ভিশন ২০১৮ ঘোষিত হবে কবে?

বিতর্ক উঠেছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ঘোষণা আসল না নকল, মৌলিক না ধার করা? বিতর্কটি তুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং আরও কেউ কেউ। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার এই ভিশন-২০৩০ একটি ফাঁকা প্রতিশ্রুতির ফাঁপানো রঙিন বেলুন। এই বেলুন অচিরেই চুপসে যাবে। জাতির সঙ্গে একটি তামাশা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।...একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে অপর একটি রাজনৈতিক দলের দেওয়া আইডিয়া এবং ভাবনাচিন্তা (থটস) চুরি, নির্লজ্জভাবে চুরি করতে পারে। বিএনপি নকল (ইমিটেট) করতে পারে। কিন্তু উদ্ভাবন (ইনোভেট) করতে পারে না। (প্রথম আলো ১১ মে ২০১৭)। বিএনপির বিরুদ্ধে তিনি অন্যের ভাবনা চুরি করা এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভিশন বা রূপকল্প ২০২১ কতটা মৌলিক ছিল তা বলেননি ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ দিয়ে জনগণের বিপুল বাহবা পেয়েছিল। একই বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যার নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘চেঞ্জ উই নিড’। ওবামার নির্বাচন হয়েছিল ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর। আর আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে। ফলে বলার সুযোগ নেই যে ওবামা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী স্লোগানটি ধার করেছেন। আওয়ামী লীগই ওবামা থেকে ধার করেছে। ভালো জিনিস ধার করলে দোষের কিছু নেই। আওয়ামী লীগের সেই স্লোগান ধার করা হোক আর মৌলিক হোক, স্বীকার করতে হবে সেটি জনচিত্তকে আন্দোলিত করেছিল বলে তারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল।
কিন্তু গত সাড়ে আট বছরের শাসনামলে দিনবদলের সনদের কী কী অঙ্গীকার তারা পূরণ করেছে, আর কী কী করেনি পাশাপাশি রাখলে শেষোক্ত তালিকাই ভারী হবে। এ কথা বলছি কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকারের সাফল্যের কথা মাথায় রেখেই। এ সময়ে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারগুলো যে আরও সংকুচিত হয়েছে, সে কথা জানতে বিদেশি প্রতিবেদন পড়তে হয় না, যাপিত জীবনেই মানুষ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হয়তো ‘পোড়খাওয়া’ রাজনীতিক নন বলেই খালেদা জিয়ার ভিশনকে সরাসরি নাকচ করেননি। বলেছেন, তাঁর ভিশনে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের কথা আছে, এটি ভালো। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব পাল্টা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগই ২০০১ সালে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার চুরি করে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা যদি সব বিষয়ে পাল্টাপাল্টি করেন, তাহলে দেশ ও জনগণের জন্য তাঁরা কাজ করবেন কখন?  তবে ওবায়দুল কাদেরের একটি কথাকে আমরা সমর্থন করি। খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদ–সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অনেক কথা বললেও যুদ্ধাপরাধ বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে একটি কথাও বলেননি। এটি তাঁর ভিশনের বড় দুর্বলতা বলে মনে করি। যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি এড়িয়ে কিংবা অস্বীকার করলে বিএনপি এবারও তরুণ প্রজন্মের সমর্থন হারাবে।
২. ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছিল, যা আখ্যায়িত হয়েছিল দিনবদলের কর্মসূচি হিসেবে। সেই সময় বিএনপি দিয়েছিল ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ কর্মসূচি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করে। বিএনপি সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাই তারা কোনো কর্মসূচি দেয়নি। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এবার বিএনপি ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করল। আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ করতে চায়। বিএনপি ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার কথা বলছে। এসব স্বপ্ন ও রূপকল্পের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। নির্বাচনের আগে সবাই ভালো ভালো কথা বলেন। প্রশ্ন হলো ক্ষমতায় গিয়ে তঁারা কে কী করেছেন, কী করছেন? কোনো দলের ভিশন বা রূপকল্প নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কিংবা কূটচালের প্রয়োজন নেই। কার ভিশন নকল কার ভিশন আসল সেটি জনগণকেই ঠিক করতে দিন। আগামী নির্বাচন (সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষে হওয়ার কথা) কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো রূপকল্প বা রোডম্যাপ এখনো আমরা পাইনি।
এক পক্ষ বলছে, নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। আরেক পক্ষ শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে আওয়াজ তুলছে। নির্বাচন নিয়ে দুই প্রধান দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান কিংবা অবিরাম কাদা ছোড়াছুড়ি জনমনে আশা জাগায় না, শঙ্কা বাড়ায়। আওয়ামী লীগ নেতারা যখন বলেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আসতেই হবে, তখনই সন্দেহ জাগে আওয়ামী লীগ কি সত্যি সত্যি চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আবার বিএনপি নেতারা যখন আওয়াজ তোলেন বিএনপি ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না, তখন তাঁদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, নির্বাচন ছাড়া কীভাবে তাঁরা ক্ষমতায় যেতে চান। নব্বই-পরবর্তী রাজনীতিতে কোনো দলই এককভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারেনি। প্রথম বিএনপি সরকারের সময়ে জামায়াতের সঙ্গে করা অলিখিত চুক্তিই দ্বিতীয় আমলে লিখিত রূপ পায়। আর ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে আওয়ামী লীগ এরশাদকে যে ছাড় দিয়েছিল, সেই ছাড়ের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে মহাজোট গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সাবেক স্বৈরাচারের দল ও আ স ম রবের সহায়তায় সরকার গঠন করেছিল। মাঝখানে একবার এরশাদ বিএনপির সঙ্গেও ভিড়েছিলেন।   নির্বাচন এলে আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। বিএনপি তার কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। অন্যান্য দলও তাদের কর্মসূচি তাদের জানাবে। এরপর জনগণই ঠিক করবে জনগণ কোনটি গ্রহণ করবে, আর কোনটি করবে না। সে জন্যই প্রয়োজন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ, সবার জন্য সমান সুযোগ। এক পক্ষ মাঠে-ময়দানে আগাম নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে আরেক পক্ষ ঘরে বসে থাকবে, তাতে তো খেলার মাঠ সমতল হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া বা করা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যতই আহ্লাদিত হোন না কেন, বড় চ্যালেঞ্জটি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমত জনগণ ১০ বছর আগে বিএনপি কী করেছে, সেসব কথা বলে ভোটারদের মন জয় করা যাবে না। তারা দেখতে চাইবে অতি সম্প্রতি কী ঘটছে।
দ্বিতীয় নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে না পারলে মাগুরার পুনরাবৃত্তি ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। এখন মানুষ আরও বেশি সচেতন, সংবাদপত্র ছাড়াও ২৭টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের চোখ থাকবে নির্বাচনের ওপর। তাই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করা বিএনপির জন্য যতটা না বড় চ্যালেঞ্জ, তার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য। বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে এলে একটি পরীক্ষা হয়ে যেত। তারা আসেনি বলে পরীক্ষাটি তখন হয়নি। এখন আওয়ামী লীগকে নতুন করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। তবে আওয়ামী লীগকে সেই চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে আরও কতগুলো বাছাই পরীক্ষা দিতে হবে। এসএসসি পরীক্ষার আগে যেমন টেস্ট বা বাছাই পরীক্ষা হয়, তেমনি জাতীয় নির্বাচনের আগেও অনেকগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরীক্ষা সামনে রয়েছে। বিশেষ করে আগামী বছর মাঝামাঝি সময়ে কিংবা তার আগেই রাজশাহী, গাজীপুর, সিলেট, রংপুর, খুলনা, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, ফরিদপুর সিটি করপোরেশন করে তিন মাসের মধ্যে সেখানেও নির্বাচন হবে। এর আগে ময়মনসিংহ বিভাগ করা হলেও সিটি করপোরেশন ঘোষণা করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে পারি ময়মনসিংহ সিটি করপোরশনের নির্বাচনও হবে। এসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হয়, কীভাবে হয়, কতটা সুষ্ঠু হয় তার ওপরই নির্ভর করছে জাতীয় নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে নিজেদের রূপকল্প ঘোষণার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ বা রূপকল্প ঘোষণা করতে যাচ্ছে, তাকে সর্বতোভাবে সহায়তা করা। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই এগিয়ে আসতে হবে। একটি সহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দেওয়া যদি ভূতের মুখে রাম নাম হয়,
তাহলে আওয়ামী লীগকে সেটি বাস্তবে করে দেখাতে হবে। তার নিজের জন্য যা জায়েজ তা অন্যের জন্যও জায়েজ করতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, সব রাজনৈতিক দল একমত না হলে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করবেন না। নির্বাচন কমিশনের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিরোধী দলের আস্থা অর্জন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে যদি প্রাক্‌-বাছাই বা প্রি-টেস্ট বলি, তাতে তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন টেস্টেও তাঁদের ভালো করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দল একবার জনগণ দ্বারা ধিক্কৃত হলেও ফের তাদের কাছে যেতে পারে। অতীতের ভুলত্রুটি শুধরে কিংবা ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়াও অসম্ভব নয়।  কিন্তু নির্বাচন কমিশন একবার আস্থা হারালে আর জনগণের কাছে যেতে পারবে না। তখন তাদের পক্ষে নির্বাচন করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভবও বটে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিশন বা রূপকল্পের পাশাপাশি আগামী নির্বাচন তথা ২০১৮ সালের জন্য একটি রূপকল্প চাই। সুষ্ঠু নির্বাচনের রূপকল্প।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.