উচ্চশিক্ষা, জঙ্গিবাদ এবং আমাদের ভবিষ্যৎ by ফরিদুল আলম

উন্নয়নের জন্য উচ্চশিক্ষার গুরুত্বের বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। আমরা প্রায়শই আমাদের জাতীয় জীবনে ক্রমশই যেভাবে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছি তা নিয়ে মাঝে মধ্যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও জঙ্গিবাদের তৎপরতা ক্রমান্বয়ে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে যেভাবে অঙ্কুরিত হচ্ছে এবং কতিপয় ক্ষেত্রে মাটিতে শেকড় গেড়ে ডালপালা এবং শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে চলছে তা নিয়ে সম্ভবত ততটা উদ্বিগ্ন নই, আর সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় এটাই। এই উদ্বেগের মাত্রা নিঃসন্দেহে অনেক গুণ বেড়ে যাবে যখন আমরা সচেতনভাবে খেয়াল করব আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কতিপয় ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের উৎপত্তি এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। গত ৭ জুন ব্যাংক ডাকাতির প্রস্তুতিকালে বনশ্রী এলাকা থেকে ছয়জন এবং সূত্রাপুর এলাকা থেকে আধ্যাত্মিক নেতা নুরুল্লাহ কাসেমীসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তিতে জিহাদিদের কাছে বিস্ফোরক বিক্রির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিন ব্যবসায়ীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ল্যাব সহকারীকে ১৮ জুন গ্রেফতার করা হয়। তাদের আরো জিজ্ঞাসাবাদের পর এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বুধবার বিকেল ৫টার দিকে ডিবি ‘বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপ’র কমান্ডার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ওরফে মিলন ওরফে মিলু ওরফে আব্দুল্লাহ ওরফে অনিক এবং অর্থদাতা ফিরোজ ওরফে মোহাম্মদ তমালকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, ১৫ রাউন্ড গুলি, এক কেজি বিস্ফোরক ও দুটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের মুখপাত্রের মাধ্যমে জানা যায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে পদ্মার চর এবং উত্তরবঙ্গের কম জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় অস্ত্র এবং বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ নিত। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এই ধরনের প্রশিক্ষণ সমপানান্তে সিরিয়া এবং আগানিস্তানের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগদান করবে এবং পরবর্তীতে দেশে ফিরে আরো ব্যাপক মাত্রায় বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তারে ভূমিকা রাখবে। অতীতেও দেখা গেছে জেএমবি, জেএমজেবি এবং হরকাতুল জিহাদের মতো সংগঠনগুলো ইতোপূর্বে দেশের বাইরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় থেকে পরবর্তীতে দেশের অভ্যন্তরে নানা নাশকতামূলক ঘটনা সংঘটিত করে। তবে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে দেশে জঙ্গি তৎপরতা কমে যাওয়ার পরিবর্তে এর ধরন পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে এখন প্রশ্নও জাগতে শুরু করেছে জঙ্গিবিরোধী সরকারের কৌশলের কোনো সমস্যা রয়েছে নাকি এ বিষয়ে যতটুকু মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন তা দেয়া হচ্ছে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দেশের কিছু উচ্চশিক্ষিত তরুণ বর্তমানে বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন। এরই মধ্যে দেশের ধনাঢ্য পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ১৩ মেধাবী তরুণ সিরিয়ায় আইএসের যুদ্ধে যোগ দিতে দেশ ছেড়েছেন। দেশ ও সরকারের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। বিত্তশালীদের উচ্চশিক্ষিত তরুণরা কেন জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন তা নিয়ে অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানী এবং গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে আশঙ্কাজনক ও চাঞ্চল্যকর তথ্য।
উচ্চশিক্ষা, জঙ্গিবাদ এবং আমাদের ভবিষ্যৎঅপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, একমাত্র যে কোনো উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের আফিম দিয়েই একটি মানুষকে কিলিং মেশিনে (হত্যার যন্ত্র) পরিণত করা যায়। প্রতিটি দেশেই সুষ্ঠু রাজনীতির আড়ালে মৌলবাদী অপশক্তিও সক্রিয় থাকে। আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় সেই মৌলবাদের আফিমে মত্ত হচ্ছে আমাদের তরুণ-যুবারা (সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, ২৪ জুন, ২০১৫)। তবে এই সব সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বর্তমান জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে কিছু সরকারি এবং বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম চলে আসা। একাধারে উচ্চশিক্ষিত তরুণরা বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে এবং অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতা এই দুটিই এখানে একসূত্রে গাঁথা। দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্যানুযায়ী অকার্যকর জঙ্গি মনিটরিং সেল, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো, যথাযথ গোয়েন্দা নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। গোয়েন্দা সূত্রমতে, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শক্ত ভিত গড়ছে জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং এ কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ পর্যন্ত করা হচ্ছে (সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়, ২৪ জুন, ২০১৫)। বহুল আলোচিত ব্লগার রাজিব এবং আরিফ রহমান দিপকে হত্যার পর আলোচনায় আসে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম। পরবর্তীতে এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে খুন হন মুক্তমনার ব্লগার অভিজিৎ, যার একমাসের মধ্যে খুন হন আরেক ব্লগার ওয়াসিকুর রহমান বাবু এবং তার একমাস পর সর্বশেষ সিলেটে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস রিপন। এই সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও নাম চলে আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম এবং সেই সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ জিহাদি গ্রুপসহ নানা নামে বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের যথেষ্ট উদ্যোগী অবস্থান পরিলক্ষিত হলেও কেবল তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও জেএমবির ৫ সদস্যর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর আজ পর্যন্ত কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্যর বিরুদ্ধে এমন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন না হওয়া এবং এই ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে এমন কার্যক্রম অব্যাহত আছে কিনা তা ভেবে দেখা অতীব জরুরি। দেশে চলমান জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে দেশের কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা এবং তাদের এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে নানা সময়ে সতর্ক করা হলেও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব জঙ্গির তৎপরতা এখন অনেকটা প্রকাশ্যেই চলে আসছে। বিশেষ করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং হিযবুত তাহ্রির-এর কার্যক্রম অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকটা প্রকাশ্যেই চলে আসছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থা গৃহীত হলেও আজ পর্যন্ত জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ততার দায়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ দৃশ্যমান হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ব্লগার রাজিব হত্যার পর ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আলোচনায় আসলেও এবং সেখানকার কিছু ছাত্র-শিক্ষকের এই ব্যাপারে সম্পৃক্ততার সূত্র আবিষ্কৃত হলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে নর্থ সাউথসহ এই ধরনের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অবস্থা যদি এমন চলতে থাকে তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বিচ্ছিন্নভাবে জঙ্গিদের পাঁকড়াও করা হলেও একসময় জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবা বিস্তৃতির ফলে ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ইতোমধ্যে যে সব জঙ্গি সংগঠনের নাম আলোচনায় এসেছে এবং যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, দেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে কেবল এরাই সম্পৃক্ত নয় বরং সারাদেশে এ ধরনের আরো নামে বেনামে জঙ্গি তৎপরতা চলমান রয়েছে, যারা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধরা পড়ছে না।
সম্প্রতি এই আতঙ্কের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে যখন কয়েকজন ব্লগার খুন হওয়ার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ব্যানারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক এবং অধ্যাপক জাফর ইকবালকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। অবশ্য এর আগে আরো দুবার তাদের এ ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছিল। তাদের এই কার্যক্রম এবং ক্রমাগত সহিংস তৎপরতায় এটাই স্পষ্ট যে, বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কতিপয় নেতাকর্মী ধরা পড়লেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই এবং প্রতিনিয়তই তারা সংগঠিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে যে, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর বাংলাদেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে এবং বুয়েটের কয়েক শিক্ষকের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এই সংগঠনের হয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং এক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়া টিএসসিভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের বিরুদ্ধে পাঠচক্রের আড়ালে ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে হিজবুত তাওহিদ, আল্লাহর দল, কালেমা-ই-জামাত, হিজবুল মাহাদি, জামায়েতুল মুসলেমিন, দাওয়াতে ইসলাম বাংলাদেশ, জমিয়তে আহলে হাদিস বাংলাদেশ, ইসলামি গণ-আন্দোলনের মতো সংগঠন। পাশাপাশি পুরনো সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি এবং জেএমজেবির মতো সংগঠন গোপন তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এ ধরনের সংগঠনগুলো ছাত্রদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রীকে নিজেদের হয়ে কাজ করতে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। অভিযোগ রয়েছে যে, বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র এবং মেধাবী ছাত্রীদের নিজেদের দলে টানতে ইসলামকে ব্যবহার করে একধরনের ধর্মীয় ভীতি ছড়ানো হচ্ছে এবং কেবল নিয়মিত বোরখা পড়ার জন্য মাসিক বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য আসিফ আদনান সাবেক বিচারপতির ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। গ্রেফতার হওয়া আনসারুল্লাহর আরেক সদস্য ফজলে এলাহী তানজিল ইংরেজি মাধ্যমে ‘এ’ লেভেল পাস করেছেন। তার মা একজন যুগ্মসচিব। বর্তমানে তিনি বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে (ওএসডি) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এই জঙ্গিদের পারিবারিক পরিচয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা বিস্মিত করেছে গোয়েন্দাদের (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, ৮ নভেম্বর, ২০১৪)।
দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত তরুণ-তরুণীরা কেন এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে হয়তো অনেক ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে দেশের রাজনীতিতে একধরনের দুর্বৃত্তায়নকেও এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দার্শনিকদের বক্তব্য অনুযায়ী মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই রাজনৈতিক প্রাণী। কিন্তু দেশের প্রথাগত রাজনীতিতে বর্তমানে যে ধরনের দৈন্যদশা চলছে সেখানে তরুণ প্রজন্ম তারুণ্যের স্বাভাবিক আবেগেই পরিচালিত হচ্ছে ভুল পথে। তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে হয়তো ভুল-শুদ্ধ বিচার-বিবেচনা করা সম্ভব নয়, উপরন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে পড়ালেখা এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী তরুণদের সংগঠিত করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা অন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে এ ধরনের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে চাইলেও আর ফিরে আসতে পারে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিপুল অর্থের উৎস কী? এ প্রসঙ্গে যতটুকু জানা যায় মূলত পাকিস্তানের আইএসআই, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ এবং দেশের কিছু ব্যবসায়ী এই অর্থের জোগান দিয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যসহ কিছু মুসলিম দেশে পাশ্চাত্যের আক্রমণের সূত্র ধরে প্রথমে এসব সদস্যকে সংগঠিত করা হলেও পরবর্তীতে দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে তাদের ব্যবহার করাই এসব জঙ্গি সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।
দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তৈরির কারখানা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জঙ্গি তৎপরতার ফলে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী তরুণ প্রজন্ম এবং অভিভাবকদের মধ্যে যেমন একধরনের চাপা আতঙ্ক কাজ করছে, পাশাপাশি আমাদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের প্রতিও এটা এক অশনি সংকেত। ইতোমধ্যে কয়েকজন মুক্তমনা ব্লগার খুন এবং ক্রমাগত অনেককে হত্যার হুমকি দেয়ার মাধ্যমে প্রকারান্তরে এই বার্তাই পৌঁছে দেয়া হয়েছে যে, তারা আসলে কতটা সংগঠিত এবং শক্তিশালী। সেই সঙ্গে তাদের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার ফলে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আর্থিক সমর্থনপুষ্ট হওয়ার ফলে সরকারের দিক স্বীকার করা না হলেও থেকে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করা অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, বিশেষ করে এ ধরনের সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হলে সরকারের দিক থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায় অনেক বেশি দরকার। এই লক্ষ্যে সরকার কোনো তৎপরতা চালাচ্ছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এই ধরনের সংস্থাগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য থাকলেও বাস্তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ততটুকুই অপ্রতুল। যে কথা আগেই বলেছি যে বিভিন্ন সময়ে এমন বেশ কিছু জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হলেও তাদের বিচারিক প্রক্রিয়া চলছে খুবই ধীরগতিতে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আবারো ব্যাপক উদ্যমে এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। গত ২০১৩ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ ভ্যান থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিনতাইয়ের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারো কারো বিরুদ্ধে সন্দেহের অঙ্গুলি প্রদর্শন করা হলেও পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে এই বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। সুতরাং সরকারের দিক থেকে এখন সময় এসেছে এই ব্যাপারে আশু করণীয় ঠিক করার। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে এ ধরনের জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে, এই মুহূর্তে দরকার এর করুণ থাবা থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করে ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে আইন রয়েছে এর যথার্থ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্রুততা, সততা এবং সাহসিকতার পরিচয় দেয়া, নয়তো আমাদের উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের ক্ষেত্রে আশু সংকট অনিবার্য।
লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.