গ্রিসের যুদ্ধ ও ট্রয়কা by আনু মুহাম্মদ

গ্রিসের মানুষ এখন যুদ্ধের অনুভূতি নিয়ে রাস্তায়। মিছিল হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, গান হচ্ছে, নাটক-কার্টুন, তাত্ত্বিক বোঝাপড়া। রাস্তায় রাস্তায় স্বেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন গ্রুপ দিন-রাত কাজ করছে। লঙ্গরখানা চলছে দিন-রাত। আইএমএফ বা করপোরেট নেতারা বলেন, গ্রিকরা অলস, সে জন্য আজ এই সংকট। এখনকার গ্রিস দেখে কেউ এটা বিশ্বাস করবে না। কর্মসংস্থান নেই, উপার্জনের রাস্তা নেই, তবু বেকার তরুণদের অনেকেই দিন-রাত ব্যস্ত। ভীষণ বিপদের আশঙ্কা, আর তার বিরুদ্ধে সর্বজনের সংগঠন আর সক্রিয়তা ঘরে ঘরে, পথে পথে। তর্কবিতর্ক বিস্তর, সিপ্রাস কি আপস করছে? এই সরকার কি জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে? কেন সিপ্রাস সরকার আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে না আন্তর্জাতিক দস্যুদের বিরুদ্ধে?
গ্রিস এখন মোকাবিলা করছে ট্রয়কা বা ত্রয়ী মহাশক্তি: ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং আইএমএফ। এরা কেউ নির্বাচিত সংস্থা নয়, কিন্তু এদের কাছেই মূল ক্ষমতা। এই তিন মহাশক্তির চাওয়া-পাওয়া, বিশ্বপুঁজির সঙ্গে বাঁধা, একঘেয়ে সুরে অভিন্ন: সর্বজনের সব সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানা বা করপোরেট গোষ্ঠীর মুনাফামুখী তৎপরতার জন্য খুলে দিতে হবে, মজুরি ও পেনশন বাড়ানোর বদলে কমাতে হবে, শিক্ষা-চিকিৎসায় সরকারের দায়িত্ব কমাতে হবে। দক্ষতা, কর্মসংস্থান বাড়ানোর যুক্তিতেই এসব কর্মসূচি আনা হয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে, তাদের কর্মসূচির কারণে যদি কর্মসংস্থান কমে, দক্ষ ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদি দারিদ্র্যবৈষম্য বাড়ে, তখন তারা অন্যদিকে মুখ করে থাকবে অথবা আবারও একই পথে চলতে চাপ দেবে।
আইএমএফের বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আছে। বাংলাদেশে ঋণ, দুর্নীতি আর সম্পদ পাচারের যে রেকর্ড, তাতে অনেক আগেই আরও অনেক খারাপ অবস্থা হতো। অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে প্রবাসী–আয়। এর কারণেই একসময় আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সব যুক্তি ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আইএমএফের বড়শি থেকে বেরিয়ে গেলে শুধু আইএমএফ নয়, বিশ্বের ক্ষমতাধর এমনকি দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অসুবিধা। সুতরাং ২০০৭ সালে নতুন একটি চুক্তির জন্য জোরজবরদস্তি, তদবির শুরু হলো। ঋণ দরকার নেই, তাতে কী? আইএমএফ পরামর্শদান অব্যাহত রাখতে চায় এবং তার জন্য একটি চুক্তি করতে হবে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রবল আপত্তি ও প্রতিরোধের মুখে সরকার এটা সই করতে পারেনি। কিন্তু পরে নির্বাচিত সরকার তদবিরে, অর্থমন্ত্রীসহ উপদেষ্টাদের উৎসাহে বড়শি গেলে, এক বিলিয়ন ডলার ঋণে আটকায় বাংলাদেশ।
গ্রিসের প্রবাসী–আয় দুর্বল, রপ্তানি খাতও শক্তিশালী নয়, রপ্তানি আয়ের শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ করতেই যায়। ‘বাজারই সবকিছুর সমাধান করবে’ এই দর্শন প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকে ব্যাংক-বিমাসহ একচেটিয়া বৃহৎ ব্যবসায়ী ও আমলা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়। গ্রিসে ঋণের সিদ্ধান্ত হয়েছে সে রকমই। বাংলাদেশে যেমন সরকারের ঋণের সিদ্ধান্ত জনগণের নামে নেওয়া হলেও তা প্রকৃতপক্ষে দেশি-বিদেশি ঋণদাতা গোষ্ঠী এবং বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থই রক্ষা করে, গ্রিসেও তার অন্যথা হয়নি। সেখানে একেকবার ঋণ নেওয়া হয়েছে আর গ্রিসের ওপর চাপ বেড়েছে। সেই ঋণ শোধ করতে সর্বজনের সম্পদে হাত দিতে হয়েছে, জনগণের জীবনযাত্রার মান আরও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। গ্রিসেও আইএমএফ বা ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক তাদের সব টাকা ফেরত পেতে আগ্রহী নয়, তারা আরও ঋণ দিতে আগ্রহী, তবে কিছু কাজ করতে হবে সেটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। ঋণ এখানে ক্ষমতাধরদের অস্ত্র। সংকট নিরসনে তাদের রেডিমেড সমাধান প্যাকেজ সবার জন্য একই: ‘কৃচ্ছ্রসাধন’। এই কর্মসূচি সামরিক খাতে ব্যয় কমায় না, শাসকদের বিলাস অপচয় কমায় না, মুনাফা উন্মাদনা বাড়ায়, কমায় জনগণের অধিকার, তার আয় কমায়, ব্যয় বাড়ায়, বাড়ায় বৈষম্য।
গ্রিসের গত কয়েক বছরের ঘটনাবলি সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হতে পারে। ২০০৯ থেকেই গ্রিসের বর্তমান সংকট দৃশ্যমান ও ঘনীভূত হতে থাকে। সে বছর বাজেট ঘাটতি দেখা যায় জিডিপির শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ। এই বছর বিশ্বের প্রধান প্রধান ঋণক্ষমতা পর্যালোচনা সূচকে (ক্রেডিট রেটিং) গ্রিসের অবস্থার অবনতি দেখায় মুডি ও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী সংস্থা। এই অবস্থায় চাপ আসে ‘কৃচ্ছ্রসাধনের’ কর্মসূচি গ্রহণের। ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গ্রিক পার্লামেন্টে গৃহীত হয় প্রথম ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ কর্মসূচি, এই কর্মসূচি অনুযায়ী সব সরকারি কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করা, বোনাস শতকরা ১০ ভাগ কমানো, শ্রমিকদের ওভারটাইম কমানো হয়। এর দুই মাসের মধ্যে ৩ মার্চ দ্বিতীয় কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি পাস হয় গ্রিক পার্লামেন্টে। এতে ছিল পেনশন আর বৃদ্ধি না করা, ভ্যাট শতকরা ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২১ ভাগ করা, তেলসহ কয়েকটি পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় খাতে বেতন হ্রাস। এরপরও ঋণ গ্রহণ ক্ষমতা সূচকে অবনতি ঘটতে থাকে।
২৩ এপ্রিল ২০১০ সালে গ্রিস আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক উদ্ধারের (বেইলআউটের) আবেদন জানালে এই কাজে উৎসাহের সঙ্গে যুক্ত হয় ত্রয়ী সংস্থা। কিন্তু ক্রেডিট রেটিংয়ের অবনতি থামেনি। ২ মে, ১১০ বিলিয়ন ইউরো বা ১৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রথম বেইলআউট প্যাকেজ ঘোষণা করে ত্রয়ী। বিনিময়ে গ্রিক সরকার তৃতীয় কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ৬ মে পার্লামেন্টে এই কর্মসূচি যখন পাস হয়, তখন সারা দেশে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভ এতই তীব্র হয় যে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তিনজন, অসংখ্য আহত হয়। এই বছর কর্মসংস্থান, মজুরি ও পেনশনের ওপর আরও আক্রমণ আসে।
২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর গ্রিক সরকার আস্থা ভোটে বিজয় অর্জন করলেও পরিস্থিতির অবনতিতে দুই মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী পাপান্দ্রু পদত্যাগ করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি এথেন্সসহ বিভিন্ন শহরে আগুন, ভাঙচুর ও বিক্ষোভের মধ্যে গ্রিক পার্লামেন্ট পঞ্চম কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ২৪৬ বিলিয়ন ইউরোর দ্বিতীয় ‘পুনরুদ্ধার’ (বেইলআউট) কর্মসূচি অনুমোদিত হয়। এই বছরেই ৪ এপ্রিল ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে একজন অবসরপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট গ্রিক পার্লামেন্টের সামনে আত্মহত্যা করেন। সহিংস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বছরের শেষদিকে ষষ্ঠ কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি গ্রহণ করে গ্রিক পার্লামেন্ট। ঋণের কিস্তি পেতে এটা করতে বাধ্য ছিল সরকার। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল আরও মজুরি কমানো, অবসর বয়স আরও বাড়ানো, মজুরি শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ কমানো এবং প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই। প্রাপ্ত ঋণের বড় অংশ বেসরকারি খাতের বিভিন্ন ঋণদাতা ব্যাংকের পাওনা ও সুদ পরিশোধেই ব্যয় হয়। শতকরা ১০ ভাগেরও কম অর্থ জনগণের প্রয়োজনে ব্যয় করার জন্য সরকারের হাতে থাকে। শেষ হিসাব অনুযায়ী গ্রিক সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো, যার শতকরা ৭৮ ভাগই ট্রয়কার কাছে। ইউরোপীয় অর্থকরী খাতের জন্যই সব বেইলআউট, আর তার বিনিময়ে যা কিছু কর্মসূচি, তা কিছু গোষ্ঠীর হাতে সর্বজনের (পাবলিক) সম্পদ তুলে দিতে নিবেদিত, যা জনগণের জীবন আরও কঠিন ও অনিশ্চিত করে তুলছে।
২০১৩ সালে সরকারের মধ্যে অনেক পরিবর্তনের পর বছরের শেষে এসে তার পতন হয়। ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ‘কোয়ালিশন অব র্যা ডিক্যাল লেফট’ বিজয় অর্জন করে। সিপ্রাস তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এখন প্রধানমন্ত্রী।
এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বহু দেশ গ্রিসের চেয়েও তিক্ত অভিজ্ঞতা পার করেছে কয়েক দশক আগেই। ৬০ দশক থেকে পরের কয়েক দশকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ গোষ্ঠীর এসব কর্মসূচিতে তাদের ব্যাংক, কৃষি, খনি, তেলক্ষেত্র—সব বহুজাতিক পুঁজির দখলে গেছে, দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে। দেশে দেশে সামরিক শাসন, নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা, দুর্নীতিবাজদের শাসন তৈরি হয়েছে। ৯০ দশকের শেষ থেকে ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এই জাল থেকে বের হওয়ার রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে। এই চেষ্টার কারণেই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ অর্থাৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রোষানলে পড়ে এই দেশগুলো। এখন গ্রিস, পর্তুগাল ও আয়ারল্যান্ডে একই ধরনের কর্মসূচির কারণে দারিদ্র্য, বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। গ্রিসের তরুণদের এখন শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ বেকার। শতকরা ৩৩ ভাগ জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার বাইরে। শতকরা ৩২ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে। জিডিপি ২৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ছয় বছরে কমে হয়েছে ২০০ বিলিয়ন ডলার।
৩০ জুন গ্রিস দেউলিয়া অবস্থায় পতিত হলো। আইএমএফের ঋণকিস্তি পরিশোধের মেয়াদ শেষ। ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধের সময় এই জুলাইয়ে শেষ হবে। এখন তাদের শর্ত মেনে আরও ঋণ নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আগামী ৫ জুলাই গণভোট করার উদ্যোগ নিয়েছে গ্রিক-সিপ্রাস সরকার। এই গণভোট মানে সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের কাছেই ফেরত যাওয়া। এভাবে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে প্রবল বিরোধী ছিল ট্রয়কা, যেমন তারা বিরোধী ছিল গ্রিসের সামরিক খাতে ব্যয় কমানোর প্রস্তাবে। গ্রিস সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে অর্থ সাশ্রয় করতে চায় বহুদিন ধরেই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি ন্যাটোর মাধ্যমে প্রবল বাধা দিয়েছে। গ্রিস তার সামরিক খাতে ব্যয় দিয়ে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র আমদানি করে। সেই বাজার তারা হারাতে চায় না।
এত ঋণ শুধু জালই তৈরি করেছে। ত্রয়ীর পেছনে যে বিশাল করপোরেট ও রাজনৈতিক আধিপত্য আছে, তাদের প্রয়োজন শুধু মুনাফার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ নয়, গ্রিক জনগণ ও রাজনৈতিক শক্তিকে শায়েস্তা করাও। যাতে পুঁজিমুখী সংস্কারের (নয়া উদারনৈতিক বলে যা পরিচিত) বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ পরাজিত হয়, এ রকম জনপন্থী শক্তি নাস্তানাবুদ হয়। কেননা, পুরো ইউরোপে যে কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলো আছে, তা বাতিল করা তাদের এখন অন্যতম এজেন্ডা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রিস যদি পুঁজির স্বার্থকে আঘাত করে জনস্বার্থের পথে যেতে পারে, তা অন্যদেরও উৎসাহিত করতে পারে। সে জন্যই ট্রয়কার জোট অচলায়তন তৈরি করেছে। জাল অনেক জটিল। তবে গ্রিস একা নয়, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বহু দেশে প্রায়ই বিক্ষোভ প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে পুঁজিমুখী সংস্কারের বিরুদ্ধে। ইউরোপের এই প্রতিবাদী আবহাওয়ায় সিপ্রাসদের পিছিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu

No comments

Powered by Blogger.