গাছেই ধরছে আসবাবপত্র

উইলো গাছগুলো বড় হচ্ছে চেয়ারের আকৃতিতে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
উইলো গাছগুলো বড় হচ্ছে চেয়ারের আকৃতিতে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
‘টাকা কি গাছে ধরে? ’ কথাটির সঙ্গে সবাই পরিচিত। কিন্তু ‘আসবাব কি গাছে ধরে? ’ এ রকম কিছু কেউ শুনেছেন বলে মনে হয় না।
কিন্তু সত্যি সত্যি আসবাবপত্র গাছে ফলাচ্ছেন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা গেবিন মুনরো। তিনি একটি বাগান করেছেন যেখানে গাছে ‘থোকায় থোকায় ধরছে’ চেয়ার, আয়নার কাঠামো ও ঝুলন্ত ল্যাম্পের কাভার।
প্রথম দেখাতেই ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ার ডেলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিয়মিত দৃশ্য বলেই মনে হবে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে মাঠের মাঝখানে খুব অদ্ভুতভাবে কিছু গাছ বড় হয়ে উঠছে। কচি উইলো গাছগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। পাখি, মৌমাছি এবং বোলতার শব্দ মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত এক রাখালি পরিবেশ। অদ্ভুত গাছগুলো আসলে উপুড় করে রাখা চেয়ার যার শেকড় গেঁথে আছে মাটিতে।
সিলিন্ডারে প্যাঁচানো উইলো। ল্যাম্প কাভার হিসেবেই গড়ে তোলা হচ্ছে গাছগুলোকে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সিলিন্ডারে প্যাঁচানো উইলো। ল্যাম্প কাভার হিসেবেই গড়ে তোলা হচ্ছে গাছগুলোকে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
গেবিন মুনরো। এই বাগান এবং ব্যবসাটির প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন ছিল সেটাকে বাস্তবায়ন করতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি কোম্পানি। ব্যবসা বলা হচ্ছে কারণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই কাজটি করছেন।
কীভাবে হচ্ছে? মুনরো বলেন, ‘ধারণাটি সহজবোধ্য। গাছ কেটে ফার্নিচার তৈরি করার চেয়ে আমি চাই গাছগুলোই চেয়ার, আয়না, বাতি কাভারের আকারে বেড়ে উঠবে।’
কীভাবে হচ্ছে গাছেই আসবাব? মুনরো পদ্ধতিটাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে মনে হয় প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ। ‘আমরা গাছ রোপণ করি, তাদের একটা আকৃতি দিই যেটা অনেকটা মাচা বেয়ে গাছ উঠার মতো। গাছগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো।’ গেবিন ব্যাখ্যা করেন। ‘যখন গাছগুলো আমাদের মনের মতো কাঠামো তৈরি করে, তখন সেগুলো কেটে ফেলা হয় এবং শুকানো হয়। এরপর একটি শক্ত এবং সুন্দর চেয়ার আপনাকে দেওয়া হবে যা পুরোটাই একটা গাছের তৈরি।’
নিজের বাগানো সস্ত্রীক গেবিন মুনরো। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
নিজের বাগানো সস্ত্রীক গেবিন মুনরো। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
আসলেই কি এত সহজ? মুনরোর সরু উইলোর কচি শাখাগুলো মাটি থেকে কিছু দূর ওঠার পরই গাছের শাখাগুলো চেয়ারের পেছনের অংশে পরিণত হয়, এর পরের অংশটুকু বসার জায়গা এবং সর্বশেষ অংশটি হয় চেয়ারের পায়া। পুরো গাছটিকে একটি নীল কাঠামোর সঙ্গে শক্ত করে বেধে দেওয়া হয় যেন সেটি চেয়ারের কাঠামোতে আসে। মুনরোর বাগানের গাছের পরের সারিটিতে একটি সিলিন্ডারের চারিদিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বড় হচ্ছে গাছগুলো। এগুলোকে পরবর্তীতে ঝুলন্ত ল্যাম্পের কাভার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়াও সেখানে আছে আয়নার কাঠামোও এবং ঝুলন্ত বিছানা।
গাছেই সরাসরি আসবাব ফলানোর এই পরিকল্পনাটা কীভাবে আসে তার ব্যাখ্যা দিলেন মুনরো। ‘যখন শিশু ছিলাম তখন আমার মেরুদণ্ডে সমস্যা হয়েছিল। এবং আমার পিঠকে সোজা করার জন্য অস্ত্রোপচারও করা হয়। চিকিৎসার অংশ হিসেবে একটি কাঠামোর মধ্যে রাখা হয়েছিল আমাকে। ঠিক সেভাবেই আমরা গাছগুলোকে একটি কাঠামোর মধ্যে রাখি। একই সময়ে আমার মায়ের একটা বনসাই ছিল। এবং সেটিরও বড় হওয়া দেখেছি। আমি এসব দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। চিন্তা এসেছে মাথায় যে প্রকৃতি থেকে সরাসরি চেয়ার তৈরি করা যাবে।’
মুনরো বলেন, ‘যদি বনসাই একটি চেয়ারের মতো করে গড়ে উঠতে পারে, অন্য আসবাবগুলোও সেভাবে হতে পারে না কেন? কেন আমি পুরো একটি মাঠই এভাবে তৈরি করতে পারি না? তাহলে আসবাব তৈরিতে কোনো অপচয়ও হবে না এবং অবকাঠামোগত দিক থেকে এটা আরও বেশি শক্ত হবে।’
নিজের বাগানে করা ল্যাম্প কাভারের সঙ্গে গেবিন মুনরো। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
নিজের বাগানে করা ল্যাম্প কাভারের সঙ্গে গেবিন মুনরো। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
মুনরো এক সময় ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়াতে। সেখান থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে কাজে মন দেন। ১০ বছর আগে পরিকল্পনামতো শুরু করেন কাজ। একজন বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া পাঁচ হাজার পাউন্ড বিনিয়োগ করে কেনেন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ‘আমরা একটু ভিন্ন ধরনের কাঠ চাইছিলাম তাই উইলোকে প্রধান উপকরণ হিসেবে বেছে নিলাম। এটি দ্রুত বড় হয় এবং এই গাছ নিয়ে কাজ করতেও সুবিধা।’ অনেক দ্রুত বাড়লেও গাছ রোপণ থেকে শুরু করে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি পেতে ছয় বছরের মতো সময় লাগে। ৫০ বছরের পরিকল্পনা মুনরোর। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিটাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার অনেক উপায় আছে। যেখানেই গাছ জন্মে সেখানেই আসবাব জন্মানো যাবে।
‘আমাদের প্রথম চেয়ারটি আগামী বছরই পাওয়া যাবে এবং এর মধ্যেই আমরা সেটি বিক্রি করে দিয়েছি। এবং পুরো পৃথিবীজুড়েই আমরা বিভিন্ন মানুষের আগ্রহ বুঝতে পারছি।’ অনেকেই এ কাজ করতেও আগ্রহী। এভাবেই নিজেদের পণ্যের চাহিদার কথা জানালেন মুনরো। তিনি জানান, চেয়ার এবং ল্যাম্পের এই অগ্রিম চাহিদা এবং বিক্রিই টিকিয়ে রেখেছে ব্যবসাটিকে। ওই টাকা দিয়ে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেউ স্বল্প মেয়াদে; কেউ পূর্ণ মেয়াদে।
গাছ থেকে সরাসরি পাওয়া চেয়ার ও টেবিল। আগামী বছর বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যাবে এ আসবাব। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
গাছ থেকে সরাসরি পাওয়া চেয়ার ও টেবিল। আগামী বছর বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যাবে এ আসবাব। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সমস্যা একটাই, এই পণ্যের খরচ অনেক বেশি। যে পরিমাণ সময়, পরিশ্রম এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয় তাতে খরচটা বেড়ে যায়। প্রতিটি চেয়ারের দাম শুরু হয়েছে দুই হাজার ৫০০ পাউন্ড থেকে, ল্যাম্প ৭০০ পাউন্ড থেকে এবং আয়নার কাঠামো ৪৫০ পাউন্ড থেকে।

No comments

Powered by Blogger.