পচা গমে পুলিশ ও আনসারে অসন্তোষ

বাজারের দেশি গম
ব্রাজিল থেকে দুই লাখ টন পচা ও পোকা খাওয়া গম আমদানি নিয়ে বিব্রত সরকার। পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, কোস্টগার্ড, সেনাবাহিনীসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তর নিম্নমানের এ গম গ্রহণে আপত্তি জানিয়ে এরই মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। গত ৮ই জুন প্রধানমন্ত্রী খাদ্য বিভাগের সচিব মুশফেকা ইকফাৎকে ডেকে ভর্ৎসনা করেন। নিজের রুমে ডেকে নিয়ে পচা গমের নমুনা দেখান এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দ্রুত তদন্ত করে পচা গম আমদানির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর পরই খাদ্য মন্ত্রণালয় দেশের সব জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে গমের এক কেজি ওজনের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য বলা হয়। এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানিকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মো. সারওয়ার খানকে গত রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) নিয়োগ করা হয়েছে। এর আগে গত ২২শে এপ্রিল গম আমদানি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় খাদ্য অধিদপ্তর থেকে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। গম কেলেঙ্কারির বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. সারওয়ার খান মানবজমিনকে জানান, ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম নিয়ে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে।
গুদামে আমদানি করা গম
কিন্তু সরকারি নিয়মের বাধ্যবাধকতায় আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না। খাদ্যমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ ও এপ্রিলে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের রেশনের জন্য নিম্নমানের গম দেয়া হয়। গন্ধযুক্ত এ গমের অভিযোগ পাওয়ার পরই বিষয়টি সম্পর্কে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানায় এসব বাহিনী। কিন্তু এ চিঠির বিষয়ে কোন সাড়া দেয়নি খাদ্যমন্ত্রণালয় ও খাদ্য বিভাগ। এরপর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানায়। এরপরই গম কেলেঙ্কারির থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত দুই লাখ টন পচা গমের আকার সরু। স্থানীয়ভাবে জিরা নামে পরিচিত। এ গম ব্রাজিলে সাধারণত পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গন্ধযুক্ত বলে ওএমএস ডিলাররা ওই গম থেকে উৎপাদিত আটা নিচ্ছেন না বলে বিভিন্ন এলাকায় ১৫ দিন ধরে ওএমএসের মাধ্যমে আটা বিক্রি বন্ধ রয়েছে। খাদ্যমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের গেল মেয়াদে গম আমদানি নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি। এ আমলের শুরু থেকেই গম আমদানি নিয়ে ব্যবসায় নামে একটি শক্তিশালী চক্র। গত বছরের ২০শে মার্চের পর খাদ্য বিভাগ গম আমদানি নিয়ে কোন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করে ১৯শে সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের সঙ্গে জি-টু-জির ভিত্তিতে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ইউক্রেনের প্রতি টন গমের দর নির্ধারণ করা হয় ২৯৭ ডলার। অথচ তখন বিশ্বে গমের দাম ছিল অনেক কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইউক্রেনের চলতি এফওবি মূল্য দেখানো হয় ২৩৭ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে টনপ্রতি সম্ভাব্য জাহাজ ভাড়া ৫০ মার্কিন ডলার দেখিয়ে বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছানোর সম্ভাব্য খরচ দেখানো হয়েছে ২৮৭ মার্কিন ডলার। এরপর অদৃশ্য কারণে ইউক্রেন থেকে গম আমদানির বিষয়টি ভেস্তে যায়। ফলে গম সংকট দেখা দিলে খাদ্য মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে ব্রাজিল থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই গম আমদানি নিয়ে নানা কথা চালু রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তরে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ই জানুয়ারি এবং গত বছরের ১৭ই ডিসেম্বর খাদ্য অধিদপ্তর ইমপেক্স কনসালট্যান্টস নামে একটি সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তির আওতায় ব্রাজিল থেকে মোট এক লাখ তিন হাজার ৯৯২ টন গম আমদানি করে। গম চট্টগ্রামে পৌঁছালে টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী জাহাজের গমের নমুনা খাদ্য বিভাগ তাদের নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। পরীক্ষণ বা বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে পরীক্ষিত নমুনার গমে আপেক্ষিক ওজন চুক্তিপত্রে উল্লিখিত বিনির্দেশ অপেক্ষা কম এবং মোট বিনষ্ট দানা ও বিজাতীয় পদার্থ চুক্তিপত্র অপেক্ষা বেশি পাওয়া যায়। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টনপ্রতি ২৬৫ ডলারে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রাজিল থেকে এসব গম আমদানি করছে তারা। আমদানিকৃত গমের মূল্য প্রায় সোয়া ৪০০ কোটি টাকা। আরও প্রায় তিন লাখ টন গমের এলসি খোলা হয়েছে। এদিকে খাদ্য বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক মো. সারওয়ার খানের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে ব্রাজিল থেকে আনা প্রথম দফার গম বুঝে নেয়া হয়। এ সংক্রান্ত ফাইলের নোটে তিনি অনেক কাটাছেঁড়া করেন। দ্বিতীয় দফায় পাঠানো গমের মধ্যে ৫২ হাজার টন বন্দরে দুই সপ্তাহ ধরে জাহাজে পড়ে আছে। উচ্চপর্যায়ে হস্তক্ষেপ হওয়ায় এ গম গ্রহণ করছে না খাদ্য অধিদপ্তর। আমদানিকারক ইমপেক্স ও ওলাম ইন্টারন্যাশনালকে নষ্ট গম ফেরত নিতে বলেছে খাদ্য অধিদপ্তর। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আমদানি করা নষ্ট গম ঢাকা জেলার চারটি এলএসডিতে তিন হাজার ৮১৬ টন, নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচটি এলএসডিতে ৩৫ হাজার ৪৯৬ টন, নরসিংদী জেলার চারটি এলএসডিতে ৫৭২ টন, গাজীপুর জেলার পাঁচটি এলএসডিতে ৬২২ টন, মুন্সীগঞ্জ জেলার পাঁচটি এলএসডিতে ২৪১ টন, ময়মনসিংহ এলএসডিতে ৮৩৮ টন, নেত্রকোনা জেলার পাঁচটি এলএসডিতে ২৩৩ টন, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে ৩৮০ টন, সিরাজগঞ্জ এলএসডিতে ৯০২ টন, বগুড়া জেলার চারটি এলএসডিতে ৮২২ টন, জয়পুরহাট জেলার দুটি এলএসডিতে ৮২৩ টন, দিনাজপুর জেলার নয়টি এলএসডিতে ৭৯৬ টন, রংপুর জেলার চারটি এলএসডিতে ৬১৪ টন, কুড়িগ্রাম জেলার চারটি এলএসডিতে ২৭৪ টন, লালমনিরহাট জেলার দুটি এলএসডিতে ১৮৬ টন, নীলফামারী জেলার দুটি এলএসডিতে ৩৫ টন ও গাইবান্ধা জেলার আটটি এলএসডিতে ৪৬০ টন গম মজুদ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.