিং একজন খেয়ালি লৌহমানবের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতা হিসেবে নিজের ক্ষমতা দ্রুতই সুসংহত করেছেন। নিজের চিন্তাধারা নিজের নামেই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন শি। এতদিন এই সম্মানটি কেবল মাও জেদংয়ের জন্য সংরক্ষিত ছিল। চেয়ারম্যান মাও ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন। এ ছাড়া তিনি সিপিসির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। চীন থেকে সাম্রাজ্যবাদকে বিদায় করে দেয়ার পেছনে সবটুকু অবদান তাকেই দেয়া হয়। শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারা, এর অর্থ হচ্ছে- এখন থেকে তাকে চ্যালেঞ্জ করলে সেটি কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা হবে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে দেশটিতে সাত সদস্যের পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে প্রেসিডেন্টের কোনো উত্তরাধিকারী রাখা হয়নি। এতে বিষয়টি পরিষ্কার যে, ২০২২ সালের পরও ৬৪ বছর বয়সী শি জিনপিং ক্ষমতায় থাকতে যাচ্ছেন। কমিউনিস্ট পার্টি সুস্পষ্টভাবে শির সেই লক্ষ্যের কথাই এবার নিশ্চিত করেছে। দুই মেয়াদের বেশি কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদে এমন কথা বলা হয়েছে, সেটি উঠিয়ে নেয়া হবে বলেও একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
রাজপুত্র, প্রজা ও প্রেসিডেন্ট
১৯৫৩ সালে জন্ম নেয়া শি জিনপিং প্রবীণ বিপ্লবী শি জংঝুনের সন্তান। তার বাবা দেশটির সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন। একটি অভিজাত ও প্রথিতযশা পরিবার থেকে উঠে আসায় তাকে রাজপুত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু একটা সময় তাদের পরিবারে দুর্ভোগ ও বিপর্যয় নেমে আসে। ১৯৬২ সালে দেশটির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগে শুদ্ধি অভিযানে তার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তার বয়স ১৩ বছর। তার বাবা কারাগারে। ইতিমধ্যে তার একটি বোন মারা যান। যদিও তিনি আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শি জিনপিং সেই সময় একটি ভয়ঙ্কর সময় পার করেছেন। ১৯৬৪ সালে চেয়ারম্যান মাও ঘোষণা করেন, দেশের কয়েক লাখ তরুণকে শহর থেকে গ্রামে পাঠানো হবে। তারা যাতে গ্রামের কৃষক-প্রজাদের কঠিন জীবনযাপন বুঝতে পারেন, সে জন্যই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। শি সবে ১৫ বছরে পা রাখেন। তরুণ শিকে সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্বাসনের জন্য গ্রামে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি প্রত্যন্ত ও দরিদ্র গ্রাম লিয়াংজিয়াহে সাত বছর কঠোর পরিশ্রম করেন। ষাটের দশকে তিনি একটা কঠিন সময় পার করেছেন। সেখানে কোনো আধুনিক যানবাহন, বিদ্যুৎ বা যন্ত্রপাতি ছিল না। গ্রামটিতে অবস্থানকালে কিশোর শি জমিতে সার দেয়া, বাধ তৈরি ও সড়ক মেরামত করা শিখেছেন। শি পাহাড়ে মশা-মাছিতে ভরা একটি গুহায় ইট পাতানো বিছানায় আরও তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে থাকতেন। তাদের একজন কৃষক লু হাউশেং বছর তিনেক আগে বলেন, তখন আমরা যা কাছে পেতাম, তাই খেতে পারতাম। যখন আপনার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা থাকবে, তখন কী খাচ্ছেন, তা ভেবে দেখার সময় থাকবে না। যা সামনে পাবেন, তাই খেয়ে ফেলতে পারবেন। পরবর্তীতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। শি বলেন, সেখান থেকে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তার সেই গিরিখাতের জীবনই বর্তমান চিন্তাধারা ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করে দিয়েছে। যখন তাকে কৃষিজীবন সম্পর্কে দীক্ষা দিতে পাহাড়ি গ্রামটিতে পাঠানো হয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত। কিন্তু ২২ বছর বয়সে সেই গ্রাম ছেড়ে তাকে চলে আসার সময় তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণ ছিল আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ। তার ভাষায়, আমি উত্তর চীনের সেই হলুদাভ মাটির সন্তান। আমার হৃদয়টা লিয়াংজিয়াহে পড়ে আছে। ওই গ্রামটিই আমাকে আজকের শির চিন্তাধারা গড়ে দিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতার ছেলে হিসেবে তিনি যেমন রাজকীয় জীবনযাপন করেছেন। আবার পরবর্তী সময় পাহাড়ি গ্রামের গিরিখাতে তাকে কঠোর শ্রম দিতে হয়েছে। ২০০৯ সালে উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, শি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছেন, তার জীবনের প্রথম ১০ বছর ছিল খুবই গঠনমূলক।
তার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিতে স্থায়ী প্রভাবটা এসেছে নিজের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া রাজকীয় সংস্কৃতি থেকেই। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রথম প্রজন্মের পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি তখন বেইজিংয়ের বিশেষ আবাসিক কম্পাউন্ডে থাকতেন। তার পরিবারের ওপর দিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় চলে যাওয়ার পরও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা, তিনি দলের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে দলে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাবার কর্মের জন্য তাকে বারবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অবশেষে ১৯৭৪ সালে দল তাকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করে। এর পর তিনি দলের শীর্ষে উঠতে জোরালো চেষ্টা করেন। এ জন্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রথমে তাকে হেবাইপ্রদেশে দলীয় মহাসচিব হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। এর পর তিনি আস্তে আস্তে বড় পদোন্নতি পেতে থাকেন। একসময় তিনি চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র সাংহাইয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। এর পর দলীয় পদমর্যাদা বাড়তেই থাকে। দলীয় শীর্ষ নীতিনির্ধারণী ফোরাম পলিট ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে ক্ষমতার শিখরে আরোহন করেন। শি অনেকটা সংযত স্বভাবের। সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পছন্দ করেন। বলা হয়, এ জন্যই তার প্রথম বিয়েটি টিকেনি। তিনি প্রথমে এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তবে তার রাজনৈতিক পদোন্নতিতে এই স্বভাব সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। দলীয় শীর্ষ পদে ওঠার আগে তিনি খুব পরিচিতিও পাননি। সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন প্রকৌশলে স্নাতক শি জিনপিং দ্বিতীয় বিয়ে করেন জাদুময়ী কণ্ঠের অধিকারী গানের শিল্পী পেং লিইউয়ানকে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও ফার্স্ট কাপল হিসেবে তাদের ফলাও করে প্রচার করা হয়। এর আগের রাষ্ট্রপতিদের স্ত্রীরা গণমাধ্যমে এতটা প্রচার পেতেন না। তাদের সংসারে শি মিংজি নামে একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তার এই মেয়েটি তেমন একটা জনসমক্ষে আসেন না। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা এবং তাদের বিশাল বাণিজ্য সম্ভার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরের উপাদান হয়ে আসছে।
চীনের স্বপ্ন
শি জিনপিং চীনের স্বপ্ন নামে একটি রূপকল্প ঘোষণা করেছেন। যার মধ্য দিয়ে তিনি নিজ জাতির মধ্যে নতুন যৌবন প্রতিষ্ঠার জন্য ছুটছেন। তিনি চীনা জাতির মধ্যে নতুন করে জাগরণ ঘটাতে চাচ্ছেন। তার শাসনামলে প্রবৃদ্ধির ধীরগতির বিরুদ্ধে লড়তে দেশটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে অতিস্ফীত হওয়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন শিল্পকারখানায় কাটছাঁট ও দূষণ কমানোয় তিনি মনোযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বাণিজ্য প্রকল্প তো রয়েছেই। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক মঞ্চে দেশটি আরও বেশি প্রত্যয়ী, দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ সত্ত্বেও দক্ষিণ চীন সাগরে তারা ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকায় কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে নিজেদের সফট পাওয়ার চর্চা অব্যাহত রেখেছে। সফট পাওয়ার হচ্ছে- সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে নিজের প্রতি অন্যের আগ্রহ বাড়ানো। জবরদস্তিমূলক কিছু না করে বিনিয়োগ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে অন্যের অগ্রাধিকার মাথায় রেখে নিজেদের দিকে আকর্ষণ তৈরি করা। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সফট পাওয়ারের চর্চা করা হয়। তার আমলে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানকে উসকে দিচ্ছে। শি জিনপিংকে লৌহমানব নেতা হিসেবে বিশেষভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- সাবেক নেতা মাও জেদংয়ের মতো তিনিও ব্যক্তিগত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করছেন। শি দুর্নীতির বিরুদ্ধে নির্মম যুদ্ধে নেমেছেন। কয়েক লাখ লোককে তিনি বিচারের মুখোমুখি করেছেন। যার মধ্যে তার দলের উচ্চ ও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারাও রয়েছেন। একদিকে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত রাঘববোয়ালদের ধরছেন। অন্যদিকে চুনোপুঁটিদেরও ফাঁদে ফেলছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিরোধীদের উৎখাত করতেই তিনি দুর্নীতি প্রতিরোধের নামে এসব অভিযান পরিচালনা করছেন, যা তার নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে রাজনৈতিক পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ। ইতিমধ্যে চীনে মানুষের বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ইন্টারনেট জগতে চলছে ব্যাপক নজরদারি। সাইবার নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের দায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তদন্তের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দেশটিতে ওয়েবো, উইচ্যাট ও বেইডু টিবা-এ তিনটি সামাজিকমাধ্যম বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এসবের ব্যবহারকারী নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারছেন না।
কারণ চীন এখন প্রতিটি ফোনকল, আন্দোলন কিংবা তাদের অনলাইনের মন্তব্যের ওপর নজরদারি করতে পারে। প্রশাসনের কাছে স্পর্শকাতর মনে হলে মন্তব্য মুছে ফেলা হয়। কখনও শাস্তিও এসে কাঁধে চেপে বসতে পারে। চীনে মানবাধিকারকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীরা সুখে নেই। তাদের গ্রেফতারের ঘটনা অহরহ। এ জন্য অনেকে শিকে কর্তৃত্ববাদী নেতা হিসেবে উল্লেখ করতে কার্পণ্য করেন না। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও সাধারণ চীনারা শি জিনপিংকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি অনেকটা যুক্তিযুক্তভাবেই সেই সমর্থন উপভোগ করছেন।বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনীতির দেশটির রাজনীতির গড়নে নতুন রূপ নিয়ে আসছেন শি জিনপিং। চীনের নেতারা ক্ষমতার শেষ মেয়াদে পলিট ব্যুরোর স্থায়ী কমিটিতে এক অথবা দুজন নেতাকে সম্ভাব্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যান। কিন্তু গেল বছরের অক্টোবরে শি জিনপিং সেটি করেননি। এ ছাড়া চীনের নেতারা নিজেদের মেয়াদ শেষে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু শির বেলায় সেটি বুঝি ঘটছে না। দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি শির চিন্তাধারা সংবিধানে সন্নিবেশ করতে সর্বসম্মতভাবে ভোট দেয়ার মাধ্যমে তাকে প্রতিষ্ঠাতা মাও জেদংয়ের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি যদি ২০২২ সালের পর ক্ষমতা ছেড়েও দেন, তবু দেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব অব্যাহতভাবে অটুট থাকবে। কারণ কংগ্রেসের ভাষণে তিনি যে রূপকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন, সেটি কেবল পাঁচ বছরের জন্যই না, ৩০ বছরমেয়াদি।

No comments

Powered by Blogger.