পুলিশের সোর্স দাপিয়ে বেড়াচ্ছে

রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুলিশের সোর্সরা। মূলত এরা সবাই দাগি অপরাধী। সোর্স পরিচয়ে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। বিভিন্ন অপরাধী গ্রেফতারে পুলিশ এদের সহযোগিতা নেয়। আর এ সুযোগে এসব সোর্সের অপরাধ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আর পুলিশের সঙ্গে সখ্য থাকার সুযোগে এসব সোর্স অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সোর্সরা নিয়ন্ত্রণ করছে না। শুধু তাই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাটে তল্লাশির নামে সোর্সদের ‘ফিটিং’ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। রাতে চলাচলরত মানুষকে তল্লাশির নামে পকেটে ইয়াবা কিংবা গাঁজার পুরিয়া দিয়ে ফিটিং দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে সোর্সদের বিরুদ্ধে। আবার কখনও কখনও মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়েও এরা নিরপরাধ মানুষের অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়। রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় এখন আতঙ্কের নাম পুলিশের সোর্স। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সোর্সদের ভুয়া তথ্যে পুলিশ সদস্যদেরও অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সোর্সরা পুলিশের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদাবাজি করে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অন্যান্য অপরাধকাণ্ডেও তারা অপ্রতিরোধ্য। কোনো কোনো সময় নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়েও এরা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে তল্লাশি চালায়। আবার মামলার আসামি কিংবা বাদীর পক্ষ নিয়ে প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকি দেয়। বিভিন্ন থানায় এসআই পদমর্যাদার পুলিশের সঙ্গে এ সোর্সদের যোগাযোগ বেশি। এদের সহযোগিতা নিয়েই তারা বিভিন্ন মামলার তদন্তে যান। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য ও সোর্স মিলে চাঁদাবাজি করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপি সদর দফতর থেকে থানায় থানায় চিঠি দিয়ে সোর্স নামধারী অপরাধীদের ব্যাপারে ওসিদের সতর্ক হতে বলা হয়েছে। এরপরও থামছে না সোর্সদের তৎপরতা। পুরান ঢাকা এবং মিরপুরে সোর্সদের তৎপরতা বেশি। কদমতলী থানার জুরাইনে একাধিক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, থানা পুলিশের সোর্স সোহেল ও কামাল এলাকায় রীতিমতো অত্যাচার চালায়। এদের যন্ত্রণায় অনেকেই অতিষ্ঠ। এরা সন্ধ্যার পরে সাধারণ মানুষকে দাঁড় করিয়ে চেক করার নামে পকেটে ইয়াবা কিংবা গাঁজা ঢুকিয়ে দিয়ে হয়রানি করে। লালবাগে পুলিশের সোর্সরাও বেপরোয়া। এ এলাকায় বিল্লাল, রব, আলমগীরসহ অন্য সোর্সরা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে। ভয়ে লোকজন এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। মিরপুরেও সোর্সের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। মিরপুর বেনারসী পল্লী এলাকার এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, সোর্সরা এলাকায় পুলিশের চেয়েও বেশি ক্ষমতার দাপট দেখায়।
এরা মানুষের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করে। পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। তিনি বলেন, সোর্সদের সব ধরনের অপরাধ-অপকর্মের ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তাদের কঠোর ভূমিকা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোথাও সোর্সরা হয়রানি করেছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, সোর্সদের মাধ্যমে কেউ হয়রানির শিকার হলে বা সোর্সদের কোনো অপকর্ম ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ যাতে পুলিশের নাম ব্যবহার করে কোনো অপরাধ না করতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক। সোর্সরা কে কোথায় : রাজধানীর প্রত্যেক থানা এলাকায় রয়েছে সোর্সদের দৌরাত্ম্য। মিরপুর ও কাফরুলে শাহীন, খ্রিস্টান বাবুু, তামান্না তামু, বাবু, সুমন, মোশারফ, রাজু ও আলমগীর পুলিশের সোর্স পরিচয়ে এলাকায় দাপটের সঙ্গে নানা অপরাধ চালিয়ে আসছে। এছাড়া পল্লবীতে দেলোয়ার, তারেক, রাজু, সাইফুল ও রহমান। শাহবাগে ফর্মা কাদের, নিউমার্কেটে নাদিম ও কাইল্যা বাবু, লালবাগ ও চকবাজারে আবদুর রব, আলমগীর, বিল্লাল, বাসেত, আজমল, তৌহিদসহ আরও কয়েকজন। হাজারীবাগে শাহজাহান, জসিম, রনি ও ওয়াসিম। কামরাঙ্গীরচরে সোহেল, সিডি মিন্টু, আরিফ, আশরাফ। ধানমণ্ডি ও কলাবাগানে মিন্টু, নাজির, ফাতেমা ও লাল চান, মোহাম্মদপুরে জয়নাল, হানিফ ও রাসেল। গুলশানে ফর্মা স্বপন ও নাদিম।
শ্যামপুর, কদমতলী ও গেণ্ডারিয়ায় আমির, সোহেল, সোহাগ, কামাল, জাহাঙ্গীর, শিপন, ভাগিনা রবিন, রহিম, নজরুল, লালু ও আলী। যাত্রাবাড়ীতে আলতাফ, মাসুম, শাহ আলম, সুমন, শাহীন, সালাম, ফর্মা সিরাজ, লালন, ডেঙ্গু, রেলি, শামীম, রাজু, পটপট বাবু, ইমন। ডেমরায় বাবু সেলিম, সূত্রাপুর ও কোতোয়ালিতে জামান, লিটন, শম্ভু, মনোয়ারা, সেলিম, ফেনসি রমজান, ইয়াবা জিলু, কানাই, সামসু, জাহাঙ্গীর, শাকিল, সুজন, মাসুদ, সাব্বির, বাবলু, শফিক ও মুজিবর। পল্টনে মরিয়ম, আজমল, শাহাবউদ্দিন, খলিল। সবুজবাগে বজলু, রমনায় হেরোইনচি স্বপন, মালেক, খলিল ও আক্তার। খিলগাঁওয়ে লুঙ্গি মিজান, কানা নূরুল ইসলাম ওরফে তুহিন, তালতলার ডিবি ফর্মা রাজীব, র‌্যাব বাবুল, আজাহার ওরফে আদার, সেলিম, মর্তুজা, সাগর, আলমগীর, ফর্মা খালেক উল্লেখযোগ্য। শাহজাহানপুর থানায় সোর্স হিসেবে পরিচয় দেয় সনিয়া, জলিল, হালিম, বাবলা ও হানিফ। বাড্ডায় বরিশাইল্যা রফিক, গ্রিল জামাল, ক্যাশিয়ার দুলালের ভাই ফর্মা বিল্লাল, সাঁতারকুলের বাবা শাহীন, রব, বাপ্পি, সুমন, মোটা বিপ্লব, ডিলা, আব্বাস, ভাটারার বাংলা নাছির, আলমগীর, ইয়াবা নাঈম, ফর্মা লিটন সোর্স পরিচয়ে এলাকায় দাপটের সঙ্গে নানা অপকর্ম চালায়। এদের ভয়ে কেউ টুঁ শব্দও করেন না। সোর্সরাই সেজে বসে ভুয়া কর্মকর্তা : সোর্সরা সুযোগ বুঝে নিজেদের পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাতে ভুয়া পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সোর্সরা তল্লাশি চালায়। কোমরে হ্যান্ডকাফ, হাতে ওয়াকিটকি দেখে কারও বোঝার উপায় থাকে না এরা সোর্স। জহিরুল নামে লালবাগের এক বাসিন্দা জানান, তিনি মঙ্গলবার রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। আজিমপুর গৌর-এ শহীদ মাজারের কাছে তার মোটরসাইকেল আটক করে পুলিশের এক সোর্স। তিনি বলেন, দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি সে পুলিশ না সোর্স। সে মোটরসাইকেলের কাগজ দেখার পর শরীর তল্লাশি করতে চায়। তিনি বলেন, ভয়ে ছিলাম আবার কোনো ফাঁদে ফেলে কিনা। পরে লালবাগে বাসা জানতে পেরে ছেড়ে দেয় সে। অভিযোগ রয়েছে, এরা ভুয়া পুলিশ সেজে বাসা বাড়িতেও তল্লাশি করে সুযোগ বুঝে।
সোর্স খুন : আধিপত্যসহ নানা কারণে খুনের শিকার হন সোর্সরা। জানা গেছে, গত সাত বছরে রাজধানীতে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ৭০ জনের বেশি সোর্স খুন হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীতে ১২ জনের বেশি সোর্স খুন হয়েছে। এদের প্রত্যেকেই মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, পুলিশের লাইনম্যান, থানায় তদবির, এলাকায় আধিপত্যসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। আবার কেউ কেউ অপরাধীদের ধরিয়ে দেয়ার কারণেও খুন হয়েছেন।
সোর্সদেরকে ভয় পায় সন্ত্রাসীরাও : পুলিশের সোর্সদের এতটাই দাপট যে তাদেরকে রীতিমতো ভয় পায় দাগি সন্ত্রাসীরাও। সোর্সদের তারা রীতিমতো সমীহ করে চলে। তাদের ধারণা উল্টাপাল্টা করলে যেকোনো সময় তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারে সোর্সরা। সন্ত্রাসী ও পুলিশের সঙ্গে সখ্যের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের নিয়ে থাকেন আতঙ্কে।

No comments

Powered by Blogger.