শিশু সামিউল হত্যায় রিমান্ডে মুহিত

সিলেটে শিশু শেখ মো. সামিউল আলম ওরফে রাজন (১৩) হত্যা মামলার আসামি মুহিত আলমের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে সিলেট মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক ফারহানা ইয়াসমিন এ আদেশ দেন।
মুহিতকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আদালতে আবেদন করেছিলের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহানগরের জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেন।
চুরির অভিযোগে গত বুধবার সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে সবজিবিক্রেতা সামিউলকে একটি দোকানঘরের খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মারা যায় সামিউল। পরে তার লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়।
ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নগরের কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা মুহিতকে (৩৫) আটক করে পুলিশে দেয় এলাকাবাসী।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, মামলায় মুহিতসহ তাঁর ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাঁদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়েছে।
মামলায় মুহিত ছাড়া আর কেউ গ্রেপ্তার নেই। সামিউলের খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
ভিডিওচিত্রের সূত্র ধরে গতকাল রোববার প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ‘নির্মম, পৈশাচিক!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়।
এলাকাবাসী জানায়, ২৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্র থেকে নির্যাতনকারী চিহ্নিত এবং তাদের মুখচ্ছবিকে বড় করে তাঁরা পোস্টার তৈরি করেছে।
চুরির অভিযোগে গত বুধবার সামিউলকে কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে একটি দোকানঘরের খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করে ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়। ছবিটি ভিডিওচিত্র থেকে নেওয়া।
গতকাল সকালে ওইসব পোস্টার নগরের কুমারগাঁও বাসস্টেশন থেকে শুরু করে সামিউলের গ্রামের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদে আলী গ্রাম পর্যন্ত সাঁটানো হয়। বেলা একটার দিকে বাদে আলী গ্রামে পোস্টার হাতে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। সামিউলের বাড়ির সামনে মানববন্ধনে একটি পোস্টার হাতে একাত্ম হন তাঁর মা লুবনা আক্তার ও প্রতিবেশীরা। একপর্যায়ে লুবনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।
সামিউলকে নির্যাতন করার ভিডিওচিত্রটি এলাকাবাসীর মাধ্যমে গত শুক্রবার রাতে প্রথম আলোর সিলেট কার্যালয়ে পৌঁছে। এতে দেখা যায়, কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের একটি দোকানঘরের বারান্দার খুঁটিতে সামিউলকে বেঁধে রাখা হয়েছে। খুঁটির সঙ্গে তার দুই হাত পেছন দিক করে বাঁধা। রোলার দিয়ে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত থেমে থেমে চলছিল আঘাত। বাঁধা অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করছিল সামিউল, ‘আমি মরি যাইয়ার! কেউ আমারে বাঁচাও রে বা!’ এতেও বন্ধ হয়নি নির্যাতন। শেষে আকুতি, ‘আমারে পানি খাওয়াও!’ তখন তাঁর চোখ-মুখ বেয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছিল। তাঁকে বলা হলো ‘পানির বদলা ঘাম খা!’
সামিউলকে পেটানোর সময় নির্যাতনকারীরাই ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। ভিডিওচিত্রে তিন-চারজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিওধারণকারী আরও দুজনের কথাবার্তা ও আগন্তুক একজনের উপস্থিতি ছিল।
শুরুতে ‘এই ক (বল) তুই চোর, তোর নাম ক...কারা আছিল...’ বলতে বলতে চুলের মুঠি ধরে সামিউলকে মারধর করা হয়।
নির্যাতনের একপর্যায়ে কয়েক মিনিটের জন্য তার হাতের বাঁধন খুলে হাঁটতে দেওয়া হয়। ‘হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো...’ বলে সামিউলের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়।
মারধর করার সময় একদিকে সামিউলের আর্তচিৎকার, আর অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের মুখে অট্টহাসিসহ নানা কটূক্তি শোনা যায়।
নির্যাতনের একপর্যায়ে মারা যায় সামিউল। পরে তার লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়। ছবিটি ভিডিওচিত্র থেকে নেওয়া।
যে ভিডিও ধারণ করার কাজটি করছিল, তাকে নির্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায় ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কি না। একজনকে তখন বলতে শোনা যায়, ‘ফেসবুকে ছাড়ি দে, এ তো খাঁটি চোর! সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব...’। শেষ দিকে সলা-পরামর্শও চলে। নির্যাতনকারী একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়, ‘কিতা করতাম?’ অপর একজনকে তখন বলতে শোনা যায়, ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’
সামিউলের বাবা শেখ আজিজুর রহমান মাইক্রোবাসচালক। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে সামিউল বড়। আজিজুর জানান, তিনি যেদিন ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতে পারেন না, সেদিন সংসার খরচ চালাতে সবজি বিক্রি করতে বের হয় সামিউল।
মা লুবনা আক্তার জানান, ঘটনার দিন (বুধবার) সামিউলের বাবা গাড়িতে ছিলেন (ভাড়ায়) বলে বাড়ি ফেরেননি। ভোরে টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য সামিউল বের হয়েছিল। সারা দিন ছেলের খোঁজ পাননি তাঁরা। রাতে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার সময় এক কিশোরের লাশ পাওয়ার সূত্র ধরে সামিউলকে শনাক্ত করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.