এ দেশের আফনান ও দেশে মাস্টারশেফ

হেঁশেলে রান্না করছেন মা, তাঁর আঁচল ধরে পাশেই দাঁড়িয়ে সন্তান। এমন ছবি তো চিরায়ত। কিন্তু এমন হেঁশেল কি খুব একটা দেখা যায়, যেখানে মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাঁধবে ১২ বছরের ছোট্ট ছেলেটিও। আফনানের বাসার দৃশ্যপট এমনই। আফনান নয়, আফনানের মা তাঁর ছেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাঁধেন প্রায় দিনই। তাও সব সময় টেক্কা দিতে পারেন না খুদে সেই রন্ধনশিল্পীকে। পারবেনই বা কী করে, ছেলে যে ‘মাস্টারশেফ’। রান্নাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা (রিয়েলিটি শো) ‘মাস্টারশেফ জুনিয়র ইউএস’-এর পঞ্চম মৌসুম চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খুদে রন্ধনশিল্পী খুঁজে বের করতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবারের যুক্তরাষ্ট্রের অনুষ্ঠানটি আমাদের জন্য সবিশেষ। এবারই কোনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খুদে রন্ধনশিল্পী সেরা দশে জায়গা করে নিল। সেই রন্ধনশিল্পীর নাম আফনান আহমেদ। বাংলাদেশের দর্শকেরা এই অনুষ্ঠানের অষ্টম পর্ব দেখবেন কাল রোববার। আর যুক্তরাষ্ট্রের দর্শকেরা এরই মধ্যে চূড়ান্ত পর্বের কাছাকাছি দেখে ফেলেছেন। পর্ব প্রচারের দিক থেকে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আমরা আজ আফনানের মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতার ফলাফলে যাব না, আমরা কথা বলব নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে বড় হওয়া বাংলাদেশের এই ছেলেকে নিয়ে। সেই আফনান, যে ভিনদেশি এক রিয়েলিটি শোতে নানাভাবে বাংলাদেশ এবং দেশি খাবারকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আফনান আহমেদ এখন পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার ইউনিয়ন গ্রুভ মিডেল স্কুলে, সপ্তম শ্রেণিতে। সামনেই বার্ষিক পরীক্ষা তার। পড়ালেখা, প্রতিযোগিতার চাপ সব সামলে আফনান প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলল। জানাল তার ‘মাস্টারশেফ জুনিয়র’-এর সফরের কথা। পরিপাটি ছেলেটি টিভিতে ইংরেজিতে কথা বললেও ফোনে কথা বলার শুরুতেই শুদ্ধ বাংলা বলে, ‘কেমন আছেন?’ এরপর বলতে থাকল মাস্টারশেফের অভিজ্ঞতা। মাস্টারশেফ জুনিয়র ইউএস-এর প্রথম ধাপে আফনান ৫ হাজার শিশুর মধ্য থেকে সেরা ৫০ খুদে শেফের তালিকায় উঠে আসে। সেখান থেকে সেরা ৪০, এরপর ২৪ এবং সবশেষ সেরা ১০-এ। আফনান এ পর্যন্ত অনেকের চেয়ে এগিয়ে আছে। কয়েকবার সে জিতেছে ইমিউনিটি চ্যালেঞ্জ, চলে গেছে সেফ জোনে। তার রান্না করা রেসিপি হয়েছে প্রতিযোগিতায় সেরা। বিখ্যাত শেফ গর্ডন র্যামসে ও ক্রিস্টিনা টোসিও আফনানের রান্নায় মুগ্ধ। আফনানের মা শামীমা এবং বাবা সৈয়দ সোহেল আহমেদ প্রায় বছর ২০ আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। আফনানের জন্মও সে দেশেই। তবে দেশে আছে আফনানের দাদা-দাদিসহ পুরো পরিবার।
চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে আফনানের দাদাবাড়ি, আর আলকরনে নানাবাড়ি। বেশ কয়েকবার বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছে বাংলাদেশে। শেষবার আফনান দেশে এসেছিল চার বছর আগে। সে সময় ঢাকায় ও চট্টগ্রামে থাকা পরিবারের সঙ্গে লম্বা সময় কাটিয়েছে আফনান। দেশের কথা জিজ্ঞেস করতেই আফনান বলল, ‘স্কুলে ভ্যাকেশন (ছুটি) শুরু হলে দেশে আসতে চাই। সবার সঙ্গে দেখা করতে চাই। দেশে এসে যারা আমার রান্না পছন্দ করেছে, তাদের সঙ্গে রান্না নিয়ে কথা বলতে চাই।’ মা শামীমার কাছ থেকে আফনানের রান্নার হাতেখড়ি। মায়ের কাছ থেকে দেশি কায়দায় মসলা দিয়ে গরুর মাংস রান্না করতে শিখেছে আফনান। তবে মায়ের হাতে কালাভুনার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো ডিশ রান্না করার সাহস নাকি আফনান এখনো করতে পারে না। আফনান বলে, ‘দেশি খাবার আমার খুব পছন্দের। বিশেষ করে আমাদের চিটাগংয়ের খাবার। মায়ের হাতের মেজবানি গোশত খুব মজা হয়। আমি এখনো ওটা রাঁধতে পারি না। মা টমেটো-আলু দিয়ে তেলাপিয়া মাছ রান্না করে, সেটাও আমার খুব প্রিয়।’ রান্না নিয়ে আফনানের ভাবনাগুলো খুব আধুনিক। দেশি খাবারকে তুলে ধরতে চায় ভিনদেশি উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। আফনান তার এই ভাবনাকে বলছে ‘গ্লোবাল’ ফিউশন। প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকবার সে এভাবেই দেশি খাবারের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ধারা মিলিয়েছে। খিচুড়ি রান্না করেছে, রুটি বানিয়েছে, তবে সবকিছুতেই যোগ করেছে পশ্চিমা উপস্থাপনার কায়দা। আফনান বড় হয়ে হতে চায় নিউরোসার্জন। আর রান্না নিয়ে স্বপ্ন হলো, বাংলায় একটা টিভি শো করার ইচ্ছা তার। সেখানে দেশি খাবারগুলো নিয়ে আফনানের যত আধুনিক ভাবনা, সবই তুলে ধরতে চায়।

No comments

Powered by Blogger.