ঈশ্বরদীতে আর্সেনিকে দশ বছরে মারা গেছে ১১৫ জন

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে আর্সেনিকের ভয়াবহতা মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। ওই গ্রামে গত ১০ বছরে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে ১১৫ জন মৃত্যুবরণ করেছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর রয়েছেন ৩৫০ জন। রুপপুর এলাকার যুবক-যুবতীদের বুকে আছে চাপাকান্না, সামর্থ ও যোগ্যতা থাকা সত্বেও আর্সেনিকের কারণে তাদের বিয়ে হয়না। অন্য গ্রামের কোন ছেলে-মেয়ে ওই গ্রামে বিয়ে করতে চায়না শুধুমাত্র আর্সেনিক আতঙ্কে। ঈশ্বরদী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বেসরকারী সংস্থা নিউ এরা ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর, নলগাড়ি, চররূপপুর, নদীপাড়া, বিবিসি বাজারপাড়া, খান পাড়া, বাদুরপাড়া, সরদার পাড়া, বিশ্বাস পাড়া, মহাবুল মেম্বরের পাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগির সংখ্যা বাড়ছেই। মাঝে মধ্যে আর্সেনিকে আক্রান্তরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর রয়েছেন ৩৫০ জন। অথচ ঈশ্বরদীতে এই রোগের কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে, শুধুমাত্র রূপপুর গ্রামে গত ১০ বছরে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ১১৫ জন। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ২১ এপ্রিল রূপপুর নলগাড়ি গ্রামে সুজন (২৫) ও বাবু (৪৫) নামের দুই চাচাতো ভাই আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সুজন ওই গ্রামের আমিরুল মালিথার ছেলে ও বাবু ইয়াছিন মালিথার ছেলে। এছাড়া ইতিপূর্বে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে রূপপুরের নলগাড়ী গ্রামের একটি বাড়িতেই মারা গেছেন ওই বাড়ির ১১ সদস্য। ওই বাড়ির সদস্য মতিয়ার রহমান জানান, তার বাড়ির ১১ জন সদস্য এ পর্যন্ত আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি জানান, প্রথমদিকে তারা এ রোগ সম্পর্কে জানতেন না, প্রথমে শরীরে কালো তিলের মতো দাগ হতো। এরপর ধীরে ধীরে অসুস্থ্য হয়ে এক সময় অনিবার্য মৃত্যু। সম্প্রতি সরেজমিনে রূপপুর নলগাড়ি গ্রামে গিয়ে আর্সেনিকে আক্রান্ত লালু প্রামানিক (৩২) ও তার স্ত্রী সীমা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। সীমা খাতুন জানান, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ও ভাসুর ইতিমধ্যে মারা গেছেন। স্বামী লালু প্রামানিক দুই হাত-পা ও সারা শরীরে আর্সেনিকের কারনে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ স্বেতী রোগের মত সাদা ছোপ ছোপ দাগ হয়ে গেছে। লালু প্রামানিক জানান, আমি ট্রাক্টরে বালু শ্রমিকের কাজ করি, এ রোগের কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, তাই আল্লাহর ওপর ভরসা করে বেঁচে আছি, যেদিন মরন হয় হবে। আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত শাহনাজ পারভিন জানান, প্রথম দিকে আমরা জানতাম না যে, পানি পান করলে আর্সেনিক রোগ হয়। এছাড়া এটা আর্সেনিক রোগ তাও আমরা জানতে পারিনি। এই রোগে আমাদের গ্রামের অনেক মানুষ মারা গেছে। কয়েক বছর আগে ঢাকা থেকে একদল ভদ্রলোক এসে পানি পরীক্ষা করে প্রথম আমাদের জানালেন, এটা আর্সেনিক রোগ। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার ফলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এই এলাকার হাতে গোনা দু’একটা বাদে প্রায় প্রতিটি বাড়ির টিউবওয়েলেই আর্সেনিকের উপাদান থাকায় টিউবওয়েলগুলিতে লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। স্থানীয় বাসিন্দা শিক্ষক মনিরুল ইসলাম জানান, পাকশী ইউনিয়নের বৃহত্তর রূপপুর গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রূপপুরের বাসিন্দা এনামুল হক জানান, গোটা এলাকাতে আর্সেনিক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে এই এলাকার প্রচুর মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে এই এলাকার অন্ততঃ ১০/১২ জন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। এলাকাবাসী জানান, সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোন সহযোগিতা পায়নি এই এলাকার মানুষ। পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস জানান, বাংলাদেশে আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার মধ্যে ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামকে শীর্ষস্থানীয় এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে শুধু রূপপুর গ্রামেই দত দশ বছরে ১১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এই রোগে। এলাকায় আর্সেনিকের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অথচ সরকারী-বেসরকারী কোনভাবেই এখানে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। উপজেলঅ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও দুএকটি বে-সরকারি সংগঠন আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা এবং আক্রান্ত এলাকায় কাজ করে আর্সেনিকের ভয়াবহ যে মাত্রা পেয়েছে তা অত্যন্ত ভীতিকর। নিউ এরা ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়ক মোস্তাক আহমেদ কিরণ জানান, বিশুদ্ধ পানির অভাব দূর করতে নিউ এরা ফাউন্ডেশন ইতিপূর্বে প্রায় ২২০ ফুট গভীরে পাইপ লাইন স্থাপন করে বিনামূল্যে ৩৮টি টিউবওয়েল ও দুটি আর্সেনিক আয়রন রিমুভার প্ল¬¬ান্ট ট্যাঙ্ক স্থাপন করেছে এবং ২৫০ জন আর্সেনিক রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ২ বছর ধরে তাদের এসকল কর্মকান্ডও বন্ধ রয়েছে। পাকশী ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বর মহিবুল ইসলাম জানান, তিনি নিজেও আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত। এ এলাকায় আর্সেনিক মহামারী আকার ধারণ করেছে উল্লে¬খ করে তিনি বলেন, এখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির বড়ই অভাব। বেশ কয়েক বছর আগে একটি সংস্থা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পান করার জন্য ডিসিএইচ মালয়েশিয়া ও ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের সহযোগিতায় ১০০টি সিমেন্টের ঢোপ টাইপের পাত্র বানিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো এখন অকেজো হয়ে বাড়ির উঠানের জায়গা দখল করে আছে। এই এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য দুইটি মেশিন স্থাপন করা হয়েছিল। সেই মেশিনের একটি দীর্ঘ দিন থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, তা দেখার বা খোঁজ নেওয়ারও কেউ নেই। এই এলাকায় এখনো ৩৫০ জন চিহ্নিত আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী রয়েছে বলে জানান তিনি। এলাকাবাসী জানান, আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের গায়ে, হাতে, পায়ে ফোসকা জাতীয় এবং তিলের মতো কালো ধরনের চিহ্ন রয়েছে। এই এলাকার যুবক-যুবতীদের বুকে আছে চাপাকান্না, যোগ্যতা থাকা সত্বেও আর্সেনিকের কারণে তাদের বিয়ে হয়না। অন্য এলাকার কোন ছেলে-মেয়ে এই এলাকায় বিয়ে করতে চায়না শুধুমাত্র আর্সেনিকের কারণে। এলাকাবাসী আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য সরকারের নিকট বিশুদ্ধ পানির গভীর নলকূপ স্থাপনের জোর দাবি জানিয়েছেন। পাকশী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস বলেন, পাকশী ইউনিয়নে আর্সেনিকের মাত্রা অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। এখানে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ক্রমান্বয়েই আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬¬ক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসমা খান জানান, ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ৬শ’ জন আর্সেনিক রোগীকে চিকিৎসা ও ঔষধ প্রদান করা হয়েছে। তবে সরকারী প্রকল্প বন্ধ থাকায় এখন ঔষধ প্রদান করার সুযোগ নেই। ঈশ্বরদী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মহাবুল ইসলাম জানান, কয়েক বছর আগে রূপপুর এলাকায় আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করার পর বাজেট না থাকায় আর কোন অগ্রগতি নেই।

No comments

Powered by Blogger.