বিএনপির ময়নাতদন্ত by কাফি কামাল

ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার স্বীকৃতি মিলেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেই। তবে তার ক্ষমতা আরোহণ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। যদিও ব্যক্তিগত সততার জন্য তিনি ছিলেন প্রশংসিত। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৮। আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির। জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যু এ দলের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়লেও খালেদা জিয়ার হাত ধরে এগিয়ে যায় বিএনপি। একটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তারেক রহমানও। চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া দল বিএনপি এখন এক অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন বিপর্যয় দলটি অতীতে কখনোই মোকাবিলা করেনি। সামনে কী আছে তা জানেন না বিএনপির কেউই। এমনকি রাজনৈতিক পণ্ডিতরাও। দলটির জন্য এ এক অনিশ্চিত ঘোর অমানিশার সময়। কেন এ বিপর্যয়? বিএনপির শেষ গন্তব্যই বা কোথায়। এমন সব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা
কাফি কামাল। তার লেখা ধারাবাহিক  প্রতিবেদনের আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব-
স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পাঁচ বছর বাংলাদেশের জাতীয় জীবন ছিল চাওয়া-পাওয়ার এক জটিল হিসাব-নিকাশের পর্ব। আওয়ামী লীগ তার হিরন্ময় ঐতিহ্য বাঁচাতে চায়নি, ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে খুন হলেন, আওয়ামী লীগ হঠাৎ ছিটকে পড়লো। উত্তরণ ঘটলো নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির। এই দুই অবস্থার অন্তর্বর্তীকালে স্বাভাবিক গণতন্ত্র নিভে গিয়েছিল, এসেছিল তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়ারের কর্তৃত্বপরায়ণ মডেলের সরকার ব্যবস্থা -বাকশাল।
তাজউদ্দীন আহমেদ ও ড. কামাল হোসেনের মতো বঙ্গবন্ধুর অনেক ঘনিষ্ঠজন হতবিহ্বল আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের ভাষায়, স্বাধীনতার শত্রুরা হয়েছিল উল্লসিত। একজন ত্রস্ত বিচলিত কামাল হোসেন লন্ডনে দেশান্তরী হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে সাহস করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমি আপনার মৃত্যুসনদে (বাকশালে সমর্থন) সই দিতে পারি না।’ ’৭৫-এর বিয়োগান্তক পটপরিবর্তন পরবর্তী তিন মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অস্থির-অনিশ্চয়তাময় এক ঘোর অমানিশা। নির্মোহ জীবনদৃষ্টির অধিকারী জিয়াউর রহমান অন্য অনেকের মতোই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চলে যান অনেকটাই পেছনের কাতারে। কিন্তু তাঁর অবদান ও যোগ্যতার স্বীকৃতি তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতেই পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেন। জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান করতে না পারার ক্ষতিও মুজিব পুষিয়ে দিতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। তার প্রমাণ হলো যা উপমহাদেশে কখনও ছিল না, জিয়াকে সম্মানিত করতেই মুজিব সৃষ্টি করেছিলেন সেনা উপপ্রধানের পদ। সুতরাং মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশেই কেবল জিয়া পাদপ্রদীপে এসেছিলেন তা ঠিক নয়। তিনি তাঁর বিশেষত্বের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর হাতেই পেয়েছিলেন। জিয়াকে জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেখ মুজিব তা জিয়ার অনুরোধেই বাতিল করেছিলেন। সুতরাং মুজিব-জিয়া সম্পর্কে কোন চিড় নেই। সম্প্রতি জিয়ার জন্মদিনের আলোচনায় অধ্যাপক বি. চৌধুরী বেগম খালেদা জিয়ার সামনেই বলেন, শহীদ জিয়া কখনও মুজিবের সমালোচনা করেননি। আর আজ বিএনপি নেতারা কি করেন।
আজ যারা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা আসলে প্রকারান্তরে শেখ মুজিবের প্রজ্ঞাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে কি করেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কি করেছেন, তার সবটাই ঘটেছে ১৯৭২ সালে মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে। সুতরাং মুজিবের জিয়া মূল্যায়নের তারিখ ও ঘটনাবলী বিবেচনায় নিলে জাতীয় রাজনীতিতে তিক্ততা কিছুটা হলেও দূর হতে পারে। অবশ্য জিয়া কি প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষে এলেন, সেটা বিচার্য। অনেকের মতে জিয়া যদি কোন কারণে ক্ষমতায় না গিয়ে আওয়ামী লীগকে দ্রুত ক্ষমতায় বসাতে সক্ষম হতেন, বিএনপি গঠন না করতেন, তাহলে জিয়া আওয়ামী লীগের অনেক বেশি প্রিয়ভাজন হতেন। কিন্তু কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো, জিয়ার হাতে যখন ক্ষমতা এসেছিল তখন আওয়ামী লীগ সরকারিভাবে লুপ্ত ছিল। আর বাকশাল পুনরুজ্জীবন যে সম্ভব ছিল না, তার প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগ নিজেই কখনও আর বাকশাল হতে চায়নি।
মাৎস্যন্যায় যুগের অবসান ঘটিয়ে অষ্টম শতকে দেশবাসী বঙ্গের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন একজন সাধারণ গোপালকে। হতাশায় বিপর্যস্ত মানুষ সিপাহী-জনতার বিপ্লবের নামে নতুন প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেন জিয়াউর রহমানকে। ঘটনা পরম্পরায় তিনি হয়ে উঠেন এক অনিবার্য চরিত্র। বাংলাদেশের সিপাহি-জনতা সেদিন ঘোর অমানিশায় কারাবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের মধ্যেই দেখেছিলেন আলোকবর্তিকা। ষড়যন্ত্রকারীদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সিপাহি-জনতা জিয়াকে আসীন করেন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে। এটা লক্ষণীয় যে, আগস্ট অভ্যুত্থানের কুশলীবদের সঙ্গে জিয়ার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও ভাল ছিল বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং মোশতাক আহমেদ ও ফারুক-রশীদ সর্বদা জিয়ার প্রতি কমবেশি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কোন চেষ্টা তার জীবদ্দশায় দেখা যায়নি। অবশ্য তিনি জাতি গঠনের জন্য সব মত ও পথের দল ও গোষ্ঠীকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। ’৭৫-এর ১০ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট সায়েম সরকার গঠিত হলে সেনাপ্রধানের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র, শিল্প, বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট, শিক্ষা, বিজ্ঞান, কারিগরি গবেষণা, আণবিক শক্তি, অর্থ, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে সেদিনটিই ছিল মূলত ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে থাকেন তার দূরদর্শী রাজনৈতিক ভাবনা। ’৭৬ সালের ১লা এপ্রিল খুলনা, ৬ই এপ্রিল কুমিল্লা স্টেডিয়াম ও ২৪শে এপ্রিল সিলেট স্টেডিয়ামের জনসভায় তিনি বলেন, ‘পার্টিতে পার্টিতে, গ্রুপে গ্রুপে অতীতের সকল পার্থক্য ভুলে দেশের প্রগতির জন্য ‘বাংলাদেশী’ রূপে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। যে কোন মূল্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হবে।’
অধ্যাপক বি. চৌধুরী মনে করেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোন সংঘাত নেই। জিয়া একে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাননি। এ বিষয়ে তারা পুস্তিকা করেছিলেন যা তারা বিলিয়েছেন। সাধারণত জাতীয়তাবাদ হয় নৃ ও ভাষানির্ভর। কিন্তু বাংলাদেশে একাধিক জাতিগোষ্ঠী বাস করে, আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আবাস্থলের কারণেও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ভর একটা জাতীয়তাবাদের দরকার পড়েছিল। ভারতীয় বাঙালির স্বাধীনতা আর বাংলাদেশী বাঙালির স্বাধীনতা এক নয়। ওপারের বাঙালির রাষ্ট্র নেই। এপারের বাঙালির রাষ্ট্র আছে।  তাই তিনি নৃ, ভাষা ও ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি ভূখণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটি নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রয়োজন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশের বক্তব্যে জিয়া তার জাতীয়তাবাদের দর্শন স্পষ্ট করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চত্য যেমনি, তেমনি ইসলামি বিশ্ব আবার চীনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের মনোযোগ তিনি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টিতে যার বিরাট প্রভাব পড়েছিল। সার্ক এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধে মধ্যস্থতার একটা উদ্যোগ নিয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেটা সফল না হলেও বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করেছিল। দেশে শ্রমিক ও মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেন। ’৭৭-এর ২১শে এপ্রিল ‘ভগ্নস্বাস্থ্যের’ কারণে প্রেসিডেন্ট সায়েম দায়িত্ব ছেড়ে জিয়াউর রহমানকেই মনোনীত করেন নতুন কর্ণধার। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ এ চিন্তা থেকে তিনি একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সাত্তারকে আহ্বায়ক করে ’৭৮-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি গঠন করেন জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল (জাগদল)। মে মাসে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ন্যাপ (ভাসানী), ইউপিপি, মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি ও তফশিলি জাতীয় ফেডারেশনের সমন্বয়ে জাগদল রূপান্তরিত হয় ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’-এ। সে বছরই আনুষ্ঠানিক নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় বিএনপি গঠনের এ প্রাকপ্রস্তুতি পর্ব। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৮। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক জন্মদিন। জাগদলের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র রমনা পার্কের খোলা চত্বরে ১৯ দফার ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে প্রেসিডেন্ট জিয়া নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন। এর রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম কলেবর ছিল ৭৬। যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৬ জনে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কতটুকু সফল ও সমপ্রসারিত হয়েছে বিএনপি? ২০০৬ সালের শেষ দিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে বিএনপিকে অব্যাহতভাবে একটি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এর আগে তারেক রহমান বগুড়ায় যে মডেলে দল গোছানো শুরু করেছিলেন এবং পরে যদিও তা পরিত্যাগ করেছিলেন, তাকেই আবার চাঙ্গা করা যায় কি না। তারেক রহমান গোপন ব্যালটে ভোটাভুটির মাধ্যমে গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪-এর ২৮শে ডিসেম্বর, জনগণের যেসব মৌলিক অধিকার স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তা দ্রুত ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া গণমাধ্যম মুক্ত করেন, বিধিনিষেধ রহিত করেন, বিচারালয়ের স্বাধীনতা বিশেষ করে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের একটি নোটিশ দিয়ে বরখাস্ত করার মতো বিধান বাতিল করেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শের বিধান প্রবর্তন করেন, যা সংবিধানে আজও টিকে আছে, যে বিধানের কারণে জাতি মাসদার হোসেন মামলার ঐতিহাসিক রায় পেয়েছে।
জিয়া মুজিব সরকারের অনুসৃত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নীতি বজায় রাখেন। দুই পরাশক্তির মধ্যে পাশ্চত্যের দিকে ঝোঁকটা একটু বেশি রেখেও সোভিয়েত ব্লককে একেবারে দূরে ঠেলে দেননি। জিয়াউর রহমানের আমলেই ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা গঙ্গার পানি বণ্টনে ৫ বছর মেয়াদি একটি স্থায়ী চুক্তি করা সম্ভব হয়। নদী বিশেষজ্ঞরা একমত যে, ফারাক্কা পয়েন্টে ন্যূনতম পানিপ্রবাহের ব্যাপারে যেভাবে গ্যারান্টি ক্লজ যুক্ত করা হয়েছিল, সেটা ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে রাখা সম্ভব হয়নি। সমুদ্রসীমা ও তালপট্টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ আলোচনা আগে থেকেই চলছিল। অফশোর ব্লক মার্কিন তেল কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার পরে ভারত বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল শেখ মুজিব বেঁচে থাকতেই। জিয়ার আমলে তালপট্টি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলেও বাস্তবে শক্তি প্রয়োগ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। যৌথ জরিপের মাধ্যমে তালপট্টি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ও সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়েছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তরেখা নির্ধারণ ও শরণার্থী সমস্যা আলোচনার উদ্যোগ, জাপানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে টপকে দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ, ওআইসির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আল কুদস কমিটি, জোটনিরপেক্ষ ব্যুরো ও ওআইসি কাঠামোর মধ্যে যুদ্ধরত ইরান ও ইরাকের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শান্তি কমিটির একক প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ফলে তার সময়ে বহিঃসম্পদ প্রবাহ বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৭৭২ মিলিয়ন ডলার। জিয়াউর রহমানই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সমন্বয়ে সার্কের গোড়াপত্তন করেন, সম্প্রতি ঢাকায় এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।
রাজনীতিতে এসে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী দর্শনের ভিত্তিতে জন্ম দেন বিএনপির। তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হন, বিএনপি একটি উদার ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল। ফলে মানুষ দলে দলে বিএনপিতে যোগ দেয়। স্বল্প সময়েই বিএনপি পরিণত হয় একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে। তখনকার সময়ে গণমাধ্যমের উপস্থিতিও ছিল সীমিত। টেলিভিশন বলতে ছিল শুধু বিটিভি। পত্রিকা ছিল মাত্র কয়েকটি। তার পরও জিয়াউর রহমানের একক প্রচেষ্টায় জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল দেশজুড়ে। কারণ সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। বিএনপি বাংলাদেশের বাস্তবতায় ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটেনি তেমনি ধর্মীয় চরমপন্থাকেও সমর্থন করেনি। লক্ষণীয় হলো, জিয়া রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার দিকে যাননি, যা এরশাদ করেছেন। রাষ্ট্রপরিচালনায় দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিফলনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সামাজিক ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ার নির্দেশনা রয়েছে বিএনপির গঠনতন্ত্রে। ফলে বিএনপির দলীয় কর্মসূচি কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনা সবখানেই দেশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ইসলামী অনুশাসনের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। আবার জিয়া ও তাঁর অনুসারীরা কখনও শরিয়া আইন চালুর চিন্তাও করেননি। আশির দশকে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল জাতীয়তাবাদী ও মধ্যমপন্থি রাজনীতি। কিন্তু ’৯০-এর দশকের পরের প্রজন্ম অর্থাৎ আজকে যাদের বয়স বিশ থেকে পঁচিশ-তাদের মধ্যে বিকাশ ঘটেনি জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থি রাজনীতির।
আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরির পাশাপাশি দলটি দীর্ঘ সময় পরিচালনা করেছে রাষ্ট্রক্ষমতা। তিন যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে চারবার (স্বল্পকালীন ষষ্ঠ সংসদসহ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বিএনপি। প্রথমবার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং পরের তিনবার তারই সহধর্মিণী বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছে দুইবার। উন্নয়নের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল বিএনপি। আর বাংলাদেশ যখন স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই নিহত হন জিয়া। বাংলাদেশ নিপতিত হয় এক দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের কবলে। এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি চমক সৃষ্টি করে বিজয়ী হয়। কারণ মিডিয়া এবং প্রায় সকল বিশ্লেষকরা ধরেই নিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।
বিএনপি সরকার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ফুলবাড়ি কয়লাখনি, কানসাট ও শনির আখড়ার বিদ্যুৎ-পানির আন্দোলন। এ সময় দেশব্যাপী জঙ্গি সন্ত্রাসের উত্থান, একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই পর্বে বিএনপির বড় সীমাবদ্ধতা ছিল নাইন-ইলেভেন পরবর্তী বদলে যাওয়া বিশ্ব রাজনীতিতে তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদের প্রতি সৃষ্ট ভয়ানক সংবেদনশীলতা বুঝতে না পারা।
২০০৪ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সুবাদে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটির বিরাট নেতিবাচক প্রচার পায়। যদিও বিএনপি সরকারই চিহ্নিত জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করেছিল। কিন্তু রাজশাহীতে বিএনপির কিছু নেতা বাংলাভাইকে গণসংবর্ধনা দিয়েছিল, ঢাকার রাস্তায় বাংলা হবে আফগান স্লোগান উঠেছিল। আরও তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল যে, জঙ্গি নেতাদের কারও কারও সঙ্গে জামায়াত ইসলামীর পুরনো সম্পর্ক ছিল। জামায়াত নেতারা এ কথাও বলেছিলেন, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। বিএনপি বুঝতে পারেনি যে, এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত ও সন্দিগ্ধ করেছিল। তবে সাফল্য হিসেবে দলটি দাবি করতে পারে, নকলমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, পরিবেশ দূষণ হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিটেন্স বৃদ্ধি, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। আমদানি, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, প্রবাসী-আয়, খেলাপি ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, সরকারি ব্যয় অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ভাল ছিল। তার পরও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে দুর্ভোগ এনেছে মূল্যস্ফীতি। বিএনপির গত শাসনামলে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল নেতিবাচক প্রচার-অপপ্রচারের দিকে মনোযোগ না দেয়া। কাজ পেতে হলে বিশেষ বিশেষ স্থানে কমিশন দিতে হয়, এটাই প্রচার হয়েছিল সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্ত্রী-এমপি ও ব্যবসায়ী মিলে হঠাৎ ধনী কিছু প্রভাবশালী মানুষ। ফলে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রসহ নানাভাবে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিপর্যয় এবং নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে দলটি। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা রটনা ঘটনা, একটা কিছু হয়েই থাকতে পারে। তবে যতটা পারা যায় রাজনীতিবিদদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু নেতিবাচক প্রচারণার ব্যাপারে দলটির অমনোযোগের কারণে সম্ভবত সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় তৃণমূল সম্মেলনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চলা তারেক রহমানকে। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাকে বাধ্য করা হয় দেশত্যাগে। ওয়ান-ইলেভেনের সে সূত্র ধরে এখনও প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিএনপি। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে নানা ক্রান্তিকাল বিএনপি পার করে এসেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে বর্তমানে বিএনপি একটি অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সে লড়াই হয়ে উঠেছে কঠিন থেকে কঠিনতর।

No comments

Powered by Blogger.