শাফাত ও সাকিফ রিমান্ডে

বনানীতে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামিদের বাঁচাতে নানা চেষ্টা-তদবিরের পরও শেষরক্ষা হলো না। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপের মুখে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত আহমেদ ও রেগনাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাকিফকে গত বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার তাঁদের আদালতে হাজির করে শাফাতকে ছয় দিন ও সাদমানকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। এ মামলার অন্য তিন আসামি এখনো পলাতক। ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা দায়ের করেন ধর্ষণের শিকার হওয়া এক ছাত্রী। কিন্তু মামলা দায়েরের আগে থেকেই বনানী থানা ও গুলশান বিভাগ পুলিশের কর্মকাণ্ডে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। অভিযোগ ওঠে এক রাজনৈতিক নেতার প্রভাবে পুলিশ আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৃষ্টি হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেন। একপর্যায়ে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে আসামি গ্রেপ্তারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এরপরই অভিযানে নামতে বাধ্য হয় পুলিশ। দুই আসামি গ্রেপ্তার এবং পুরো ঘটনা সম্পর্কে জানাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এলে থানা-পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন।
জবাবে তিনি বলেন, বনানী থানার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও দুজন যুগ্ম কমিশনারের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘এই মামলায় আমরা সব অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে শতভাগ পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছি এবং করব। সেই প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে পুলিশের যে ভুল বোঝাবুঝি ও দেশবাসীর মধ্যে যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা থাকবে না। তদন্তটি মডেল ইনভেস্টিগেশন হয়ে থাকবে।’ তবে গত ২৮ মার্চ ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া ওই মামলার বাকি তিন আসামিকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পলাতক তিন আসামি হলেন ইমেকার্স ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের স্বত্বাধিকারী নাঈম আশরাফ, শাফাত আহমেদের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ। দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ তাঁদের জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। তবে তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা এবং এ ঘটনার পেছনে আর কেউ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। যুগ্ম কমিশনার বলেন, তদন্ত কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। সব তথ্য উপস্থাপন করা সমীচীন হবে না।
এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এক বিবৃতিতে বলেন, ধর্ষণের ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পরই মামলা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট থেকে দুই আসামিকে ঢাকায় আনার পর গতকাল সকাল থেকে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। এরপর বিকেলে তাঁদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তার করা রিমান্ড আবেদনের ওপর মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলামের আদালতে শুনানি হয়। আদালতের আদেশের পর তাঁদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।  এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে দিলদার ও শাফাত আহমেদের ব্যাংক হিসাব চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে, বহুল আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা চাপা দিতে বিপুল অর্থ খরচের চেষ্টা হয়েছে। এই অর্থের উৎস ‘ডার্টি মানি’ কি না, তা ছাড়া তাঁদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ‘অস্বচ্ছ’ কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই দুজনের পাশাপাশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপন জুয়েলার্সেরও ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।
যেভাবে গ্রেপ্তার
ঢাকায় পুলিশ বলেছে, ৫ মে রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে খোঁজখবর শুরু হওয়ার পরই শাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ ঢাকা ছাড়েন। তবে তাঁরা সিলেটে পৌঁছান ৮ মে। সিলেট থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সিলেটের পশ্চিম পাঠানটুলায় ‘রশীদ ভিলায়’ শাফাত ও সাকিফকে রাখা হয়েছিল। বাড়ির মালিক যুক্তরাজ্যপ্রবাসী মামুনুর রশীদ। শাফাতের এক আত্মীয় ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক নূরুন্নবীকে বলে তাঁদের দুজনের থাকার ব্যবস্থা করেন। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক নূরুন্নবী বলেন, তাঁরা জানতেন না যে ওই দুই তরুণ ধর্ষণ মামলার আসামি। সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল সিলেটের গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতায় দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। সংবাদ সম্মেলনে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার বলেন, ৮ মে দুপুর থেকে দুজন সিলেটে অবস্থান করছিলেন বলে পুলিশের কাছে খবর ছিল। শাফাত ও সাদমান তাঁদের মুঠোফোনসহ অন্যান্য ডিভাইস বন্ধ করে লুকিয়ে ছিলেন। তবে সিলেটে থাকা শাফাতের এক মামার মুঠোফোনে দুজনের ফোনালাপের প্রমাণ পাওয়া যায়। মামাকে ধরার পর শাফাত ও সাদমানের অবস্থান জানা যায়। প্রযুক্তির মাধ্যমে পুলিশ শাফাতের অবস্থান সিলেট নগরের পশ্চিম পাঠানটুলার রশীদ ভিলায় বলে নিশ্চিত হয়।
ধর্ষণ মামলা নিয়ে পুলিশ যা করল
মামলা দায়েরের পর থেকে বনানী থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ আসামি গ্রেপ্তারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার মামলার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করা হচ্ছিল। তবে অব্যাহত চাপের মুখে পুলিশের মহাপরিদর্শক বুধবার পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দলকে অভিযানের নির্দেশ দেন। সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান এই দলে নেতৃত্ব দেন। এর এক দিন পরই সিলেট মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতায় দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় গতকাল বলেন, অভিযানে বনানী থানা, উইমেন সাপোর্ট সেন্টার, ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ তৎপর ছিল। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দলও যোগ দেয়। ধর্ষণের ঘটনা ঘটার এক মাসের বেশি সময় পর মামলা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল পুলিশ। তবে এখন বলছে, যথাসময়ে মামলা না হওয়ায় তদন্তের ক্ষেত্রে যে অসংগতি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করছে তারা। কৃষ্ণপদ রায় বলেন, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ যেন নষ্ট না হয়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনা প্রমাণ করতে পারিপার্শ্বিক যত সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে, ‘ফিজিক্যাল’, ‘ওরাল’ সবই বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা যে ভিডিওর কথা বলেছেন, তা পাওয়া গেছে কি না বা হোটেল রেইনট্রি কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না—এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে গেছেন কৃষ্ণপদ রায়। তিনি বলেন, সব বিষয় মাথায় নিয়েই পুলিশ এগোচ্ছে। তিনি বলেন, আসামি গ্রেপ্তার ও তদন্ত সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ), উপকমিশনার গুলশান, উপকমিশনার উইমেন সাপোর্ট সেন্টার, উপকমিশনার গোয়েন্দা বিভাগকে (উত্তর) নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে।
দুই ছাত্রীর জবানবন্দি
রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে ধর্ষণের শিকার দুই ছাত্রী বৃহস্পতিবার আদালতে জবানবন্দি দেন। ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন তাঁর খাসকামরায় বেলা একটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। জবানবন্দিতে দুই ছাত্রী জানান, গত ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে তাঁদের নেওয়া হয়। শাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাঁদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলে যাওয়ার আগে দুজনই জানতেন না সেখানে পার্টি হবে। এ সময় তাঁদের সঙ্গে শাহরিয়ার নামের এক বন্ধু ছিলেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। হোটেলে যাওয়ার পর শাফাত ও নাঈমের সঙ্গে তাঁরা আরও দুই তরুণীকে দেখেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় শাহরিয়ারসহ দুই তরুণী চলে আসতে চেয়েছিলেন। তখন আসামিরা শাহরিয়ারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেন এবং তাঁকে মারধর করেন। এরপর দুই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে একটি কক্ষে নিয়ে যান। ধর্ষণ করার সময় শাফাত গাড়িচালককে ভিডিও চিত্র ধারণ করতে বলেন।
আর নাঈম তাঁদের মারধর করেন। তাঁরা এ ঘটনা জানিয়ে দেবেন বলে জানানোর পর শাফাত তাঁর দেহরক্ষীকে ওই দুই তরুণীর বাসায় তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিকভাবে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন আসামিরা। তাঁদের কথামতো না চললে বা এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। বাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সে সময় অনেক চিৎকার করেছি। ওদের পায়ে ধরেছি। আর ভেবেছি রেইনট্রিতে কেউ নেই? আমাদের চিৎকার কেউ শুনতে পেল না?’ ৬ মে রেইনট্রির মহাব্যবস্থাপক ফ্র্যাঙ্ক ফরগেটের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, হোটেলের দুটি কক্ষ শাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের নামে বুকিং দেওয়া ছিল। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আর কেউ ছিলেন কি না, সে খবর তাঁরা জানেন না। ২৯ তারিখ সকালে স্বাভাবিকভাবে তাঁরা কক্ষ ছেড়ে যান। সে সময়ও তাঁরা অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি। এক মাস পর তাঁরা ভিডিও ফুটেজ রাখেন না। সে কারণে ওই দিনের ভিডিও ফুটেজও নেই।
ঘটনাক্রম
২৮ মার্চ: রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীকে আটকে ধর্ষণ
৬ মে: থানায় ধর্ষণ মামলা
৭ মে: ঢাকা মেডিকেলে দুই ছাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা
৮ মে: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি গঠন
১০ মে: ঘটনার প্রাথমিক সত্যতার কথা স্বীকার ডিএমপি কমিশনারের
১১ মে: শাফাত ও সাকিফ সিলেট থেকে গ্রেপ্তার

No comments

Powered by Blogger.