দিল্লিকে চাপে রাখতে বাতিল হচ্ছে ভারত-চীনযৌথ সামরিক মহড়া!

‘চক্ষুশূল’ দালাই লামার অরুণাচল সফরের পরিকল্পনা শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল চীন। তিব্বতি ধর্মগুরুকে ভারত যদি অরুণাচল প্রদেশে যেতে দেয়, তা হলে ফল খারাপ হবে, হুঁশিয়ারি দিয়েছিল বেইজিং। নয়াদিল্লি অবশ্য গুরুত্ব দেয়নি। নির্ধারিত সূচি মেনেই উত্তর-পূর্বের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করেন বিতর্কিত নির্বাসিত তিব্বতি সরকারের কাণ্ডারী। কিন্তু সেই সফরের পর প্রায় এক মাস কাটলেও তিক্ততা যে একটুও কমেনি, তা বুঝিয়ে দিল চীন। ভারত ও চীনের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় সামরিক মহড়া হওয়ার কথা ছিল, তা সম্ভবত বাতিল হচ্ছে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রেই এই খবর মিলেছে। মহড়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যে ‘ইনিশিয়াল প্ল্যানিং কনফারেন্স’ (আইপিসি) হওয়ার কথা ছিল, চীনের কারণেই সে সম্মেলন হচ্ছে না, জানা গেছে সাউথ ব্লক সূত্রে। ‘হ্যান্ড-ইন-হ্যান্ড মিলিটারি এক্সারসাইজ’— ভারত ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সামরিক মহড়ার পোশাকি নাম এটিই। সেনা, বিমান ও নৌ— তিন বাহিনীই অংশ নেয় এই দ্বিপক্ষীয় মহড়ায়। ভারত ও চিন পরস্পরের মধ্যে মূলত প্রশিক্ষণ বিনিময় করে এই মহড়ায়। ২০১৬ সালেও নির্দিষ্ট সময়েই মহড়া হয়েছিল। এ বছরও হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেকোনো সামরিক মহড়ার আগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলি যে যৌথ প্রস্তুতি সম্মেলন করে, সেই সম্মেলন অর্থাৎ আইপিসি ভেস্তে গেল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আইপিসি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। চীন সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে না বলেই তা স্থগিত হয়ে গিয়েছে বলে খবর। আইপিসি স্থগিত হয়ে যাওয়া মানে যে মহড়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়া, সে নিয়ে কোনো শিবিরেরই সংশয় নেই। যৌথ মহড়া থেকে কেন পিছিয়ে গেল চীন? ভারতের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক টানাপড়েন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার জেরেই চীনের এই সিদ্ধান্ত বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা মনে করছেন। যেকোনো আন্তর্জাতিক বিবাদেই চীন যে ভাবে আগ্রাসী নীতি নিয়ে বিপরীত পক্ষকে চাপে ফেলতে চায়, এ বারও সেই নীতিই নেওয় হয়েছে বলে ভারতের ওয়াকিবহাল মহলের মত। তবে এ ক্ষেত্রে বিপরীত দিকে থাকা দেশটির নাম যে হেতু ভারত, সে হেতু প্রকাশ্য আগ্রাসন চীন দেখাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, চীন ‘নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন’ দেখাচ্ছে। দালাই লামার অরুণাচল সফর নিয়ে প্রকাশ্যে ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়েও যেকোনো কাজ হয়নি, তা বেইজিং ভোলেনি। নয়াদিল্লিও পাল্টা সুর চড়িয়েছিল। তাই এ বার আর প্রকাশ্য হুঁশিয়ারির পথ না নিয়ে সহযোগিতা এবং যৌথ পরিকল্পনার রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছে চীন।
এই ‘নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন’ আসলে চাপ বাড়ানোর কৌশল, খানিকটা ‘বয়কটের’ বার্তা দেয়ার চেষ্টা— বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদদের একাংশ। ভারতের সঙ্গে চীনের বিবাদ অবশ্য শুধুমাত্র দালাই লামাকে কেন্দ্র করে নয়। বিবাদের কারণ আরও অনেক। দীর্ঘ দিন ধরেই এনএসজি-তে ভারতের অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করছে চীন। মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তাবও চীনা ভেটোয় বার বার আটকে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাক-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে চীন অর্থনৈতিক করিডর বানিয়েছে, ভারত যার তীব্র বিরোধিতা করেছে। অরুণাচল নিয়েও ইদানীং চীনের সুর আগের চেয়ে অনেক চড়া হয়েছে। ১৯৬২-র যুদ্ধের পর যে অরুণাচল থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল বেইজিং, গত কয়েক বছর ধরে সেই অরুণাচলকেই চীন আবার ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নামে ডাকতে শুরু করেছে। দলাই লামার অরুণাচল সফরের পর চীন ওই ভারতীয় রাজ্যের ছ’টি অঞ্চলের নতুন নামকরণও করেছে। সব মিলিয়ে ভারত-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রবল টানাপড়েনের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে। রাশিয়া, ভারত এবং চীনের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, সম্প্রতি সে বৈঠকে যোগ দেয়নি চীন। আবার আগামী রোববার বেইজিং-এ বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামের যে বিশাল শিখর সম্মেলন আয়োজিত হচ্ছে, সেখানেও ভারতের কোনো হাই-প্রোফাইল প্রতিনিধি যোগ দিচ্ছেন না। শুধু বেইজিং-এর ভারতীয় দূতাবাস থেকে কোনো প্রতিনিধি সেখানে যেতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই রকম এক পরিস্থিতিতেই যৌথ সামরিক মহড়ার আইপিসি থেকে হঠাৎ চীন সরে দাঁড়াল। এ বছরের হ্যান্ড-ইন-হ্যান্ড মিলিটারি এক্সারসাইজও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। ভারতীয় সেনা অবশ্য এখনই বলছে না যে যৌথ মহড়া এ বছরের মতো বাতিল। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইপিসি স্থগিত হয়েছে মানে এই নয় যে এ বছর আর ভারত-চীন মহড়া হবে না। তবে ভারত-চীন সম্পর্কের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বেইজিং-এর এই অবস্থান যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলের সংশয় নেই। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

No comments

Powered by Blogger.