‘অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান’

‘শিক্ষা’ একটি জাতির সবচেয়ে গর্বের অথবা আক্ষেপের উভয়ই হতে পারে। কোনো একজন মানুষের শুধু দৈহিক, বস্তুগত, প্রযুক্তিগত বা ভাষাগত ব্যুৎপত্তি অর্জনের নামই শিক্ষা নয়। শিক্ষা হল মানুষের দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক উন্নতির নাম। বাংলাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষা রয়েছে। যেমন : ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, কারিগরি ও মাদ্রাসা। মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে আবার অনেক বিভাজন রয়েছে। কওমি ও আলিয়া হল মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান দুটি ধারা। পৃথিবীর প্রথম মাদ্রাসা হিসেবে মানা হয় হজরত মুহাম্মদ (সা.) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সাফা পর্বতের পাদদেশে সাহাবি যায়েদ বিন আরকাম (রা.)-এর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে। মুঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক লাখ মাদ্রাসা ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় একটি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, ইতিহাসে যেটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামে পরিচিত। ১৮৬৬ সালে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব শুধু ধর্মীয় শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেরও অন্যতম কেন্দ্র ছিল।
জাতিগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ব্যবহারিক জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন না থাকলেও এ অঞ্চলের মানুষের ধর্মের প্রতি দুর্বলতা, আবেগ ও ভালোবাসা অনেক পুরনো। যে কারণে আমাদের দেশেও অগণিত মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসার সংখ্যা এ দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কোনো কোনো সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অবহেলা কিংবা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে অনেকগুলো মাদ্রাসা বন্ধ করলেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি মানুষের দুর্বলতা এবং এর শিক্ষার্থী বাড়ছে বৈ কমছে না। দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে ধর্মীয় কারণ যেমন আছে, তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। কোনো একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কেউ সহযোগিতা করলে সমাজের চোখে তিনি সম্মানিত বলে পরিগণিত হন। অনেকে ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে মাদ্রাসা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তবে অধিকাংশ মানুষই এটা করেন ধর্মের প্রতি চিরায়ত ভালোবাসা ও দুর্বলতার জায়গা থেকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, কেউ যদি কোনো মাদ্রাসা বা মসজিদ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন, তাহলে মৃত্যুর পরের জীবনেও তিনি এর পুণ্য লাভ করতে থাকবেন। এ ছাড়া চাকরি থেকে অবসরের পর পেনশনের টাকায় অনেকে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক জমির মালিক রয়েছেন, যারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় একখণ্ড জমিদান করে দেন। পাশাপাশি অনেকে মাদ্রাসা বা মসজিদের পার্শ্বে কবরস্থান তৈরি করে সেখানে নিজেকে কবর দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। আরেকটু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে, কতটুকু আবেগ থাকলে একজন মানুষ তার জীবনের শেষবেলার সম্বলটুকু দিয়ে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় সহযোগিতা করতে চান! বিশ্বাসের জায়গা কতটুকু মজবুত হলে নিজের কবরটি মাদ্রাসা বা মসজিদের পাশে দেয়ার চিন্তা করেন। অন্যদিকে অনেকে মাদ্রাসা শিক্ষাকে শুধু প্রথাগত শিক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেন না। কারও সন্তান হয় না, সে চিন্তা করে আল্লাহ যদি একটি সন্তান দেন- তাকে মাদ্রাসায় পড়াব। কারও সন্তান জন্মের পর মারা যায়, তিনি মানত করেন, পরবর্তী সন্তান বেঁচে থাকলে তাকে মাদ্রাসায় দেবেন। অনেকে চিন্তা করেন,
পরিবারে অন্তত এমন একজন থাকা দরকার, যিনি নবজাতকের জন্মের সময় আজান ও দোয়া করতে পারবেন; কিংবা মৃত্যুর পর জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য হলেও একজন আলেম তাদের পরিবার কিংবা বংশে থাকা দরকার। অনেকে বড় বড় বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহর কাছে মানত করেন, তার সন্তানকে ‘আলেম’ বানাবেন। কত পবিত্র চিন্তা থেকে আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোয় শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়, কিংবা মাদ্রাসাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রায় সব পর্যায় থেকে মাদ্রাসার প্রতি বৈষম্যমূলক ও বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। এটা সত্য, শিক্ষার অন্যান্য মাধ্যমের মতো মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ হয়নি। মাদ্রাসাগুলোর দাবি-দাওয়া, সংকট, সমস্যা নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা মাদ্রাসার ছাত্র কিংবা শিক্ষকবৃন্দ প্রত্যাশিতভাবে যেমন করেননি, তেমনিভাবে এ দেশের সচেতন মহলের একটি বড় অংশ, এমনকি সরকারও মাদ্রাসা শিক্ষা সমস্যার সমাধান ও আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অবদান না রেখে তাদের সমালোচনাই করে গেছে। অথচ মাদ্রাসায় শিক্ষিত বিশাল জনগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে দেখুন- এদের ক’জন মাদকাসক্ত, ক’জন এসিড সন্ত্রাস, যৌতুক, নারী নির্যাতন, পরকীয়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত? দেখবেন, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ ধরনের সামাজিক ব্যাধি থেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা অনেক দূরে অবস্থান করে। অভিযোগ উঠেছে, মাদ্রাসা থেকে নাকি জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়। অথচ এ পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন অভিযানে নিহত ওগ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে দু-একজন ব্যতীত অধিকাংশই সাধারণ কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আসলে জঙ্গিবাদ কোনো বিশেষ শিক্ষা মাধ্যমের সমস্যা না। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। আমাদের দেশও যা থেকে মুক্ত নয়। তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীকে সমাজের মূলধারার জনগোষ্ঠী হিসেবে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?
এরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বেড়ে ওঠা আমার-আপনার ভাই-বোন বা সন্তান। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহযোগিতায় মাদ্রাসাগুলো টিকে আছে। তাহলে সরকারই বা কেন তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না? মাদ্রাসার ছাত্র বলে সব যোগ্যতার প্রমাণ দেয়ার পরও কেন তারা যথাযোগ্য আসনে আসীন হতে পারছে না? লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্য, তাদেরকে কেন ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় না? তথাকথিত বড় ও নামকরা কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করার পরও কেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছে না? বিসিএস পরীক্ষার ভাইভা দিতে গেলে মাদ্রাসার সনদ দেখার কারণে কেন তাকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিব্রত করা হবে? এগুলোর কোনো সহজ উত্তর নেই। আসলে আমরা যারা প্রগতির কথা বলি, তারা প্রকৃতপক্ষে চিন্তায় ও মননে এখনও প্রগতিশীল হতে পারিনি। পৃথিবীতে অধিকাংশ অপরাধীর জীবনের প্রথম অধ্যায় হয় বঞ্চনার। যখন একজন মানুষ ক্রমাগত লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হতে থাকে, তখন সে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি আর ভরসা রাখতে পারে না। সে ওই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে চায়। চরমপন্থাকে নিজের অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। অতএব এ কথা মনে রাখা দরকার, যেন আমাদের আচরণের কারণে কোনো মাদ্রাসা শিক্ষার্থী চরমপন্থী না হয়। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজ নিজ জায়গা থেকে সবার সচেতন হওয়া উচিত। পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুর্ভাগা দেশ’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করে শেষ করব-
‘যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে
পশ্চাতে ঠেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে
অজ্ঞানের অন্ধকারে, আড়ালে ঢাকিছো যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান
অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
মেজর রেজাউল করিম (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.