বাসের অগ্রিম টিকিট: খালি হাতে ফিরতে হয়েছে অনেককে

ভোর পৌনে পাঁচটা। রাজধানীর গাবতলী-কল্যাণপুরে বিভিন্ন দূরপাল্লার বাসের কাউন্টারগুলো তখনো খোলেনি। তবে কাউন্টারগুলোর সামনে মানুষের ভিড়। গাবতলী বালুরমাঠে হানিফ এন্টারপ্রাইজের নিজস্ব টার্মিনাল তখন লোকে লোকারণ্য। সবাই ঈদে বাড়ি যেতে অগ্রিম টিকিট কিনতে এসেছেন।
পরে ভিড় আরও বেড়েছে। বিকেল পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, ভোগান্তি সয়ে কেউ কাঙ্ক্ষিত দিনের টিকিট পেয়েছেন। কেউ পাননি। যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের অনেকে অভিযোগ করলেন, বেশি ভাড়া আদায়ের। অভিযোগ অস্বীকার বাস কোম্পানির কর্মকর্তাদের। অর্থাৎ চিত্র এবারও বদলায়নি।
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বাসের অগ্রিম টিকিট ছেড়েছে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি। টিকিট সংগ্রহ করতে সেহ্রি খেয়েই বাস কাউন্টারে আসতে শুরু করে মানুষ। গাবতলী, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল ও মাজার রোডের কাউন্টারগুলো থেকে বিক্রি করা হয় উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পথের বাসের টিকিট। সায়েদাবাদ ও মহাখালী টার্মিনালকেন্দ্রিক কয়েকটি পরিবহন সংস্থাও টিকিট বিক্রি করেছে। ১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত যাত্রার টিকিট বিক্রি হচ্ছে।
কাউন্টারের কর্মীরা বলছেন, ঈদের ছুটি সাপ্তাহিক বন্ধের মধ্যে পড়ায় সবার চাহিদা ১৬ জুলাইর টিকিট। তা শেষ হওয়ায় খুঁজছেন ১৪ ও ১৫ জুলাইয়ের টিকিট। তবে ওই তিন দিনের টিকিট না পেয়ে ফিরতে হয়েছে অনেককে।
বাড়তি দাম প্রসঙ্গে প্রায় সব কাউন্টার থেকেই বলা হচ্ছে, তাঁরা সরকার-নির্ধারিত ভাড়া রাখছেন। কেউ বলছেন, ঈদের সময় প্রতিটি বাসের শেষ গন্তব্য পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, ফলে মাঝের গন্তব্যের যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। অনলাইনেও টিকিট কেটেছেন অনেকে। তবে বেশির ভাগেরই অভিযোগ, অনলাইনগুলো টিকিট ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে ১৫ ও ১৬ জুলাইয়ের সব টিকিট।
ভোরে গাবতলী ও কল্যাণপুরে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, নাবিল পরিবহন, টিআর ট্রাভেলস, ডিপজল এন্টারপ্রাইজসহ উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে চলা পরিবহন সংস্থাগুলো টিকিট ছেড়েছে। ভোর সাড়ে চারটার দিকে গাবতলীর পথে যেতে টেকনিক্যাল মোড় পার হয়েই দেখা গেল ১৫-২০ জনের জটলা। জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, সবাই লালমনিরহাটের টিকিট কাটতে এসেছেন। কিন্তু সব বাসের কাউন্টার বন্ধ। একটু পরেই দেখা গেল, মানিক এক্সপ্রেস নামের একটি পরিবহন কোম্পানির কাউন্টার খুলেছে। খোলামাত্রই কাউন্টারের সামনে ৩০-৩৫ জনের লাইন হয়ে গেল।
মাজার রোডে নাবিল পরিবহনের কাউন্টারের পাশের বাস রাখার জায়গায় তখন গিজগিজ ভিড়। অথচ কাউন্টারগুলো সব বন্ধ। নাবিল পরিবহনের পাশে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের পেছনে শামিয়ানা টাঙিয়ে ঈদের টিকিটের জন্য অস্থায়ী বুথ তৈরি করা হয়েছে। সেখানেও ভোরেই লম্বা সারি। গাবতলী বালুর মাঠে হানিফ এন্টারপ্রাইজের নিজস্ব টার্মিনালের কাউন্টার খুলেছে, তবে টিকিট বিক্রি শুরু হয়নি। মাঝেমধ্যেই লাইনে থাকা লোকজন একযোগে হইচই করছেন।
ভোর সাড়ে পাঁচটার পর টিকিট বিক্রি শুরু করে হানিফ এন্টারপ্রাইজ। লাইন এগোতে থাকে খুব ধীরে। মাঝেমধ্যেই অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন টিকিটপ্রত্যাশীরা। তবে লাইন ছাড়েননি। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থেকে দুপুরের দিকে অনেকে অভিযোগ করেন, লাইন এড়িয়ে কিছু লোক কাউন্টারে ঢুকে টিকিট কাটছেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কথা হয় আবু হাসনাতের সঙ্গে। বলেন, সকাল সাতটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখনো তাঁর সামনে অন্তত ৪০ জন রয়েছেন।
হাসনাতের পেছনে থাকা চৌধুরী ইয়াকুব বলেন, ‘যদি সিস্টেমটা দাঁড়িয়ে যায়, নিশ্চয়তা থাকে যে টিকিট পাবই, তাহলে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকতেও সমস্যা নেই। কিন্তু দেখেন, আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি আর ফাঁকফোকর দিয়ে কাউন্টারে লোক ঢুকে টিকিট নিয়ে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে যদি দেখা যায় টিকিট নেই, তাহলে রাগ-ক্ষোভ কোথায় রাখব বলেন? আমরা চাই সিস্টেম দাঁড়াক।’
প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে সৈয়দপুরের টিকিট পেয়েছেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫৫০ টাকার টিকিট ৮০০ টাকা নিয়েছে। তাঁর টিকিটে দেখা যায়, তাঁকে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত টিকিট দেওয়া হয়েছে।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন বলেন, সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়ম মেনেই করছেন তাঁরা। সরকার-নির্ধারিত ভাড়াই নেওয়া হচ্ছে। তবে শেষ গন্তব্যের টিকিটের দাম রাখায় অনেকে ভাবছেন বেশি টাকা আদায় করা হয়েছে।
আবার অনলাইনেও টিকিট কেটেছেন অনেকে। তবে অভিযোগ, সকাল সাতটায় টিকিট ছাড়ার পরপরই ১৫-১৬ জুলাইয়ের টিকিট শেষ হয়ে গেছে। জানতে চাইলে অনলাইনে বাস টিকিট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন সপ্তাহ ধরে লোকজন ঈদের টিকিটের জন্য কল সেন্টার ও অনলাইনে যোগাযোগ করছেন। গতকাল সকাল সাতটায় টিকিট ছাড়ামাত্র একসঙ্গে বহু লোক অনলাইন থেকে টিকিট নিয়েছেন। এ কারণে কিছু সমস্যা হতে পারে। তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান হানিফ, নাবিল, এসআর, গ্রিনলাইনসহ ১০টি কোম্পানির টিকিট বিক্রি করে। কোম্পানিগুলো এ বছর ১০ থেকে ৩০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে বেচতে দিয়েছে। তবুও তাঁরা এবার কয়েক হাজার টিকিট বিক্রি করেছেন। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের সব গন্তব্যের টিকিট শেষ, চট্টগ্রামের কিছু টিকিট অবিক্রীত রয়েছে। বাড়তি দাম নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাস অপারেটর নির্ধারিত দামেই তাঁদের টিকিট বেচতে হয়েছে। দামের ওপরে তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
সায়েদাবাদ থেকে সিলেট-চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ কয়েকটি পথের বাসের টিকিট বিক্রি হয়েছে। মহাখালী থেকে সিলেট ও উত্তরবঙ্গে বাস পরিচালনাকারী কয়েকটি সংস্থা অগ্রিম টিকিট বিক্রি করেছে। এই টার্মিনাল থেকে মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বাস ছাড়ে। এসব পথের বাসগুলো অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে না।

No comments

Powered by Blogger.