ভর্তুকির কলের লাঙল: নতুন লাঙল, আবার তদন্ত, সাংবাদিক লাঞ্ছিত

কোটচাঁদপুর উপজেলা চত্বরে ইউএনও দেবপ্রসাদ
পালকে (বাঁয়ে) নতুন কলের লাঙল দেখাচ্ছেন
যুবলীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম (ডানে)।
বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা ছবি l প্রথম আলো
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার সেই ভর্তুকির কলের লাঙলের বিষয়ে তদন্ত করতে গতকাল শুক্রবার আবারও এলাকায় গেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল। লাঙলের জন্য নির্বাচিত ১৫ কৃষক এবং প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এমন অন্তত দুজনের সাক্ষ্য নেয় তারা।
তবে তার আগে গত বৃহস্পতিবার সকালে কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লাঙল না কেনার অভিযোগ ওঠা কয়েকজনের বাড়িতে যান লাঙল দেখতে। কিন্তু তাঁরা তাঁকে জানান, লাঙল মাঠে আছে। তিনি বিকেলের মধ্যে তাঁদের তাঁর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে লাঙল দেখিয়ে আনতে বলেন।
‘প্রথম আলোর খবর অসত্য নয়, এখনো পাঁচজন কলের লাঙল কেনেননি’ শিরোনামে গত বৃহস্পতিবার খবর প্রকাশিত হয়। এরপর প্রশাসন আবার তৎপরতা শুরু করে।
এদিকে এই তদন্তের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে শুক্রবার সকাল ১০টায় উপজেলা চত্বরে লাঞ্ছিত হয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক সুব্রত সরকার। এ সময় হামলাকারীরা প্রথম আলোর সাংবাদিককেও খুঁজতে থাকে।
ঘটনার প্রতিবাদে কোটচাঁদপুরে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ সভা করেন। সভায় বলা হয়, কলের লাঙল বিতরণে অনিয়মের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সুবিধাভোগীরা সাংবাদিকদের ওপর খেপেছেন। তাই ‘তথ্য সরবরাহের অভিযোগ এনে’ সুবিধাভোগী যুবলীগ নেতারা সুব্রতর ওপর হামলা করেছেন।
সভায় সাংবাদিক নেতারা বলেন, ‘সত্য ঘটনাকে আড়াল করতে কর্তৃপক্ষের ইঙ্গিতেই এমন ন্যক্কারজনক কাজ করেছে সুবিধাভোগীরা। তদন্তের আগের রাতে কলের লাঙল কিনে এনে তদন্ত কমিটির সামনে হাজির করে প্রকাশিত সংবাদগুলি মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
গতকাল বিকেল চারটায় হাসপাতাল সড়কের রিপোর্টার্স ক্লাবের অস্থায়ী কার্যালয়ে এই প্রতিবাদ সভা হয়। ক্লাবের সভাপতি অশোক দের সভাপতিত্বে সভায় বক্তৃতা করেন খায়রুল হোসেন সাথী, আলমগীর কবীর, কাজী মৃদুল, কামাল হাওলাদার, বি এম ওয়াদুদ, আলমগীর খান, মনোজ মালাকার, আমিনুর রহমান, এস এম রায়হান ও আবদুল আজিজ।
উপজেলা চত্বরে সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনা কথা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবপ্রসাদ পাল বলেন, ‘প্রকাশিত খবরে কৃষকদের সম্মান নষ্ট হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। আমরা তাঁদের শান্ত করে পরিস্থিতি সামলেছি। এর মধ্যে সাংবাদিক সুব্রত সরকারকে কেউ সামান্য ধাক্কা দিয়ে থাকতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনজন নতুন লাঙল নিয়ে উপজেলা চত্বরে আসেন। তাঁরা ইউএনওকে তা দেখিয়ে নেন। গতকাল শুক্রবার আরও দুজন তাঁকে লাঙল দেখিয়ে নেন।
সিরাজুল ইসলাম: বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইউএনওকে লাঙল দেখাতে আনলে উপজেলা চত্বরে কথা হয় সাব্দালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য লক্ষ্মীকুণ্ডু গ্রামের সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএনও সাহেব লাঙল দেখতে চেয়েছেন, তাই এসেছি।’ লাঙল তো একেবারে নতুন—এমন মন্তব্য করলে সিরাজুল বলেন, ‘আগে যে লাঙল নিয়েছিলাম, তা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বদলাতে হয়েছে। আজ নতুন আরেকটা আনলাম।’
এর আগে গত ২ জুন তদন্ত কমিটিকে দেখাতে সিরাজুল ইসলাম লাঙল ধার এনেছিলেন লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক বখতিয়ার আলমের কাছ থেকে। বখতিয়ারের বক্তব্যসহ এই তথ্য গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোতে ছাপাও হয়। সঙ্গে তাঁর একটা ছবি ছাপা হয়, যাতে তিনি ধার দেওয়া কলের লাঙলটি প্রথম আলোকে দেখাচ্ছেন। সেখানে বখতিয়ার আলম তাঁর কলের লাঙলের নম্বরপ্লেট দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘তারা এটা বদল করেছে। এখন যে নাম্বারটি লাগানো আছে, তা আমার লাঙলের ইঞ্জিন নাম্বার নয়।’
তখন সিরাজুল ইসলামের বক্তব্য ছিল, ‘সামান্য লাভের জন্য আর ঝামেলা করতে চাই না। আমার যেন কোনো ক্ষতি না হয়, একটু খেয়াল রাখবেন।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল শুক্রবার উপজেলা অফিসে বখতিয়ারকে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তারা বখতিয়ারের বক্তব্য শোনে। সেখানে তাঁকে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হয় বলে জানা গেছে।
সাইফুল ইসলাম: যুবলীগের কর্মী লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম ইউএনওকে লাঙল দেখাতে নিয়ে যান শুক্রবার সকালে। তাঁর লাঙলটিও নতুন। গত মার্চ মাসে এই লাঙল কেনার কথা ছিল। সাইফুল ইসলাম বলেন, তাঁর লাঙল আগেই কেনা হয়েছে। তাহলে ঝকঝকে নতুন কেন—জানতে চাইলে বলেন, ‘নতুন থাকবে না!’
সাইফুল ইসলাম ২ জুন তদন্ত কমিটিকে দেখাতে কলের লাঙল ধার করেছিলেন তালিনা গ্রামের মোশারফ হোসেনের কাছ থেকে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ বিষয়ে মোশারফের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। কীভাবে লাঙল নেওয়া হয়েছে তা তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছিল। ওই প্রতিবেদনে সাইফুল ইসলামের বক্তব্যও ছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘প্রথমে টাকা জোগাড় করতে না পারায় লাঙল কিনিনি। পরে কিনেছি।’ তদন্ত কমিটিকে দেখানোর জন্য ধার করে আনা মোশারফের লাঙলের নম্বরপ্লেট ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘ওটা আমার কাছে আছে, পরে দিয়ে দেব।’
গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আসা কর্মকর্তারা মোশারফ হোসেনকে ডেকে নিয়ে যান। তাঁরা প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চান। পরে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বললে তিনি তা করতে রাজি হননি।
মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষ। অনেক কষ্টে একটা লাঙল কিনে সংসার চালাচ্ছি। আমি আর এসবের মধ্যে থাকতে চাই না।’
আবার তদন্ত দল: শুক্রবার সকালে উপজেলায় আসে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আগের তদন্ত কমিটি। এর আহ্বায়ক উপসচিব আবদুল ওয়াদুদ। সকাল সাড়ে নয়টায় কমিটি প্রথমে কলের লাঙলপ্রাপ্ত ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলে। ওই সময় দুজন লাঙল নিয়ে আসেন। তদন্ত দল লাঙলমালিকদের সঙ্গে কথা বলে দুপুর ১২টার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেয়।
কমিটি এরপর কথা বলে লাঙল ধার দেওয়া তালিনা গ্রামের মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, কমিটি মোশারফ হোসেনের বক্তব্য রেকর্ড করেছে। পাশাপাশি তাঁকে লিখিত সাক্ষ্য দিতে বললে তিনি রাজি হননি।
লাঙল ধার দেওয়া আরেক কৃষক বখতিয়ার আলমেরও সাক্ষ্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় কালীগঞ্জ থেকে লাঙল
কিনে নছিমনে করে কোটচাঁদপুরে নিয়ে আসা হচ্ছে।
লাঙলটি সলেমানপুর গ্রামের আজিজুল হকের
বলে জানান চালক l ছবি: প্রথম আলো
প্রসঙ্গত, গত ২৭ মে ‘কলের লাঙলের ভর্তুকির বড় ভাগ সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের পকেটে’ শিরোনামে প্রথম আলোয় খবর প্রকাশিত হয়। বিষয়টি তদন্ত করে কৃষি মন্ত্রণালয়। তার ভিত্তিতে খবর সত্য নয় দাবি করে সংসদে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। বিষয়টি আবার নতুন করে অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে ‘প্রথম আলোর খবর অসত্য নয়, এখনো পাঁচজন কলের লাঙল কেনেননি’ শিরোনামে বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
নছিমনে করে আসছে কলের লাঙল
১. গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় একটি নছিমনে করে কালীগঞ্জ থেকে কোটচাঁদপুরে এসে পৌঁছে একটি কলের লাঙল। এটি সলেমানপুর গ্রামের আজিজুল হক কিনেছেন জানার পর নছিমনের চালক শিমুল হোসেনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। শিমুল প্রথমে বলেন, তিনি লাঙলটি ঝিনাইদহ শহর থেকে নিয়ে এসেছেন। কোথায় যাবে—জানতে চাইলে বলেন, কোটচাঁদপুর ফিলিং স্টেশনে। স্টেশনের মালিক দবির হোসেন এটি কিনেছেন। কিন্তু ফিলিং স্টেশনের মালিক দবির হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, তিনি কোনো লাঙল কেনেননি। যিনি তাঁর নাম বলেছেন, তিনি মিথ্যা বলেছেন।
কলের লাঙল বহনকারী নছিমন চালককে মিথ্যা বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁকে এভাবে বলতে বলা হয়েছে। শেষে তিনি স্বীকার করেন, লাঙলটি তিনি কালীগঞ্জ থেকে নিয়ে এসেছেন। তবে এ বিষয়ে আজিজুল হকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, ভর্তুকির ১৫ লাঙলের সব কটিই কালীগঞ্জ থেকে কেনার কথা। এর মধ্যে ১৩টি রাফি এন্টারপ্রাইজ থেকে; দুটি মেসার্স কাদের মেশিনারি থেকে।
২. ওই বৃহস্পতিবার রাতেই কোটচাঁদপুরের রাস্তায় আরেকটি কলের লাঙল নছিমনে করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। ওই লাঙলের সঙ্গে থাকা জনৈক কামাল হোসেন জানান, এটা কালীগঞ্জের রাফি এন্টারপ্রাইজ থেকে আনা হচ্ছে। তবে কার জন্য আনা হচ্ছে, তা তিনি বলতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, এটা তিনি নিজে কিনেছেন। রাতের বেলায় নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দিনে সময় করে উঠতে পারেননি।’
উপজেলা চত্বরে নিয়ে নতুন লাঙল দেখানোর বিষয়ে কোটচাঁদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুইটা পরিবর্তন করে নতুন নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা তাঁকে জানিয়েছেন।’

No comments

Powered by Blogger.