মৃত্যুর সরণিতে তুরস্ক by অ্যান্ড্রু ওয়াচটেল

আগামী মাসে নতুন সংবিধানের ওপর তুরস্কের জনগণ ভোট দেবেন। কিন্তু গত এক বছরে দেশটিতে যত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তাতে দেশটি মৃত্যুর সরণিতে ঢুকে গেছে। অথচ দেশটি একসময় মধ্যপ্রাচ্যের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মডেল হিসেবে বিবেচিত হতো। একসময় তুরস্কের মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশই আসত পর্যটন থেকে। এখন সেখানকার পর্যটন খাত সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে দেশটির প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে কমল বলে। এর একটি আরেকটিকে প্রভাবিত করবে, ফলে যে দুষ্টচক্র তৈরি হবে, তা থামানো কঠিন হবে।
তুরস্কের সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ও জনগণের বিপুল অংশ মনে করে, দেশটির এ রকম ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পেছনে পশ্চিমের দুরভিসন্ধি আছে। পর্যবেক্ষকেরা প্রায়ই বলে থাকেন, তুরস্কের এই দুর্গতির কারণ হচ্ছে, দেশটি ইসলামি প্রথা ও আধুনিক পশ্চিমা ধাঁচের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারেনি। একই সঙ্গে, তাঁরা সিরিয়া যুদ্ধের মতো বাহ্যিক কারণের ওপরও দোষ চাপান। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সিদ্ধান্তের কারণেও তুরস্ক সন্ত্রাসবাদের কাছে আরও অসহায় হয়ে পড়ছে।
এরদোয়ানের প্রথম সিদ্ধান্তটি ছিল এ রকম: সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন দেখার অভিপ্রায়ে তিনি আইএসসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করে তুলনামূলকভাবে বিনা বাধায় সিরিয়ায় ঢুকতে দিয়েছেন। এই যোদ্ধারা তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য যে বিপজ্জনক হতে পারে, তিনি সেটা বুঝতে পারেননি, কারণ বিশেষ করে, তাদের অনেকেই এমন সব ইসলামি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে, যারা তুরস্ক ও আসাদ উভয়ের প্রতিই বৈরী।
এরদোয়ানের দ্বিতীয় চরম সিদ্ধান্তটি ছিল তুরস্কের কুর্দি জনগণের সঙ্গে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু করে, যে যুদ্ধটা তাদের মধ্যে অনেক দিন ধরেই সময়-সময় চলে আসছিল। অথচ এরদোয়ান তাঁর জমানার শুরুর দিকে কুর্দিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই বৈরিতা একভাবে থামাতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ২০১৫ সালের জুন মাসে এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এতে এরদোয়ান কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) বিদ্রোহীদের সঙ্গে নতুন করে বৈরিতা শুরু করেন। এই চাল দিয়ে এরদোয়ান গত নভেম্বরের আগাম নির্বাচনে আবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। কিন্তু তার বিনিময়ে গৃহযুদ্ধের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেন।
এই দুটি সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে হয়তো ইসলামি ও কুর্দি সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তৃতীয় সিদ্ধান্তটির কারণে সেটা নাকচ হয়ে যায়। সেটা হলো, এরদোয়ান প্রবাসী ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। অথচ এই গুলেনের প্রভাবশালী শিষ্যরা অর্থাৎ হিজমত আন্দোলন বহু দিন ধরেই এরদোয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। এই গুলেনপন্থীরা এরদোয়ানকে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি অনুগত সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হটাতে সহায়তা করেছে। কিন্তু এরদোয়ান ২০১৩ সালে সন্দেহ করতে শুরু করেন যে গুলেনবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এরপর তিনি গুলেনবাদীদের ওপর চড়াও হন।
গত বছর জুলাই মাসে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে যে ক্ষণস্থায়ী অভ্যুত্থানচেষ্টা হলো তাতে খেপে গিয়ে তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক মানুষকে চাকরিচ্যুত করেন। সরকার উৎখাতের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এরদোয়ান ব্যাপারটা অনেক দূর টেনে নিয়ে যান। যাদের সঙ্গে গুলেনবাদীদের ন্যূনতম সম্পর্কও আছে, তিনি তাদের ছাড় দেননি। এই প্রক্রিয়ায় তিনি তুরস্কের সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিয়েছেন।
যখন ইসলামি ও কুর্দি গোষ্ঠীগুলোর হুমকি তীব্র হচ্ছিল, তখন তুরস্কের এটা করা মোটেও উচিত হয়নি। ১৯৩০-এর দশকে জোসেফ স্তালিন লাল বাহিনী থেকে কর্মকর্তাদের যেভাবে বিতাড়ন করেছিলেন, এরদোয়ানের সেটা স্মরণ রাখা উচিত। এতে কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেকটা প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ে। ফলে অ্যাডলফ হিটলার ১৯৪১ সালে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যান।
এখন তুরস্ক সম্পূর্ণরূপে একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সে যে বহুমুখী সংকটের মুখে রয়েছে, তা মোকাবিলায় সে অক্ষম। এমনকি সবচেয়ে ভালো কিছু হলেও তুরস্ক মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এক শতাব্দীকাল ধরে যে সে আঞ্চলিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল, তাও সে ধরে রাখতে পারবে না। খারাপের মধ্যে তুরস্কের অর্থনীতি ধসে পড়বে। এতে সিরীয়সহ তুরস্কে অবস্থানরত অন্য শরণার্থীরা পশ্চিম ইউরোপের দিকে হাঁটা শুরু করবে।
তুরস্কের দুর্ভাগ্যে সবাই যন্ত্রণাকাতর হয় না। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তুরস্কের এই রূপান্তরে যারপরনাই খুশি হয়েছেন। পুতিনের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সফল গণতান্ত্রিক দেশগুলোই সবচেয়ে বিপজ্জনক। তুরস্ক সে রকমই একটি দেশ ছিল, যারা ছিল গণতান্ত্রিক ও যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী। তারা দীর্ঘদিন ন্যাটোর সদস্য ছিল, যারা বেশ মসৃণভাবে পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করার চেষ্টা করছিল।
এখন তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। তারা একদিকে সন্ত্রাসবাদে জর্জরিত, অন্যদিকে নিজেকে রক্ষা করার মতো সামর্থ্যও তার নেই। ফলে ন্যাটোকে সহায়তা করার মতো অবস্থা তার নেই। এটা পুতিনের কাছে স্বপ্ন পূরণের মতো ব্যাপার। এখন যদি তুরস্কের অধোগতি নতুন করে ইউরোপমুখী শরণার্থীর স্রোত তৈরি করে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অধিকতর অস্থিতিশীল হবে। এটা পুতিনের জন্য আরও ভালো হবে।
এটা বলছি না, তুরস্কের এই পতনের কারিগর হচ্ছেন পুতিন। তাঁকে সে রকম কিছু করতে হয়নি। ব্যাপারটা হচ্ছে, এরদোয়ানের মতো নেতারা সহজেই পুতিনের আধুনিক ব্র্যান্ডের একনায়কত্বের খপ্পরে পড়েন, যে একনায়কত্ব গড়ে ওঠে ভুল তথ্য ছড়ানো ও গণতন্ত্রকে শাসকের ব্যক্তিগত ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে। পুতিনের কাজ হচ্ছে স্রেফ অনুপ্রেরণা এবং সময়-সময় কিছু উপদেশ দেওয়া।
তুরস্কের বাইরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমভাবে পুতিনের ভক্ত। আমাদের দেখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক শক্তি, আপেক্ষিক ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নিয়ে পুতিনের মারাত্মক প্রভাব থেকে অধিকতর সুরক্ষিত কি না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
অ্যান্ড্রু ওয়াচটেল: আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল এশিয়ার প্রেসিডেন্ট।

No comments

Powered by Blogger.