এমপি এনামুলের ক্ষমতার দাপটে অসহায় রাসিক

গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ১২ ধারা লংঘন করেই সরকারের সঙ্গে ব্যবসায় নামেন আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। ২০০৯ সালে ১৬ তলাবিশিষ্ট ‘সিটি সেন্টার’ নির্মাণে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এনা প্রোপার্টিজ। ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু আট বছরে মাত্র ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন থেকে বারবার চিঠি দিলেও পাত্তাই দেয়া হচ্ছে না। মাসখানেক আগে ক্ষতিপূরণের কথা উল্লেখ করে চিঠি দেয়া হলেও তারও কোনো উত্তরই দেয়নি এনা প্রোপার্টিজ। এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সরকারদলীয় প্রভাবশালী এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। আর এনা গ্রুপেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান এনা প্রোপার্টিজ।
এখানেই শেষ নয়, নগরীর সোনাদীঘি এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের পুরাতন ভবনের জায়গায় ১৬ তলাবিশিষ্ট ‘সিটি সেন্টার’ নির্মাণের জন্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা জামানত দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাঁচ বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়। দফায় দফায় চিঠি দেয়ার পর টাকার বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে এনা। সেই ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদও শেষ হয়েছে বহু আগেই। এ নিয়েও কয়েক দফা চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা বারবার চিঠি দিচ্ছি। কিন্তু এনা প্রোপার্টিজের পক্ষ থেকে সাড়া পাইনি’। তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম উল আযিম জানান, চুক্তি ভেঙে কাজ করে যাচ্ছে এনা প্রোপার্টিজ। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। আমরা বারবার চিঠি দিচ্ছি। কিন্তু তারা কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছে না। সবশেষ মাসখানেক আগে জরিমানা দাবি করে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাতেও সাড়া দিচ্ছে না তারা। এভাবে চলতে পারে না। আমাদের এক রকম জিম্মি করে ফেলেছে। জানা গেছে, ২০০৯ সালে সিটি সেন্টার নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু এই মেগা প্রকল্পে শুধু এমপি এনামুলের প্রতিষ্ঠানই দরপত্র জমা দেয়। পরে কাজও পায় প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর করা চুক্তি অনুযায়ী ১৬ তলার মধ্যে মাত্র ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ সিটি কর্পোরেশন পাবে। বাকিটা এনা প্রোপার্টিজের। চুক্তির ৩০ দিনের মধ্যে জামানত হিসেবে এক কোটি ২০ লাখ টাকা এনা প্রোপার্টিজের জমা দেয়ার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী সিটি সেন্টারের পাশে অবস্থিত সোনাদীঘি সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ (কমন ফ্যাসিলিটিজ) নির্ধারিত ওই সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করার কথা। এর মধ্যে রয়েছে একটি মসজিদ, তথ্যপ্রযুক্তি পাঠাগার, থিয়েটার,
হাঁটার পথ, ল্যান্ডস্কেপিং, দীঘির এক পাশে গ্যালারি, সাবস্টেশন, জেনারেটর ও পাম্প হাউস, দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ের উপ-ভাড়াটেদের পুনর্বাসন, পয়ঃনিষ্কাশন, ভেতরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সীমানা প্রাচীরসহ আরও কিছু নির্মাণ কাজ এনা প্রোপার্টিজের নিজ খরচে করে দেয়ার কথা। কিন্তু এসবেরও কিছুই এখনও করেনি এনা। স্থানীয় ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান জানান, সিটি সেন্টার ভবনে ব্যবসার জন্য তিনি জায়গা বরাদ্দ নিয়েছেন। এজন্য ২০১১ সালে তিনি এনা প্রোপার্টিজের সঙ্গে চুক্তিও করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। তাই দোকান করতে পারছেন না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তিনি। তার মতো আরও অনেকেই জায়গা বরাদ্দ নিয়ে বসে আছেন। এদিকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার প্রথম কাজ হবে শহরের প্রাণ কেন্দ্রের সোনাদীঘি সংস্কার করে আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। সোনাদীঘিকে ঘিরে অত্যাধুনিক কিছু পরিকল্পনা ঘোষণা করে নগরবাসীকে স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্নের ধারে-কাছেও তিনি যেতে পারেননি। অথচ সেই সোনাদীঘির খানিক অংশ এরই মধ্যে ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে এই ‘সিটি সেন্টার’। এরই মধ্যে দীঘির বেশকিছু অংশ ভরাট করে তার ওপর পাইলিং করে বসানো হয়েছে ২০-২৫টি পিলার। সিটি সেন্টার করতে গিয়ে দৃশ্যত মেরে ফেলা হচ্ছে সোনাদীঘিকে। দখল আর দূষণ তো আছেই। সরেজমিন দেখা যায়, সিটি সেন্টারের ১৩ তলা পর্যন্ত কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এটি পূর্বদিকে আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। দীঘির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের বেশকিছু অংশ ভরাট করে এরই মধ্যে ২০-২৫টি পিলার বসানো হয়েছে। মাটি থেকে প্রায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠেছে পিলারগুলো। এর ওপর নির্মিত হবে ভবন। পুরো দীঘিতে ময়লা-আবর্জনা ভাসতেও দেখা গেল। এভাবে দখল-দূষণে প্রাণ হারাতে বসেছে সোনাদীঘি। দীঘির পশ্চিম দিকে মোঘলস বিরিয়ানি নামে একটি রেস্তোরাঁর রান্নাঘর তৈরি করা হয়েছে। এর কিছু অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করে করা হয়েছে।
আর কিছু অংশ পানির ওপরেই বাঁশের কাঠামো দিয়ে তৈরি করা। সোনাদীঘি দখল করে রান্নাঘর তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই রেস্তোরাঁর মালিক নজরুল ইসলাম সোহানের ভাই মিজানুর রহমান সোহাগ বলেন, শুনেছি পুরো দীঘিটিই ভরাট হবে। তাই ময়লা পড়ে যে অংশটি ভরাট হয়েছে, আমরা সে অংশে রান্নাঘর বসিয়েছি। সার্বিক বিষয়ে এনা গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোসলেহ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এনা প্রোপার্টিজের পরিচালক (কনস্ট্রাকশন) ইঞ্জিনিয়ার শাহিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার শাহিনের বক্তব্য জানতে মোবাইলে কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। তবে এসব বিষয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ বলেও জানান এনা প্রোপ্রার্টিজের রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক সারোয়ার জাহান। একাধিকবার চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি এমপি এনামুল হকেরও। এদিকে সোনাদীঘি ভরাটের কাজ শুরু হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, ‘সিটি সেন্টার নির্মাণের আগে আমাদের একটি নকশা দেখানো হয়েছিল। ওই নকশায় সোনাদীঘি ঘিরে নানা পরিকল্পনা ছিল। সে নকশা বাদ দিয়ে সোনাদীঘি ভরাট করা হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। আমরা জানতে চাই, আগের নকশা গেল কোথায়? সোনাদীঘিকে রক্ষার উদ্যোগ না নেয়া হলে রাজশাহীবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামব।’

No comments

Powered by Blogger.