একালের আওয়ামী লীগকে কেনা যায় by পীর হাবিবুর রহমান

উপমহাদেশে কংগ্রেসের পর প্রবল দাপটে রাজনীতিতে যে দলটি বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আছে তার নাম আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ’৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে ন্যাপ গঠনের মাধ্যমে বেরিয়ে যান। আর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হকের বিয়োগান্তক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। কার্যত বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় গণমানুষের হৃদয়ের ভাষা সুর ও চেতনাকে লালন করে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই আওয়ামী লীগ নামের এই দলটির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। তৃণমূল বিস্তৃত সামন্তশ্রেণীর ধ্বংসস্তূপে পরিণত মুসলিম লীগের কবর রচনা করে শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য সাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্বের ক্যারিশমা, বাগ্মিতা আর ক্লান্তিহীন পথচলার মধ্য দিয়েই গরিবের দল আওয়ামী লীগের বিস্তৃতি ঘটেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় ছাত্রলীগের আন্দোলন সংগ্রামকে অগ্রভাগে রেখে মূলত বঙ্গবন্ধু তার আওয়ামী লীগকে নিজের আপসহীন নেতৃত্বের ইমেজের ওপর ভর করে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জীবন যৌবন উৎসর্গ করা লড়াইয়ের মানসিকতা নিয়ে তৈরি করেছিলেন। ৬ দফার ওপর ভর করে আওয়ামী লীগের যে অগ্রযাত্রা সেখানে বঙ্গবন্ধুর মানিক ভাই খ্যাত ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার শক্তিশালী লেখনী, সমর্থন এমনকি আইয়ুব খানের দমন নীতিকে উপেক্ষা করে জেল খাটা ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। সেই জেলের নির্যাতনই তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পরবর্তী সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই ছিলেন মূলত শেখ মুজিবের নেতা। ৬৩ সালে গণতন্ত্রের সেই মহান নেতার মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি এই দলটিকে নিজের ইমেজের ওপর স্বাধিকার স্বাধীনতার পথে এমনভাবে গড়েছিলেন যে, ৭০ সালের নির্বাচনে মানুষ প্রতিটি আসনেই জাতীয়তাবাদী চেতনায় তার প্রার্থীদের সামনে রাখলেও কার্যত বঙ্গবন্ধুকেই নৌকায় ভোট দিয়েছিল। এদেশের মানুষকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম, সততার রাজনীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পথে ত্যাগের মহিমায় গণমানুষের স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতিই আওয়ামী লীগ শিখিয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিটাই ছিল ত্যাগের রাজনীতি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আটপৌরে সাধারণ নিরাভরণ জীবনের ছবি। কর্মী মূল্যায়নের সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের অতীত ছিল বর্ণময়। কালো মুজিব কোট সাদা পায়জামা পাঞ্জাবিই ছিল আওয়ামী লীগের আত্মঅহংকারের পোশাক। আওয়ামী লীগাররা মানুষের কল্যাণে রাজনীতির জন্য আত্মদানই করেনি; ভিটেমাটি পর্যন্ত শেষ করে রিক্ত নিঃস্ব হয়েছে এমনটাই ছিল তার গৌরবের মুকুট। ভোগ নয়, বিলাসিতা নয়; ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে কর্মী ও মানুষের আস্থা অর্জনের পথেই হেঁটেছেন নেতারা। সেকালের আওয়ামী লীগের সঙ্গে একালের আওয়ামী লীগের যোজন যোজন দূরত্ব ও তফাত। একালের আওয়ামী লীগেও লাখো লাখো ত্যাগী ও সৎ নেতা-কর্মী রয়েছেন। তবুও একালের আওয়ামী লীগের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কারো কারো বা ভোগ বিলাসের ও বিত্ত বৈভবের প্রাসাদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। একালের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে খোদ মুজিব কন্যা ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে মন্তব্যটি করেছিলেন, সেখানেই প্রকৃত চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়।’ এই সবার মধ্যে সব নেতা-কর্মী নয়। কিন্তু মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা যাদের ইঙ্গিত করেছিলেন, তারা ঠিকই জানেন- তাদের কেনা যায়। তাই কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস করেননি। তাদের মধ্যে কারো আত্মমর্যাদা ও সততা থাকলে পদত্যাগ করে চলে যেতেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল গরিবের স্বার্থরক্ষার।
একালের আওয়ামী লীগ স্থানে স্থানে সিন্ডিকেট গঠন করে মানুষের সম্পদ ও অধিকার হরণ করে বসে।  সেকালের আওয়ামী লীগাররা কমিশন বাণিজ্য, তদ্বির বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য ও দখলবাজি জানতেন না। প্রশ্রয় দিতেন না। সাদামাটা জীবনযাপনেই অভ্যস্ত ছিলেন। ৬৬ বছরের মাথায় এসে দাঁড়িয়ে একালের আওয়ামী লীগাররা এইসব ডালভাত মনে করেন। বিত্ত বৈভব বিলাসী জীবনের জন্যই যেন রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর হাতে বিকশিত আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্টের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মধ্য দিয়ে পরিবার পরিজনসহ জাতির জনককেই হারায়নি; রাজনৈতিক করুণ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে ভাঙ্গন-দলাদলি-কোন্দল কবলিত আওয়ামী লীগকে নতুন যাত্রাপথে টেনে নিয়ে যান ৮১ সালের কাউন্সিলে দলের হাল ধরা মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা। তার হাত ধরেই সংগ্রামের সিঁড়িপথে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা ক্ষমতাকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে। তার দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও নারীর ক্ষমতায়ন অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সাহস নজর কেড়েছে। কিন্তু শেয়ার কেলেঙ্কারি থেকে ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা আর দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের একদল নেতা-কর্মীর হরিলুট দলটির গৌরবময় ত্যাগের রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছে।
এক সময় আওয়ামী লীগে মাঠের নেতৃত্ব দিতেন আইনজীবী, শিক্ষকরা। এখন দেন ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরা। আমলা আইনজীবী যারা হাতেগোনা সুযোগ পাচ্ছেন তারাও স্থানীয় দুর্নীতির সিন্ডিকেটে নাম লিখাচ্ছেন। এই আওয়ামী লীগ একটি জাতির স্বাধীনতা ও বিকাশে ইতিহাসের পরতে পরতে ভূমিকা রেখেছে। গরিবের দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চেহারায়ও ছিল সাধারণ বেশভূষা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে এখন অনেকে সেই আদর্শকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। বহু নেতা-কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম ঘাম ও মেধা জড়িয়ে থাকা এই বটবৃক্ষের নিচে অনেকে থাকলেও কতজন যে হারিয়ে গেছেন, ঠাঁই দেয়া হয়নি এই বট ছায়ায়। উল্টোপিঠে টাকাওয়ালারা আশ্রয় নিচ্ছে। ধনাঢ্যদের কদর বাড়ছে। ত্যাগী পোড় খাওয়া বিত্তহীন কর্মীদের মূল্য কমে যাচ্ছে। ত্যাগী নেতাদের জন্য যেটুকু দুয়ার খোলা আছে তা শুধু দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার। বাকি সব বড় নেতা ও মন্ত্রীরা নিজেদের এলাকার বাইরে কর্মীদের প্রবেশাধিকারই দেন না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ ক্ষমতা ঘিরে বিত্ত বৈভব বিলাসিতার রঙিন আমুদে জীবনে স্বপ্নের মতো বাস করছেন। আরেকটি অংশ বঙ্গবন্ধু ও দলকে ভালোবেসে অন্তহীন বেদনা সয়ে কোনো রকম টিকে আছেন। তাদের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারি হলেও দখলবাজদের আধিপত্যের লড়াই বন্ধ হয় না।

No comments

Powered by Blogger.