‘সিভিল টিম’ নিয়ে পুলিশে অস্বস্তি by নুরুজ্জামান লাবু

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে থানা পুলিশের সিভিল টিম। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারির নামে পুলিশের সিভিল টিম এখন অনেকের কাছে এক আতঙ্কের নাম। সাধারণ মানুষকে নানারকম ভয়-ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আসছে একের পর এক। এতে অস্বস্তিতে পড়েছেন খোদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার রাজধানীর থানাগুলোতে সিভিল টিম না রাখার কঠোর নির্দেশনা জারি করেছেন। এমনকি গতকাল সকালে ডিএমপি সদর দপ্তরে ক্রাইম কনফারেন্সেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের সিভিল টিমের বিরুদ্ধে সবসময়ই নানা অপকর্মের অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ছে। অভিযানের নামে আটক করে চাঁদাবাজি করাই মূল লক্ষ্য হলো সিভিল টিমের। চাহিদা মতো অর্থ দিতে না পারলেই পেন্ডিং মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয় সিভিল টিমের সদস্যরা। এমনকি নিজেদের কাছে থাকা মাদকদ্রব্যও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উদ্ধার দেখানোর নামে আদায় করা হয় অর্থ। ডিএমপির ৪৯টি থানার প্রায় প্রতিটিতেই অন্তত দুটি করে সিভিল টিম রয়েছে। একজন সাব-ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে গঠিত একটি সিভিল টিমে একাধিক এএসআই ও অন্তত ৩-৪ জন কনস্টেবল রাখা হয়। সর্বদা সঙ্গে থাকে একাধিক সোর্স। পুলিশের ওয়াকিটকির কলসাইনে এই টিমের সদস্যরা জেমিনি টিম নামেই সর্বাধিক পরিচিত। রিক্যুইজিশন করা মাইক্রোবাসে করে ঘুরেন তারা। দিনের চাইতে রাতে বেশি দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সিভিল টিমের কাজই হলো সংশ্লিষ্ট এলাকার বাজার বা মোড় এলাকায় মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কোন পথচারী বা গভীর রাতে ঘরে ফেরা কাউকে পেলেই সিভিল টিমের সদস্যরা তাকে আটক করে প্রথমে জেরা করেন। একপর্যায়ে মিথ্যে অভিযোগে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে ঘোরাতে থাকেন। এরপর আটককৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘সমঝোতা’ হলে রাস্তা থেকেই তাকে ছেড়ে দেয়। দাবিকৃত অর্থ পাওয়া না গেলে পেন্ডিং মামলা বা মাদক উদ্ধার দেখিয়ে চালান করা হয় আদালতে। যদিও বেশির ভাগই অর্থের বিনিময়ে ছাড়া পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও এদের রয়েছে সখ্য। সোর্সের মাধ্যমে মাদকের স্পটের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে থাকেন সিভিল টিমের সদস্যরা। মাদক ব্যবসায়ীকে আটক না করে মাদকাসক্তদের আটক করাই তাদের থাকে মূল লক্ষ্য। একটু সচ্ছল পরিবারের কেউ হলে তো কথাই নেই। মামলা-রিমান্ডের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় লাখ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পল্লবী থানার সিভিল টিমের সদস্যরা নাহিদ নামে এক যুবককে ধরে নিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না পেয়ে তারা নাহিদকে হত্যা করে ভাষানটেক এলাকায় লাশ ফেলে দেয় বলে তার স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই নিরপরাধ লোকজনকে ধরে ভয়-ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেই চলছে।
সূত্র জানায়, থানার সিভিল টিমের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট এলাকার ডিসি অফিস হয়ে পুলিশ কমিশনারের অফিস পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। তাই লাগাম টেনে ধরা হয়েছে পুলিশের সিভিল টিমের। ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া থানায় থানায় এসব সিভিল টিম পরিচালনা বন্ধের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। ডিএমপি সূত্র জানায়, গত ১৭ই জুন ডিএমপি কমিশনার সিভিল টিম বন্ধের জন্য নির্দেশনা জারি করেন। কমিশনারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও একাধিক থানায় সিভিল টিম পরিচালনা করা হচ্ছিল। এ কারণে গত ২১শে জুন ডিএমপি কমিশনার ‘কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অমান্য করে সিভিল টিম পরিচালনার বিষয়ে আরেকটি নির্দেশনা জারি করেন। ফাঁড়ি ইনচার্জ থেকে শুরু করে থানার অফিসার ইনচার্জ, উপ-কমিশনারসহ ৮টি ক্রাইম জোনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়।
নতুন করে পাঠানো এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গত ১৭ই জুন সিভিল টিম পরিচালনা না করার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদানের পরেও বিভিন্ন থানা বা ইউনিট থেকে সিভিল টিম পরিচালিত হচ্ছে মর্মে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ জনগণ সিভিল টিম কর্তৃক হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিভিল টিম পরিচালনার ফলে সিভিল টিমের সদস্য কর্তৃক নিরীহ জনসাধারণকে অসৎ উদ্দেশ্যে আয়ত্তে নিয়ে নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। নিরাপদ  ঢাকা মহানগরী গড়ে তোলার ঢাকা মেট্রোপলিটন কর্তৃক গৃহীত যাবতীয় শুভ উদ্যোগকে যা প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি করে। কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অমান্য করে এ রকম সিভিল টিম পরিচালনা অসৎ উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়, এ নির্দেশনা ভঙ্গ করে কোন থানা বা ইউনিট যদি সিভিল টিম পরিচালনার মাধ্যমে নিরীহ জনসাধারণকে হয়রানি করা হয় তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্য, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ইউনিট প্রধানগণ দায়ী হবেন। তবে ইস্যুভিত্তিক (কোন টার্গেটকে গ্রেপ্তার, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র উদ্ধার, ভিকটিম উদ্ধার ইত্যাদি) সাময়িক সময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট উপ-পুলিশ কমিশনারের  নির্দেশনা নিয়ে সিভিল টিম পরিচালনা করা যেতে পারে। তবে ঐ ইস্যু সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে অনতিবিলম্বে ওই সিভিল টিমের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টি পূর্বেই যুগ্ম পুলিশ কমিশনার ক্রাইম বা অপারেশনকে অবহিত করতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন শাখার উপ-কমিশনার  টুটুল চক্রবর্তী জানান, ডিএমপির বিভিন্ন থানার সিভিল টিম পরিচালনা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কারণে কেউ সিভিল টিম চালাতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হবে।
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, সাদা পোশাকে অপরাধীদের ধরতে তুলনামূলক সহজ বলে থানায় থানায় সিভিল টিম গঠন করা হয়। তবে অপরাধী ধরার চাইতে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার কারণে ২০০৩ সালে ডিএমপিতে সিভিল টিমের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৮ সালের শেষের দিকে আবারও ডিএমপির থানাগুলোতে সিভিল টিমের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু সিভিল টিমের বিরুদ্ধে ধারবাহিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে বছর দুয়েক আগে একবার সিভিল টিম পরিচালনায় কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.