বিশ্বকাপের প্রতিশোধ

মেলবোর্ন থেকে মিরপুর। ১৯শে মার্চ থেকে ১৮ই জুন। ব্যবধান মাত্র তিন মাস। আম্পয়ায়ারদের কারচুপিতে হেরে যাওয়া দগ্ধ বাংলাদেশ যেন খানিকটা শীতল প্রলেপ পেলো। মধ্য রাত। তবুও জেগে বাংলাদেশ। ভারতের হার দেখতে উন্মুখ গোটা জাতি। আবালবৃদ্ধবণিতার চোখ টেলিভিশনের পর্দায়। পথে প্রান্তরে যেখানে টেলিভিশন সেখানেই মানুষের ভিড়। কোন সিনেমা নয়, নয় কোন নাটক বা সিরিয়াল, সব টেলিভিশনেই ক্রিকেট আর ক্রিকেট। সাকিবের বলে উমেষ যাদব লেগ বিফোর আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গগণবিদারী চিৎকারে উবে যায় রাতের নীরবতা। শহরে-নগরে ক্রিকেটপ্রেমীদের উল্লাস চলতে থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। অনেকেই ঘুমাননি প্রথম রোজার সেহরি খাওয়া পর্যন্ত। এ আনন্দ কেবল একটি জয়ের নয়, বাধভাঙ্গা এ উল্লাস এক প্রতিশোধের। ৭৯ রানের সহজ জয়। বাংলাদেশের ৩০৭ রানের জবাবে ভারত অলআউট ২২৮ রানে। পুরো শক্তির ভারতও রুখতে পারেনি তারুণ্য নির্ভর বাংলাদেশকে। ব্যাটিংয়ে সৌম্য-সাব্বির আর বোলিংয়ে মুস্তাফিজ-তাসকিনের অদম্য নৈপুণ্য ভারতের হার নিশ্চিত করে। বিশ্বকাপের সেই হারের মধুর প্রতিশোধ এর চেয়ে আর কি হতে পারে? অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। রোহিত শর্মাকে আউট না দেয়া এবং দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মাহমুদুল্লাহকে বিতর্কিত আউট দিয়ে কলঙ্কিত হন আম্পায়াররা। ওই খেলায় আম্পায়ারদের ভূমিকার প্রতিবাদ করে আইসিসি‘র প্রেসিডেন্টের পদ থেকেও সরে দাঁড়ান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রধান আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ক্রিকেটাররা খেলার আগে যাই বলুন না কেন, এমন একটি জয়ের জন্য তেতে ছিলেন কোটি বাংলাদেশী।
অসাধারণ বাংলাদেশের দুর্দান্ত সূচনা। ব্যাটে-বলে সুস্পষ্ট দাপট। বিশ্বসেরা তারকামেলায় সব আলো কেড়ে নেন ১৯ বছরের মুস্তাফিজ। ওয়ানডেতে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির একমাত্র মালিক যিনি, যিনি মেলবোর্নে শতরান করে বাংলাদেশকে হারিয়েছিলেন সেই রোহিত শর্মার উইকেট দিয়েই স্বপ্নের অভিযাত্রা মুস্তাফিজের। বিশ্বককাপজয়ী মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলি, সুরেশ রায়না, শিখর ধাওয়ানের মতো তারকাদের মাথা হেট। সাতক্ষীরার লাজুক ছেলেটির বোলিং নৈপুণ্যে নির্বাক শতকোটি ভারতীয়। অভিষেকে ৫০ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরাও হন বাঁ হাতি এই বোলার। মহেন্দ্র সিং ধোনির ধাক্কায় দ্বিতীয় স্পেল শেষ না করেই মাঠের বাইরে যেতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ফিরে এসে ক্রমেই হুমকি হয়ে ওঠা রায়নাকে বিদায় করে খেলায় ফেরান দলকে। এরপর আরও দুজন তার শিকার। বাংলাদেশ যে কেবল স্পিন নির্ভর দল নয়, তার প্রমাণও হয়ে গেল এ খেলায়। অনেক দিন পর বাংলাদেশ দল মাঠে নামে চার জন ফাস্ট বোলার নিয়ে। আর ফাস্ট বোলাররাই বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে যুগান্তকারী জয়। আরেক ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদই দুরন্ত সূচনায় এগুতে থাকা ভারতের লাগাম টানেন। তার দু’ উইকেট নেয়ার পর শুরু হয় মুস্তাফিজের অভিযান। ১০ বছর আগে ঠিক এই দিনে ইংল্যান্ডের কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম বারের মতো হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের এটি চতুর্থ জয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে এ মাঠেই এশিয়া কাপের খেলায় ৫ উইকেটে জয়ী হয় বাংলাদেশ। এক জয়ে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়েও এক ধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে উঠে এসেছিল আট-এ। এ সিরিজেই সাত নাম্বারে। এতে ২০১৭’র আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সরাসরি খেলার জন্যে সামনের পাঁচ খেলায় একটি জয়ই প্রয়োজন। গতকাল মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে তরুণ মুস্তাফিজুর রহমানের বিধ্বংসী বোলিংয়ে গুড়িয়ে গেছে ভারত। জাএনজি আইসক্রিম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন এখন দেখতেই পারে বাংলাদেশ। রোববার এ মাঠেই অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেটি। ২০ ওয়ানডেতে এটি অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১৪তম জয়।
৩০৭ রান ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। আর এই সংগ্রহকে তাড়া করতে নেমে ভারতের সূচনাটা ছিল বেশ। বিনা উইকেটে প্রায় ১০০ রান তুলে ফেলেন রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান। টেস্টে কিপিং না করা মুশফিককে প্রথম দিকে কেমন যেন প্রস্তুত মনে হচ্ছিল। মাত্র তিন বলে দুইবার ক্যাচ ফেলেন মুশফিক। পেসার রুবেল হোসেনের বলে মুশফিক ভারতীয় ওপেনার শিখর ধাওয়ানের ক্যাচ ফেলেন ৮.৫তম ওভারে। পরে ৯.২তম ওভারে তিনি ফের ধাওয়ানের ক্যাচ ফেলেন মাশরাফির ডেলিভারিতে। বাংলাদেশ শিবিরে তখন ম্যাচ হারার শঙ্কা। পরে অবশ্য এই মুশফিকই উইকেটের পেছনে পাঁচটি ক্যাচ নিয়ে নিজের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। তবে উইকেট-অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বল হাতে দলকে প্রথম সাফল্য এনে দেন তরুণ পেসার তাসকিন আহমেদই। ১৬তম ওভারে কাঁধ বরাবর দেয়া তাসকিনের বাউন্সারে ব্যাট ঠুকে উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহীমের গ্লাভসে ক্যাচ দেন ভারত ওপেনার শিখর ধাওয়ান। ৩৮ বলে ৩০ রান করেছিলেন তিনি। এতে ১৬ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৯৫/১। গত বছরের জুনে এই ভারতের বিপক্ষেই অভিষেকে পাঁচ উইকেট নিয়ে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখেন তাসকিন। ডান হাতি এ বোলার একই ক্যারিশমা দেখান তার পরের ওভারেও। তাসকিনের বাউন্সারে বেসামাল ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি। বুক সমান বল ঠুকতে গিয়ে মুশফিকের হাতে ধরা। টানা তিন খেলায় ১ রান করে আউট হলেন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম বিস্ময় বালক বিরাট কোহলি। প্রথম স্পেলে সুবিধা করতে না পারলেও দ্বিতীয় স্পেলে পরপর দুই ওভারে নেন দুই উইকেট। নিজের পঞ্চম আর ইনিংসের ২১তম ওভারে তার বলে মাশরাফির হাতে ক্যাচ দেন অনমনীয় রোহিত শর্মা। ৬৮ বলে ৬৩ রান করেন তিনি। দলের রান তখন ১০৫/৩। রোহিতের পর রাহানে যখন থিতু হওয়ার চেষ্টা করছিলেন তখনই আউট। মুস্তাফিজের বলে নাসির অসাধারণ ক্যাচ নিয়ে ফেরত পাঠান তাকে।  এরপর বুক চিতিয়ে মাঠে নামেন ধোনি। কি তার আত্মবিশ্বাস। পেস বোলরদের পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। কিন্তু স্পিনার সাকিব আল হাসানের প্রথম ওভারেই ধোনি বিদায়। ভারতের সংগ্রহ ১২৮/৫। ২৬ ওভারে ১২৮ রানেই অর্ধেক উইকেট হারায় ভারতের। জয়ের সুঘ্রাণ আসতে শুরু করে তখন থেকেই। খানিক আগেই রান নেয়ার সময় অনেকটা ইচ্ছা করে মুস্তাফিজকে মাঠের বাইরে পাঠান ধোনি। ষষ্ঠ উইকেটে রায়না ও জাদেজা অর্ধশতরানের জুটি গড়ে আশা জাগান ভারতীয়দের মনে। কিন্তু এবারও মুস্তাফিজ। প্রথম বলে ছক্কা হাঁকিয়ে রায়না যখন বিজয়ীর ভাব নিচ্ছিলেন তখনই পরপর দুই বলে আঘাত। প্রথমে রায়না পরের বলেই অশ্বিন। ১৮৮ রানে ৭ উইকেট পতনের পর আর বেশি দূর এগুতে পারেনি ভারত। ভুবনেশ্বর কুমার ২১ বলে ২৫ রান করে ব্যবধান খানিকটা কমান কেবল।
গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা মাঠে শুরুতে ছিল তামিম ইকবাল-সৌম্য সরকারের ঝড়। আর শেষে নাসির-মাশরাফির। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ৩০০ ছাড়ানো ইনিংস। এর আগে ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে এ মাঠেই করেছিল ২৯৬/৬। সেদিন ওপেনিংয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন তামিম ও ইমরুল জুটি। এবার তামিমের সঙ্গে তরুণ সৌম্য সরকার। এই দু’জন ওপেনিংয়ে শতরানের রেকর্ড জুটি দিয়ে শুরু করেন। মাঝের ১ ঘণ্টা ৪ মিনিট বৃষ্টিতে ম্যাচ বন্ধ থাকায় কিছুটা ছন্দপতন। তবে শেষ পর্যন্ত দেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ৯ম বার ৩০০ ছাড়ানো ইনিংস আর সব মিলিয়ে ৭ম সর্বোচ্চ স্কোর।
টসে জয় দিয়ে প্রথম ওয়ানডেতে যাত্রা শুরু করেন অধিনায়ক মাশরাফি। ব্যাট হাতে নেমে দুই ওপেনারের ব্যাটে যেন প্রতিশোধের আগুনই ঝরছিল। প্রথমবার টাইগাররা টেস্ট খেলুড়ে  সেরা ৮ দেশের মধ্যে ভারতের বিপক্ষে দ্রুত গতিতে ১০০ রান করেন। এর আগে র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ম স্থানে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭৩ বলে ১০০ রান করেছিল বাংলাদেশ। ওপেনিং জুটিতে ১০২ রান করার পর দুর্ভাগ্যের শিকার বাংলাদেশ তরুণ সৌম্য সরকার। নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১০ ম্যাচেই দ্বিতীয় ফিফটি তুলে যখন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখছিলেন তখনই তামিম ইকবালের ভুল ডাকে ক্রিজ ছেড়ে বের হয়ে আর ফিরতে পারেননি। তার আগেই সুরেশ রায়নার দুর্দান্ত এক থ্রো স্টাম্প ভাঙলে শেষ হয় সেই স্বপ্ন। তবে আউট হওয়ার আগে মাত্র ৪০ বলে করেন ৫৪ রান। ৮টি চারের মারের সঙ্গে অশ্বিনের বলকে মিডউইকেটের উপর দিয়ে উড়িয়ে একটি বিশাল ছক্কাও হাঁকান এই তরুণ। তার বিদায়ের পর ব্যাট হাতে অভিষেক হয় আরেক তরুণ লিটন দাসের। কিন্তু ১৫.৪ বাংলাদেশের ব্যাটিং তা-বে পানি ঢালতেই যেন নামে বেরসিক বৃষ্টি।
১২০ রানে ১ উইকেট হারিয়ে সাজঘরে ফিরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু লম্বা বিরতির পর বৃষ্টির আগের ব্যাটিং তা-বে যেন ম্লান হয়ে যায়। ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৬০ রানের ইনিংসটি আবারও ঘুরে-ফিরে আসে। দলীয় ১২৯ রানের সময় ক্যারিয়ারে ৩০তম ফিফটি হাঁকিয়ে আউট হন তামিম ইকবাল। অশ্বিনের বলে মিড অফে নিজের উইকেটটি শর্মার হাতে তুলে দিয়ে মাঠ ছাড়েন ৬০ রানে। ৬২ বলের ইনিংসটি সাজান ৭টি চার ও ১টি ছয়ের মারে। এরপর দলের হাল ধরেন ওয়ানডের সাবেক অধিনায়ক ও উইকেট কিপার মুশফিকুর রহীম। একপাশে মুশফিক অন্যপাশে লিটন দুই প্রজন্মের দুই উইকেট কিপারের উপর যেন সব আশা-ভরসা। কিন্তু  টেস্ট অভিষেকে আলো ছড়ানো লিটন ওয়ানডে অভিষেকে বিদায় নিলেন মাত্র ৮ রানে। এর পরপরই মুশফিকও আউট ১৪ রানে। অযথাই উড়িয়ে মারার খেসারত দেন তিনি। সেখান থেকেই দলের হাল ধরেন সহ-অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও তরুণ সাব্বির রহমান রুম্মান। ৫ম উইকেটে ভারতের বিপক্ষে ৮৩ রানের জুটি গড়েন এই দুজন। সাব্বিরের ঝড়ে খানিকটা এলোমেলো হয়ে পড়ে ভারত। পাঁচটি ৪ ও  ১টি ছয়ের মারে সাব্বির ৪৪ বলে ৪১ রান করে আউট হন। কিন্তু তখনও আস্থার প্রতীক হয়ে ক্রিজে ছিলেন সাকিব। এরই মধ্যে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৩তম ফিফটিও তুলে নেন। ২৬৭ রানের সময় উমেশ যাদবের বরে বাজে একটি শটে জাদেজার হাতে সহজ ক্যাচ তুলে দেন পয়েন্টে।
তবে নাসির হোসেন ২৭ বলে ৩৪ রান করে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে আউট হন দলীয় ২৮২ রানে । বাকি কাজটি করেন অধিনায়ক মাশরাফি দুই পেসারকে নিয়ে। রুবেল ৪ ও তাসকিন ২ রান করে আউট হলে মাশরাফি ৩টি চারের মারে ১৮ বলে ২১ রান করে ভারতের বিপক্ষে সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর গড়েন। এরপর ম্যাচের ২ বল বাকি থাকতে আউট হন তিনি। শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংসও।

No comments

Powered by Blogger.