রাজ্জাক অপহরণের নেপথ্যে রয়েছে ইয়াবা ব্যবসা

মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাক অপহরণের নেপথ্য কাহিনী ইয়াবা-ব্যবসা। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার দুর্গম সীমান্ত রয়েছে। আর এই পথ ধরেই বানের পানির মতো বাংলাদেশে ঢুকছে কোটি কোটি নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট। সেদিনও ইয়াবা বহনকারী একটি নৌকাকে ধাওয়া করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন রাজ্জাকসহ বিজিবি সদস্যরা। দুদেশের চোরাকারবারিদের পাশাপাশি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) কতিপয় সদস্যও অবৈধ এই ইয়াবা-ব্যবসায় জড়িত। কিন্তু  তাদের এ পথে কাঁটা হয়ে কিংবা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজিবি। তাই ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট নিরাপদ রাখতেই পরিকল্পিতভাবে বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা ও অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে মিয়ানমারের বিজিপি। এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হাতে অপহƒত নায়েক আবদুর রাজ্জাককে গত সাত দিনেও ছেড়ে না দেয়ায় চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে বিজিবিতে। এছাড়া গত রোববার বিশ্ব বাবা দিবসের নতুন করে বাবা হয়েছেন রাজ্জাক। এদিন তার স্ত্রীর কোলজুড়ে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান জš§ নেয়। কিন্তু অভাগা বাবা রাজ্জাক মিয়ানমারে অপহƒত থাকায় এখনো তার প্রিয় সন্তানের মুখখানা দেখতে পারেননি। তার স্ত্রীও স্বামীকে ফিরে পেতে অধীর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
গত বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে টেকনাফের নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে বিজিবির ছয় সদস্য দুটি নৌকায় করে টহল দিচ্ছিলেন। তারা ইয়াবা ট্যাবলেট ভর্তি একটি নৌকাকে ধাওয়া করে আটক করার চেষ্টা করছিলেন বিজিবি। এ সময় একটি টহল নৌকাকে লক্ষ্য করে বেসামরিক পোশাক পরিহিত মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় বিজিপির একটি টহল দল নায়েক রাজ্জাককে একটি এসএমজি ও ৩০ রাউন্ড গুলিসহ অপহরণ করে নিয়ে যায়। বিজিপির গুলিতে বিজিবির সিপাহী বিপ্লব আহত হন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকেই মূলত বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা নিয়মিত আসছে। যে এলাকায় নায়েক রাজ্জাকসহ বিজিবির সদস্যরা আক্রান্ত হয়েছেন একই পথে গত এক বছরে বিজিবি ১২ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। যার বাজার মূল্য কোটি কোটি টাকা। এছাড়া কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। সূত্রগুলো জানায়, ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও জড়িত। নাফ নদীসহ আশপাশের এলাকায় বিজিবি টহল জোরদার করলে তাদের অবৈধ আয়ের পথ হ্রাস পায়। আর এতেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বার বার হামলা চালিয়ে বিজিবি সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। একই সূত্র মতে, মানব পাচার, চোরাচালান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগে কয়েক বছর আগে নাসাকা বাহিনী বিলুপ্ত করে বিজিপিকে বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েন করে মিয়ানমার। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যেই বিজিপির বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ওঠে।
সূত্র মতে, বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ফেরত দিতেও নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি) একেক দিন তারা একেক রকম বক্তব্য ও তথ্য দিচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার রাতে বিনা শর্তে নায়েক রাজ্জাককে আগামী দুই-একদিনের মধ্যে মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দেয় বিজিপি। এর আগে এদিন দুপুরে মিয়ানমান কর্তৃপক্ষের কথা হয় বিজিবির কর্মকর্তাদের। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মানব পাচারের শিকার হয়ে যারা এখন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছেন, তাদের সঙ্গে ফেরত দিতে চান নায়েক রাজ্জাককে। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এ শর্তপূর্ণ সিদ্ধান্তে রাজি নয় বিজিবি।
বিজিবি সূত্র মতে, নাফ নদীর একই স্থান ও সীমান্তপথে ইয়াবা পাচারকারীদের ধরতে গেলে গত বছরের ১৪ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বিজিবির ওপর হামলা চালায়। তখন বিজিবি সদস্য সুমনসহ কয়েকজন আহত হন। মিয়ানমার সীমান্তের যে পথ দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেখানেই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির একটি ক্যাম্প রয়েছে। যার নাম ‘রানাও ক্যাম্প’। সীমান্তে ইয়াবা উদ্ধারে বিজিবি সদস্যরা এগিয়ে গেলেই ওই ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যদের লক্ষ্য করে বার বার গুলি চালানো হয়। সূত্র জানায়, এ আগে গত বছরের ২৮ মে বিজিবির নায়েক মিজানকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একই কায়দায় গুলি করে হত্যা করে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। পরে তার মৃতদেহ হস্তান্তরেও বিজিপি নানা টালবাহানা ও জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। তখনও মিজান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) জঙ্গি উল্লেখ করে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালায়। পরে তারা মিজানের লাশ সহজ পথে না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্গম এলাকায় হস্তান্তর করে। 
এ বিষয়ে বিজিবির ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু জার আল জাহিদ বলেন, সোমবার তিন দফায় কথা হয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তারা নতুন করে শর্ত দিচ্ছেন তাকে মংদু সীমান্ত দিয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, একই সঙ্গে তারা মানব পাচারের বিষয়টি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। কিন্তু মানব পাচার ও নায়েক রাজ্জাকের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহিদ বলেন, কোানো শর্ত ছাড়াই কখন কিভাবে নায়েক রাজ্জাককে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হবে, জানাতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। এখন আমরা অপেক্ষায় আছি।

No comments

Powered by Blogger.