পাবনায় ১৬ মাসে ৭১ নারী খুন

বছরখানেক আগে পাবনার বেড়া উপজেলার জাকিয়া বেগমের বিয়ে হয়েছিল পাশের সুজানগর উপজেলার ভুরকুলিয়া গ্রামের আবদুল হাইয়ের সঙ্গে। ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা জাকিয়াকে স্বামী চাপ দিচ্ছিলেন গর্ভপাতের জন্য। রাজি না হওয়ায় গত ১৭ এপ্রিল রাতে জাকিয়াকে বেদম পেটান স্বামী। খবর পেয়ে পরদিন জাকিয়ার পরিবারের লোকজন তাঁকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে জাকিয়া মারা যান। গত ১৬ এপ্রিল পাবনা শহরের বুদেরহাট এলাকায় গৃহবধূ নুরুন্নাহারকে শিল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। স্বামী নূরুল ইসলামের অনৈতিক সম্পর্কের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে অভিযোগ। এর পরদিন ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়ায় খুন হন সাদিয়া খাতুন। অভিযোগ, যৌতুক না পেয়ে স্বামী সাইফুল ইসলাম তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। শাপলা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক সিদ্ধান্তে। তাঁর গায়ের রং কালো। এ নিয়ে স্বামী চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়ার গোলজার হোসেন নিত্যই লাঞ্ছনাগঞ্জনা, এমনকি মারধর করতেন। গত ৫ জানুয়ারি পিটুনিতে শাপলাকে প্রাণই হারাতে হয়। গোলজারকে লোকজন আটক করে থানায় সোপর্দ করেন। জাকিয়া, নুরুন্নাহার, সাদিয়া, শাপলার মতো গত ১৬ মাসে (গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) পাবনায় ৭১ জন নারী খুন হয়েছেন। একই সময়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৮ জন।
এই তথ্য পাওয়া গেছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক পরিসংখ্যানে। বিভিন্ন সংস্থার মতে, জেলায় যৌতুকসহ নানা কারণে হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা ও নারী নির্যাতন বাড়ছে। গত রোববার সুজানগরে গেলে জাকিয়া বেগমের মামা দুলাল খাঁ প্রথম আলোকে বলেন, যৌতুকের জন্য জাকিয়ার ওপর চাপ দিতেন স্বামী আবদুল হাই। এর মধ্যে জাকিয়া অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে গর্ভপাত করাতে চাপ দেন। এখন মামলা তুলে নিতে আবদুল হাইয়ের পরিবার চাপ দিচ্ছে। জেলায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছেন ব্র্যাকের কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট ব্যবস্থাপক নয়ন কুমার মণ্ডল। গত সোমবার তিনি বললেন, ব্র্যাকের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাবনায় গত বছর ৫৭টি খুন, ৮ নারী ও ১৬ শিশু ধর্ষণ, ৩০টি শারীরিক নির্যাতন, ৪৬টি আত্মহত্যা ও অন্যান্য ধরনের ১২টি নির্যাতনের ঘটনার তথ্য তাঁরা সংগ্রহ করেছেন। এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত ১৪টি খুন, ৫ নারী ও ৩ শিশু ধর্ষণ, ১৮টি শারীরিক নির্যাতন ও ১৮টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, পৌরসভা ও ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে তাঁদের ‘পল্লিসমাজ’ নামের বিশেষ কমিটি নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি ও তথ্য সংগ্রহসহ বিভিন্ন কাজ করছে। নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা দেয় বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। ব্লাস্টের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে জেলায় নারী নির্যাতনের মোট মামলা হয়েছিল ২২৮টি, ২০১৬ সালে হয় ২৪৪টি আর চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত হয়েছে ১০১টি। বেশি মামলা হচ্ছে যৌতুক, খোরপোশ আদায় ও শারীরিক নির্যাতন নিয়ে। জেলা ব্লাস্টের সভাপতি আইনজীবী আলমগীর হোসেন বলেন, পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা অনেক বেড়েছে। গত নভেম্বর থেকে পাবনায় নারী ও শিশু আদালত বিচারকশূন্য।
গত সোমবার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুস সামাদ খান বলেন, অতিরিক্ত দায়রা জজ প্রথম আদালত অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নারী ও শিশু আদালতের বিচারকাজ করছেন। সপ্তাহে এক দিন মামলা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। বিচারিককাজ প্রায় বন্ধ। আদালতে ১ হাজার ৫২৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, জেলায় প্রতিবছর প্রায় ১০ শতাংশ হারে নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলা বাড়ছে। জেলায় নারী নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মাদক ও দারিদ্র্য। বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহকে পাবনায় নারী নির্যাতনের একটি প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন মানবাধিকার আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘পাবনা প্রতিশ্রুতি’-এর উপসহকারী পরিচালক আবদুল আহাদ বলেন, নারী নির্যাতনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলে নির্যাতনের পরিমাণ কমে যেত। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর যথার্থ কার্যকর ভূমিকা নেই বলে মনে করেন জেলা নির্যাতন প্রতিরোধ নেটওয়ার্কের যুগ্ম সচিব শামসুন্নাহার। পাবনার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামীমা বেগমের নেতৃত্বে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেল নির্যাতিত নারীদের সহায়তা দেয়। এ ছাড়া থানায় থানায় কমিউনিটি পুলিশের মাধ্যমে সভা করে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ, মাদক ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.