জালিয়াত শিক্ষক ধরতে অভিযানে নামছে দুদক

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাল সনদে চাকরিরত শিক্ষকদের ধরতে অভিযানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যেসব শিক্ষক জাল নিবন্ধন ও শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদে চাকরি নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে প্রথমে সনদ জব্দ করা হবে। পরে জালিয়াতদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) এ কাজে দুদককে সহায়তা করছে। এ জন্য ডিআইএ’র একটি টিম রোববার চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক আহাম্মেদ সাজ্জাদ রশিদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন তদন্তে জাল সনদে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি নেয়ার অভিযোগ বেরিয়ে আসে। ওইসব বিষয়ের ওপর এখন দুদক কাজ করছে। সংস্থাটির বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কে বা কারা জাল সনদে চাকরি করছেন সেই তথ্য চাওয়া হয়েছে। আমরা চাহিদামতো তথ্য সরবরাহ করছি।’ ডিআইএ সূত্র জানায়, জাল সনদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য ফেব্রুয়ারিতে সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। সে অনুযায়ী বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কয়েক দিন আগে দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের স্বাক্ষরে পাঠানো চিঠিতে ঢাকা অঞ্চলের ৫টি জেলার জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম-২ অঞ্চলের সহকারী পরিচালক নারগিস সুলতানা ওই বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরতদের তথ্য চান। এভাবে বিভিন্ন অফিস থেকে দুদকের কর্মকর্তারা ডিআইএতে চিঠি দিতে থাকেন। এসব চিঠি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চার ধরনের জাল সনদের ওপর দুদকের কাজ চলছে।
এগুলো হচ্ছে- কম্পিউটার শিক্ষক, লাইব্রেরিয়ান, বিএড ডিগ্রি ও নিবন্ধন সনদে চাকরি গ্রহণকারী। ডিআইএতে ২৫ এপ্রিল পাঠানো চিঠিতে নারগিস সুলতানা উল্লেখ করেন, (জাল সনদের) অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে জাল সনদের মূল কপি ও দাফতরিক রেকর্ডপত্র প্রয়োজন। পরে ৮ মে আরেক চিঠিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় জাল সনদে কর্মরতদের তালিকা চাওয়া হয়। ১৪ মের মধ্যে এসব তালিকা পাঠাতে বলা হয়। এ দুই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ডিআইএ তথ্য সরবরাহ করেছে। সর্বশেষ চিঠিতে চাওয়া তথ্যসহ সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা ও একজন কর্মচারীকে আজ শনিবার চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। তারা কাল রেকর্ডপত্র ও তালিকা হস্তান্তর করবেন। ডিআইএ পরিচালক বলেন, ‘আমাদের তদন্তে জাল সনদ জব্দের কোনো বিধান নেই। সনদ ব্যক্তির সম্পদ। সে কারণে তদন্তকালে আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকের স্বাক্ষরিত সনদপত্রের ফটোকপি নিয়ে আসি। পরে তা সনদ ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষা করানো হয়। এ পর্যন্ত যে কটি সনদ জাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সবক’টি এ প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করা হয়। আমরা দুদককে এসব তথ্যই সরবরাহ করছি।’ জানতে চাইলে দুদকের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মোরশেদ আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি ঢাকা-২ অঞ্চল নিয়ে কাজ করি। এ অঞ্চলে মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলা আছে। এসব জেলায় জাল সনদের নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।’ চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, ‘গোটা চট্টগ্রাম বিভাগ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ বিভাগের কাজ ৫ জনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।’ উভয় কর্মকর্তা জানান, তারা প্রথমে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছে। এরপর জাল সনদ জব্দ করা হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে।
সেখান থেকে অন্যান্য রেকর্ড ও নথি সংগ্রহ শেষে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করা হবে। এরপর অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে মামলার সুপারিশসহ প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। পরে মামলা হবে। জানা গেছে, দুদকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে রংপুর অঞ্চলের ৪৫ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেটিও পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এভাবে ডিআইএর ৪টি প্রশাসনিক বিভাগের তদন্তে চিহ্নিত জালিয়াতদের তালিকা সমন্বিত করার কাজ চলছে। ডিআইএ ও দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৩১টি জাল সনদ ধরা পড়েছে। এরপর আরও ৫৭টি জাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এরমধ্যে ৯ মে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয় কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসি) ১৬টি সনদ নিরীক্ষার প্রতিবেদন পাঠায়। তাতে দেখা গেছে, ১২টিই জাল। জানা গেছে, ৫৩১টি জাল সনদের মধ্যে ৩৪০টি নিবন্ধনের, ১৫১টি কম্পিউটার ও সাচিবিক বিদ্যার এবং ৪০টি বিএড, শারীরিক শিক্ষাসহ অন্যান্য শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ। এসব সনদধারী সরকারের ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা লোপাট করেছেন। এরমধ্যে শিক্ষক নিবন্ধনধারীদের কাছে ফেরতযোগ্য টাকার পরিমাণ ৬ কোটি ৬৭ লাখ ১৮ হাজার টাকা। কম্পিউটার ও সাচিবিক শিক্ষার শিক্ষকদের কাছে পাওনা ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অন্য সনদধারীরা বেতন নিয়েছেন ১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। জাল সনদধারীদের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে ২২০ জন। সর্বশেষ চিহ্নিত ৫৭ জনের ৪৫ জন একই অঞ্চলের। বাকি ১২ জনের এলাকা জানা যায়নি। এছাড়া ঢাকা অঞ্চলে ১৬৮ জন, চট্টগ্রামে ১৫ জন ও খুলনায় ১২৪ জন আছে। তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই জাল সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হচ্ছে বলে জানান ডিআইএ’র যুগ্ম-পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, বর্তমানে এ সংখ্যা ১২ শতাধিক হবে।
এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবল সুশাসনই নয়, মানসম্পন্ন শিক্ষা বিঘ্নিত করছে। ডিআইএ’র উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদের মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই বেশি। আমরা ইতিমধ্যে দারুল ইহসান, শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটির সন্দেহজনক সনদ পেয়েছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জনের সনদে একই দিনে একাধিক উপাচার্যের স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। এ কারণে বিষয়টি সন্দেহজনক হওয়ায় এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে আমরা চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সংস্থাটি ৬ মাসেও তার উত্তর দেয়নি। এ ঘটনা উদ্বেগজনক।এদিকে জাল সনদের ইস্যুতে দুদক অনুসন্ধান কাজ শুরু করায় ডিআইএ’র কর্মকর্তারা বেজায় খুশি। তারা বলেছেন, জাল সনদবিরোধী লড়াইয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রভাবশালীদের পাশে পাচ্ছেন না। তাই দুদক ব্যবস্থা নিলে তাদের কষ্ট সার্থক হবে। ডিআইএ’র এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, একজন ব্যক্তির বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ থেকে শুরু করে এমপিওভুক্তি (সরকারি বেতন) পর্যন্ত অন্তত ১০ ঘাটে সনদ যাচাই হয়। কিন্তু ১০টি স্তর পার করেই জালিয়াতরা সরকারের টাকা নেন। এগুলো হচ্ছে নিয়োগ কমিটি, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও সভাপতি,
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, অধিদফতরের ডিলিং কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক, পরিচালক ও মহাপরিচালক। পরিচালক ও মহাপরিচালক বাদ দিলেও বাকি ধাপগুলো পার পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। এদিকে ডিআইএ তদন্তে জালিয়াতি ধরলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা রহস্যজনক কারণে অপরাধীদের পার করে দেন বলে অভিযোগ আছে। ডিআইএর এক তদন্তে মাদারীপুরে রাজৈর উপজেলার সাতবাড়িয়া নূরে মোহাম্মদী মাদ্রাসার কম্পিউটার শিক্ষিকার সনদ জাল প্রমাণিত হয়। কিন্তু ডিআইএর বক্তব্য না শুনেই মন্ত্রণালয় সনদের আপত্তি থেকে মুক্তি দেয়। এক্ষেত্রে ১২ মার্চ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের সুপারিশে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ব্যাপারে ডিআইএ’র সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ডিআইএ ভুল রিপোর্ট দিয়েছে। তাহলে এ অপরাধে ডিআইএকে শাস্তি দেয়া উচিত। নইলে ডিআইএর আপত্তি চ্যালেঞ্জপূর্বক জালিয়াতির শাস্তি দেয়া উচিত।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, এভাবে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বেশকিছু জালিয়াতির ঘটনা ছেড়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৮ অক্টোবর যুগান্তরের শীর্ষ প্রতিবেদন ছিল, ‘বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা : জাল সনদে বেশুমার শিক্ষক।’

No comments

Powered by Blogger.